Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বনে আগুন, ত্রিপুরাকে কড়া বার্তা কেন্দ্রের

পার্বত্য ত্রিপুরার বনাঞ্চলের প্রায় অর্ধেক আগুনে ঝলছে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার জানে, অথচ রাজ্যের বন দফতর নাকি জানেই না। আর জানলেও এ নিয়ে তাঁদের যে বিশেষ মাথাব্যাথা আছে তাও মনে হয় না বলেই মনে করছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রক। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে রাজ্যের বন জ্বলছে আর দিল্লি থেকে সতর্কবার্তা আসছে রাজ্যের কাছে, তোমার অমুক বন আগুনে ঝলসে গিয়েছে, কিংবা তমুক বনে এখন আগুন জ্বলছে।

আশিস বসু
আগরতলা শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৫ ০৩:১১
Share: Save:

পার্বত্য ত্রিপুরার বনাঞ্চলের প্রায় অর্ধেক আগুনে ঝলছে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার জানে, অথচ রাজ্যের বন দফতর নাকি জানেই না। আর জানলেও এ নিয়ে তাঁদের যে বিশেষ মাথাব্যাথা আছে তাও মনে হয় না বলেই মনে করছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রক। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে রাজ্যের বন জ্বলছে আর দিল্লি থেকে সতর্কবার্তা আসছে রাজ্যের কাছে, তোমার অমুক বন আগুনে ঝলসে গিয়েছে, কিংবা তমুক বনে এখন আগুন জ্বলছে। এই আগুনের মোকাবিলা করার জন্য রাজ্য সরকারকে বার বার সতর্ক করেও কোনও ফল না হওয়ায় বা তাদের কাছ থেকে বিশদ রিপোর্ট না পেয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় বন মন্ত্রক রাজ্য়ে একটি কড়া চিঠি পাঠিয়েছে। মন্ত্রকের সচিব আনমল কুমার রাজ্যের মুখ্য বনপাল (পিসিসিএফ) সনাতন তালুকদারকে এক চিঠিতে জানিয়েছেন, ‘‘বনাঞ্চলের আগুন (‘ফায়ার সিগনাল’) সম্পর্কে মন্ত্রক কোনও তথ্য জানতে চাইলে, তা কোনও ভাবেই চেপে যাওয়া যাবে না। বাধ্যতামূলক ভাবে তা পরিবেশ ও বন মন্ত্রককে জানাতেই হবে।’’

স্যাটেলাইট নির্ভর ‘রিমোট সেন্সিং’ প্রযুক্তির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রক দেশের কোথায় কোন বনে আগুন লেগেছে বা কোন বন ঝলসে খাক হয়ে গিয়েছে তা মুহূর্তেই জেনে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই তা সংশ্লিষ্ট রাজ্যকে জানানো হয়। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ত্রিপুরার কোন কোন বন আগুনে ঝলছে গিয়েছে, তার ছবিও মন্ত্রক থেকে পাঠানো হয়েছে। এখন কোন বনাঞ্চল জ্বলছে, সেটা জানার জন্য এবং তা প্রতিরোধ করার জন্য কী কী করণীয়, সে কথাও কেন্দ্রীয় মন্ত্রক জানিয়েছে।

রাজ্য বন দফতরের নোডাল অফিসার চিন্তামণি দেববর্মা কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের সাম্প্রতিক ‘সতর্কবার্তা’ বিষয়ে অবহিত। কিন্তু রাজ্যের বনমন্ত্রীকেও এ বিষয়ে জানানো হয়নি। সব শুনে ত্রিপুরার বনমন্ত্রী, জনপ্রিয় উপজাতি নেতা অঘোর দেববর্মার বক্তব্য, ‘‘এ ধরনের কেন্দ্রীয় বার্তার কথা তো দফতরের কেউ আমাকে জানাননি।’’

রাজ্য বন দফতর সূত্রের খবর ত্রিপুরার বনে আগুন লাগার থেকেও লাগানোর ঘটনা বেশি। এবং তা বন্ধ করা সরাসরি সরকারি আমলাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে এক বনকর্তার বক্তব্য।

তাঁদের বক্তব্য, ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশই উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত। ১৮-১৯টি উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ এ রাজ্যে বসবাস করেন। বহু উপজাতি পরিবার বংশ পরম্পরায় ‘জুম’ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পাহাড়ি জমিতে এক দফা চাষের পরেই সেখানে আগুন লাগানো হয়। কারণ তাতে জমির উর্বরতা বেড়ে যায়। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়াও নতুন জমির সন্ধানে ‘জুমিয়ারা’ বনেও আগুন লাগিয়ে গাছপালা সাফ করে নতুন জমি তৈরি করে তারা। বন দফতর তা বন্ধ করতে পারছে না। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলি যদি এ ব্যাপারে জুমিয়াদের নিরস্ত না করে, তাদের সচেতন না করে তবে বন দফতরের একার পক্ষে কিছু যে করা সম্ভব নয় তা একান্ত আলোচনায় স্পষ্ট করেই জানাচ্ছেন দফতরের একাধিক কর্তা।

১৯৭৬ সাল থেকে জুমিয়াদের পুনর্বাসন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। ত্রিপুরা সরকারকেও সেই খাতে গত কয়েক দশক ধরে প্রচুর টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তার পরেও জুমিয়াদের জুম চাষ থেকে পুরোপুরি বিরত করা যায়নি। মন্ত্রী অঘোর দেববর্মার কথায়, ‘‘রাজ্যে প্রায় ১ লক্ষ জুমিয়া পরিবার ছিল। বংশ পরম্পরায় জুম চাষ করে এমন প্রায় ২০ হাজার পরিবার এখনও ত্রিপুরায় রয়েছে।’’

জুমিয়া পরিবার ছাড়াও বনাঞ্চলে স্থানীয় ভাবে বসবাস করে এমন বহু পরিবারকে ২০০৯ সাল থেকে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় ‘বনাধিকার আইন’ অনুসারে জমি দিচ্ছে বলে মন্ত্রী জানান। গড়ে প্রতি পরিবারকে দুই থেকে আড়াই একর জমি দেওয়া হয়েছে। এখনও পর্যন্ত বনাঞ্চলের ১ লক্ষ ৭৬ হাজার হেক্টর জমি রাজ্যের ১ লক্ষ ২৩ হাজার উপজাতিভুক্ত পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রীর কথায়, ‘‘বনাঞ্চলে দীর্ঘ দিন ধরে বসবাস করছেন, এ রাজ্যের এমন ৯৯ শতাংশ পরিবারকেই কেন্দ্রীয় আইন মেনে বনাঞ্চলে জমি দেওয়া হয়েছে।’’

তার পরেও কেন পার্বত্য বনাঞ্চলে নির্বিচারে আগুন ধরানো হচ্ছে, ‘জুম’ চাষ চলছে? মন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘আসলে বংশ পরম্পরায় জুম চাষ করে জীবন-যাপন করেন এমন বেশ কিছু পরিবার এ রাজ্যে এখনও রয়েছে। তাদেরকে জুমের ক্ষতিকারক দিকটি বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তার পরও তারা জুম-অভ্যাস ত্যাগ করতে পারছে না।’’

অবশ্য দফতরের কর্মী-অফিসারদের এলাকায় গিয়ে যে ভাবে ‘সচেতন’ করার কাজ করার কাজ করা উচিত, তা তাঁরা যে করছেন না, সেটাও অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন মন্ত্রী। পাশাপাশি, মুখ্য বনপাল সনাতনবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে বনাঞ্চলে জুমিয়াদের আগুন লাগানো বন্ধ করা রীতিমতো কঠিন কাজ।’’ রাজনৈতিক ভাবে মন্ত্রীর দল তাহলে কী করছেন? সরাসরি উত্তর মন্ত্রী এড়িয়ে গিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘জুমিয়া পরিবারগুলির সদস্যদের সচেতনতার মাত্রা এখনও দুর্বল। তাই জুম-নির্ভর জীবনশৈলীই তাদের এখনও প্রথম পছন্দ। আমরা চেষ্টা করছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE