Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Madhya Pradesh Assembly Election

মর্যাদার লড়াই মহাকোশল জুড়ে, ‘পদ্মবনে’ বসে দুশ্চিন্তায় ছিন্দওয়াড়ার অধীশ্বর

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি কি সত্যিই খুব স্বস্তিতে রয়েছেন? এ বারের নির্বাচনটা কি তাঁর কাছে মাখনে ছুরি চালানোর মতোই মসৃণ? একেবারেই নয়। ছিন্দওয়াড়া জেলা মধ্যপ্রদেশের যে অঞ্চলের মধ্যে পড়ে, সেই মহাকোশলে এ বার ‘মর্যাদার লড়াই’-এর মুখে পড়ে গিয়েছেন কমল নাথ।

গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
ছিন্দওয়াড়া শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৮ ১০:৫৪
Share: Save:

রাত নেমে গিয়েছে। জটিল, অভেদ্য নকশার মতো বিছিয়ে থাকা সাতপুরা পর্বত থেকে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। কমল কুঞ্জের বিশাল গেটের পাশে গাড়ির সামনের সিটে জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিন্দওয়াড়ার সংখ্যালঘু কংগ্রেস নেতা শাফাত কুরেশি। ‘‘এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা হল? কেমন বুঝছেন আমাদের এখানকার হাওয়া?’’ প্রশ্ন শাফাতের। তার পরে নিজেই সতর্ক করে দিচ্ছেন,‘‘কমল নাথজির নাম নিয়ে জিজ্ঞাসা করেননি তো? ওঁর নাম উচ্চারণ করলে কিন্তু এখানে সবাই কংগ্রেস। দীপক সাক্সেনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করুন।’’

দীপক সাক্সেনা হলেন ছিন্দওয়াড়া বিধানসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী। আর কমল নাথ? তিনি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তো বটেই, ছিন্দওয়াড়ার সাংসদও বটে। কিন্তু এটুকু বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না। ছিন্দওয়াড়া জেলার সীমানায় পা রাখলেই বোঝা যায়, কমল নাথ আর ছিন্দওয়াড়া সমার্থক।

১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯ বার ছিন্দওয়াড়া লোকসভা আসন থেকে জয়ী হয়েছেন তিনি। মাঝে শুধু ১৯৯৬ সালে ভোটে দাঁড়াননি। হাওয়ালার হাওয়া চলছিল, তাই স্ত্রী অলকা নাথকে দাঁড় করিয়েছিলেন। অলকাই জেতেন। তবে ১৯৯৭ সালে স্ত্রীকে পদত্যাগ করিয়ে নিজে উপনির্বাচনে দাঁড়িয়ে হেরে যান। ওই এক বারই। ১৯৯৮ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে আবার একটানা ভারতীয় সংসদে ছিন্দওয়াড়ার প্রতিনিধি কমলই।

আরও পড়ুন: ঠাকুরের ভূত যেন ভর করেছে গোটা গ্রামে, কুটিয়ার চাষির ঘরে ঘরে ‘পঞ্জা’ ছাপ

মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস সভাপতির রাজনৈতিক যাত্রাপথ সম্পর্কে এই আখ্যান ছিন্দওয়াড়া জেলার প্রায় সব কংগ্রেস কর্মীর মুখস্থ। তাই ছিন্দওয়াড়া শহরে ঢোকার ২০ কিলোমিটার আগেই কোনও এক গঞ্জ এলাকায় মিছিলের প্রস্তুতি নিতে নিতে নবীন কংগ্রেস কর্মী জানিয়ে দেন, ছিন্দওয়াড়া শহরের মধ্যে কমল নাথের বাড়ি নয়। ওঁর বাংলো শিকারপুরে। আর শহরে ঢুকে শিকারপুর যাওয়ার পথনির্দেশ চাইলে স্কুলপড়ুয়া বালকও প্রথমেই বলে, ‘‘ওয়হি...কমল নাথজিকে বংলেওয়ালা রাস্তা।’’

মধ্যপ্রদেশে আপাতত হাত চিহ্নের অধীশ্বর তিনি। কিন্তু থাকেন ‘পদ্মবন’-এ। বাংলোর নাম ‘কমল কুঞ্জ’। কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকসাইটে মন্ত্রীরা ল্যুটিয়েন’স দিল্লিতে যে রকম বাংলো পেয়ে থাকেন, কমল কুঞ্জ দেখলে সে সব বাংলো একটু লজ্জা পেয়ে যেতে পারে। ‘‘বাড়ি, অফিস, বাগান, নিজস্ব হেলিপ্যাড— সব কিছু মিলিয়ে একশো একর রয়েছে এখানে।’’ বললেন শাফাত। গোটা এলাকা এখন কঠোর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। গাড়ির মেলা লেগে রয়েছে, উদয়াস্ত রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে কংগ্রেস নেতারা আনাগোনা করছেন। আর কমল নাথ রোজ সকাল ১০টায় নিজস্ব হেলিপ্যাড থেকে অথবা কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিন্দওয়াড়া এয়ারস্ট্রিপ থেকে উড়ে যাচ্ছেন। রাত ১২টা নাগাদ ফের কমল কুঞ্জেই ফিরছেন। উৎফুল্ল কংগ্রেস কর্মীদের অনেকেই এখন আর ‘কমল নাথজি’ বলছেন না, বলছেন ‘চিফ মিনিস্টার ইন ওয়েটিং।’’

এ হেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি কি সত্যিই খুব স্বস্তিতে রয়েছেন? এ বারের নির্বাচনটা কি তাঁর কাছে মাখনে ছুরি চালানোর মতোই মসৃণ? একেবারেই নয়। ছিন্দওয়াড়া জেলা মধ্যপ্রদেশের যে অঞ্চলের মধ্যে পড়ে, সেই মহাকোশলে এ বার ‘মর্যাদার লড়াই’-এর মুখে পড়ে গিয়েছেন কমল নাথ। কাটনি, ডিন্ডোরি, নরসিংহপুর, জবলপুর, সিবনী, বালাঘাট, মান্ডলা, ছিন্দওয়াড়া— এই আট জেলা নিয়ে মহাকোশল। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি যেমন মহাকোশলের, রাজ্য বিজেপির সভাপতি রাকেশ সিংহও তেমনই। তাঁর শহর জবলপুর। মধ্যপ্রদেশে বিজেপি-কংগ্রেসের মহাসংগ্রামকে এ বার তাই বলা হচ্ছে, ‘মহাকোশলের মহাসমর’। সেই মহাসমরে কমল নাথেরই পাল্লা ভারী, এমনটা বলার মতো পরিস্থিতি কিন্তু এখনও আসেনি।

রাজ্য বিধানসভার ২৩০টা আসনের মধ্যে ৩৮টা মহাকোশল অঞ্চলে। গত ১৫ বছর ধরেই বিজেপি এই অঞ্চলে পিছনে ফেলে রেখেছে কংগ্রেসকে। ২০০৩ সালে কংগ্রেস মাত্র ৫টা আসন জিতেছিল। কমল নাথের ছিন্দওয়াড়ার ৭টা আসনের মধ্যে ১টাতেও কংগ্রেস জিততে পারেনি। ২০০৮ সালে হাত চিহ্ন কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়। সে বার বিজেপি পেয়েছিল ২২। কংগ্রেস ১৬। কিন্তু ২০১৩ সালে ভোটে ফের পিছু হঠতে হয় কমল নাথ ব্রিগেডকে। বিজেপি পায় ২৫টা, কংগ্রেস ১৩টা।

এ বার রাজ্যে কংগ্রেস অনেক বেশি চাঙ্গা। উপরন্তু মহাকোশলের ভূমিপুত্র কমল নাথ প্রথম বারের জন্য প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। কংগ্রেসের আসন ১৩ থেকে বেড়ে ২২-এ যাবে বলে কংগ্রেস কর্মীদের আশা। কিন্তু আশার কথা উচ্চারণ করেই ফের শীতল স্রোত খেলে যাচ্ছে কংগ্রেসের মেরুদণ্ডে। সৌজন্য গোন্ডয়ানা গণতন্ত্র পার্টি (জিজিপি) এবং সাপাক্স পার্টি।

আরও পড়ুন: রক্তাক্ত বুলেটে কি ব্যালট কেনা যায়? প্রশ্ন চাষিদের

জিপিপি মূলত গোন্ড জনজাতির দল। মহাকোশল অঞ্চলে এই জনজাতির বাস বেশ বড় সংখ্যায়। এক কালে মালওয়া থেকে মহাকোশল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় গোন্ড শাসন চলত। গোন্ড রানি দুর্গাবতীকে নিয়ে নানান কিংবদন্তী মুখে মুখে ফেরে এখনও। ২০০৩ সালেই জিপিপি প্রথম বার বিধানসভা নির্বাচনে লড়ে এবং রাজনৈতিক শিবিরকে চমকে দিয়ে ৩টি আসনে জিতেও যায়। তার মধ্যে ১টা ছিল ছিন্দওয়াড়া জেলাতেই। কিন্তু জিপিপি নেতারা জনসমর্থন ধরে রাখতে পারেননি। দলের মধ্যে প্রবল কোন্দল শুরু হয়। ২০০৮ সালে জিপিপি একটাও আসন পায়নি। সেই সুবাদে কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। এ বার কিন্তু গোন্ড নেতারা আবার একত্র হয়েছেন। জিপিপি আবার ঐক্যবদ্ধ। ফলে সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছেন কমল কুঞ্জের বাসিন্দা। জিপিপি যত ভাল ফল করবে,কংগ্রেসের বিপদ তত বাড়বে প্রদেশ সভাপতির নিজের এলাকায়। আর হাসি ক্রমশ চওড়া হবে রাকেশ সিংহের।

হিসেব গোলমাল করে দিচ্ছে সাপাক্স পার্টিও। বিজেপি, কংগ্রেস— দু’পক্ষই চিন্তায় সাপাক্স-কে নিয়ে। সামান্য, পিছড়ে এবং অল্পসংখ্যক— এই তিন শ্রেণির নাম মিলিয়ে দলের নাম রাখা হয়েছে সাপাক্স। ভোট ঘোষণার মাস দুয়েক আগে দলের পত্তন। কিন্তু গোটা রাজ্যে ১০৯টা আসনে প্রার্থী দিয়ে দিয়েছে সাপাক্স। দলের সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) সুরেশ তিওয়ারি বললেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া হিসেব অনুযায়ী আমাদের প্রার্থীর সংখ্যা ১০৯। কিন্তু এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের আমরা শেষ মুহূর্তে ‘ঝুলা’ (দোলনা) প্রতীক দিয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু আসলে তাঁরা সাপাক্সের সমর্থনে বা সাপাক্সের প্রার্থী হিসেবেই লড়ছেন। সব মিলিয়ে সংখ্যা ১৬০।’’

নির্বাচনের হিসেব গুলিয়ে দিতে হাজির সাপাক্স পার্টি। নিজস্ব চিত্র।

মাত্র দু’মাস আগে তৈরি হওয়া একটা দল নির্বাচনে এত সংখ্যক প্রার্থী দিয়ে দিল— এটা কিন্তু মধ্যপ্রদেশের ইতিহাসে বিরল। সুরেশ তিওয়ারি নিজেই ব্যাখ্যা করলেন সাপাক্স-কে নিয়ে এই উৎসাহের কারণ। বললেন, ‘‘সরকার যা কিছু করছে, সবই তফসিলি জাতি আর উপজাতির জন্য, জনসংখ্যার মাত্র ২২ শতাংশ যাঁরা, তাঁদের জন্য সব, বাকি ৭৮ শতাংশের জন্য কিছুই নেই। তফসিলি জাতি বা উপজাতির উপরে অত্যাচার রোখার নামে যে আইন করেছেন এঁরা, সেটা অন্যান্য জাতের দম বন্ধ করে দিচ্ছে। খুনের মামলাতেও তদন্তের পরে গ্রেফতার করা হয়। আর এঁরা আইন করেছেন যে, তফসিলি জাতি বা উপজাতির উপর অত্যাচারের অভিযোগ উঠলেই আগে গ্রেফতার, পরে তদন্ত। আগাম জামিনের সংস্থানটা পর্যন্ত রাখেনি। মিথ্যা অভিযোগও যদি কেউ করেন, তা হলেও কোনও তদন্ত হবে না, আগে গ্রেফতার করা হবে।’’ সুরেশের দাবি, এই আইন সামাজিক বৈরিতা বাড়িয়ে দিয়েছে, তফসিলি জাতিভুক্তদের সঙ্গে অন্যদের মনান্তর বাড়ছে।

আরও পড়ুন: বাপ-মা তুলেই তরজার ফুলঝুরি

সাপাক্স নেতৃত্বের দাবি, দুই অঙ্কে পৌঁছবে তাঁদের আসনসংখ্যা। সুরেশ তিওয়ারি জোর গলায় বলছেন, ‘‘সরকার কাদের হবে, সেটা সাপাক্স পার্টিই স্থির করবে।’’ অর্থাৎ ত্রিশঙ্কু বিধানসভার ইঙ্গিত দিচ্ছেন তিনি। সুরেশ তিওয়ারির সেই আশা পূরণ হওয়া কতটা সম্ভব, তা নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরের যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কিন্তু সাপাক্স যে ভাবে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেছে, বর্ণহিন্দুর ভোট নিয়ে আশঙ্কায় বিজেপি, কংগ্রেস চিন্তিত সংখ্যালঘু জনভিত্তি নিয়ে।

(দেশজোড়া ঘটনার বাছাই করা সেরা বাংলা খবর পেতে পড়ুন আমাদের দেশ বিভাগ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE