পড়ে গিয়ে হাতে গুরুতর চোট পেয়েছিল সাত বছরের ছেলেটি। পেশায় রিকশাচালক বাবা তড়িঘড়ি নিয়ে গেলেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে। ডাক্তাররা জানালেন, ভর্তি করতে হবে, কিন্তু বেড নেই। ইমার্জেন্সির ডাক্তারবাবু পাঠালেন কাছের এক নার্সিংহোমে। তাঁদের কাছে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমার কার্ড আছে জেনে নিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘ওই কার্ড নার্সিংহোমে চলবে না। তবে ওরা আমাকে চেনে। কার্ডটা নিয়ে আমার সঙ্গে চলুন। আর টাকা যা লাগবে, সেটাও আমাকেই দেবেন। আমি কম খরচে সব ব্যবস্থা করব’। অচেনা ডাক্তারবাবুর এ হেন মহানুভবতায় ছেলেটির বাবা মুগ্ধ! তিনি জানতেনও না সরকারি বিমা সংস্থার তালিকাভুক্ত নার্সিংহোমে চিকিৎসার কোনও খরচই লাগার কথা নয়।
সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করে প্রসব প্রয়োজন ছিল এক তরুণীর। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনার কার্ডও ছিল তাঁর সঙ্গে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারবাবু মেয়েটিকে বললেন, “এখানে বেড নেই। আমি বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশন করব। ওরা আমার চেনা। তাই কোনও টাকা নেবে না। শুধু আমাকে তিন হাজার টাকা দিলেই হবে।” তরুণীর পরিবার আপ্লুত! বেসরকারি হাসপাতালে মাত্র তিন হাজার টাকায় প্রসব! তাঁরা জানতেন না, ওই কার্ডের সুবাদে সরকারি-বেসরকারি কোনও হাসপাতালেই তাঁদের একটি টাকাও খরচ হওয়ার কথা নয়। কান্দি হাসপাতালের ওই ঘটনায় হাতেনাতে ধরাও পড়েছেন সংশ্লিষ্ট ডাক্তার।
রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনাকে ঘিরে একটি অসাধু চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে। ডাক্তার এবং বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের কর্মীরা এর সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে জানিয়েছেন, বিষয়টি সম্পর্কে তাঁরাও ওয়াকিবহাল। বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁদের কাছে অভিযোগ আসছে। তাঁরা প্রয়োজন মতো ব্যবস্থাও নিচ্ছেন। তবে সরকারি এই প্রকল্পের পুরো সুফল পেতে গেলে লাগাতার সতর্কতা জরুরি।
রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনায় যেখানে সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে গরিব মানুষের বিনা পয়সায় চিকিৎসা সুনিশ্চিত থাকার কথা, সেখানেই এমন বঞ্চনার অভিযোগে দিশাহারা দশা স্বাস্থ্য দফতরের। চিকিৎসকদের একটা অংশের অসহযোগিতায় এমন একটা প্রকল্প যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ধাক্কা খাচ্ছে, সেটা কার্যত স্বীকারও করে নিয়েছেন তাঁরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন বিভিন্ন হাসপাতালে কড়া বার্তা পাঠানো শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশই মনে করছেন, এই বিমা যোজনা সম্পর্কে সরকারি তরফে আরও বেশি করে প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। কী এবং কতটা তাঁদের প্রাপ্য, গরিব মানুষকে সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করাটা খুবই জরুরি।
২০০৮ সালে চালু হয়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা। দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষ ৩০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করালেই পান একটি বায়োমেট্রিক স্মার্ট কার্ড। ওই কার্ডের মাধ্যমেই সর্বাধিক পাঁচ সদস্যের এক-একটি পরিবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসার জন্য বছরে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ পাবে। এই মুহূর্তে এ রাজ্যে ৬২টি সরকারি হাসপাতাল এবং ৫৪৪টি বেসরকারি হাসপাতালের নাম ওই বিমায় নথিভুক্ত।
দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “আমাদের কাছে দু’ধরনের অভিযোগ আসছে। কোথাও সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা রোগীদের বাইরের নার্সিংহোমে পাঠিয়ে সেই নার্সিংহোমের কাছ থেকে কমিশন পাচ্ছেন। আবার কোথাও বিষয়টা আরও খারাপ। সেখানে সংশ্লিষ্ট নার্সিংহোম বিমা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকা সত্ত্বেও রোগীর কাছ থেকে চিকিৎসা-বাবদ খরচ আদায় করা হচ্ছে। যে টাকা ভাগাভাগি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার এবং নার্সিংহোমের কিছু কর্মীর মধ্যে।
কিন্তু বায়োমেট্রিক কার্ডে তো রোগী ভর্তির সময়ে হাতের ছাপ প্রয়োজন? তা হলে ঠকানো হচ্ছে কী ভাবে? ওই কর্তা বলেন, “বহু ক্ষেত্রেই উপকার করার ছলে রোগীর বাড়ির লোককে সঙ্গে নিয়েই নার্সিংহোমে যাচ্ছেন কোনও কোনও ডাক্তার। সেখানে যাঁর নামে কার্ড, তাঁর হাতের ছাপও নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মুখে তাঁকে বলা হচ্ছে, কার্ডটা চলবে না। হাসপাতালে রোগীর নাম করে টাকাটা নিচ্ছেন ওই ডাক্তারবাবুই। ওই নার্সিংহোমকে তার ভাগ দেওয়া হচ্ছে। বেছে বেছে খুব গরিব এবং পড়াশোনা না-জানা মানুষকেই টার্গেট করা হচ্ছে।”
শুধু দরিদ্র মানুষের উপকার হয়েছে তা-ই নয়, স্বাস্থ্যবিমা যোজনা চালু হওয়ার পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে রোগী-ভর্তি এবং অস্ত্রোপচার বাবদ আয়ের পরিমাণও অনেকটাই বেড়েছে। এই ধরনের অসাধু চক্রকে রোখা গেলে সরকারি কোষাগারে আরও অনেক বেশি টাকা জমা পড়ত বলে স্বাস্থ্যকর্তাদের আক্ষেপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy