ঠাকুর প্রভুনাথ সিংহ। —ফাইল চিত্র।
প্রায় আড়াই দশক আগের কথা। ১৯৯৫ সালের বিহার বিধানসভার ফল সবে বেরিয়েছে। সারণ (তখনকার ছপরা) জেলার মশরখ বিধানসভা কেন্দ্রে জনতা দল প্রার্থী অশোক সিংহ বিজয়ী হয়েছেন। হারিয়ে দিয়েছেন প্রধান প্রতিপক্ষ ঠাকুর প্রভুনাথ সিংহকে। টানা দশ বছরের বিধায়ক, পরাজিত ‘রাজপুত’ প্রভুনাথ প্রকাশ্যে হুমকি দিলেন, তিন মাসের মধ্যে উড়িয়ে দেবেন অশোককে। তিন মাসও কাটেনি। পটনার বিধায়ক নিবাসে বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন অশোক। থানায় অভিযোগ দায়ের করলেন নিহত বিধায়কের স্ত্রী চাঁদনী দেবী। প্রধান অভিযুক্ত প্রভুনাথ ও তাঁর দুই ভাই।
এমন অভিযোগ তো কতই হয়! ‘দাবাং’ প্রভুনাথের যে তাতে হেলদোল নেই, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এই ঘটনার পর তাঁর ক্রমাগত রাজনৈতিক উত্থানে। ছিলেন বিধায়ক, ১৯৯৮ সালের লোকসভা ভোটে জেডিইউ টিকিটে জিতে সংসদ ভবনে। ১৯৯৯ সালে ফের সাংসদ। ২০০৪ সালেও অপ্রতিরোধ্য প্রভুনাথ। ২০০৯ সালে দল বদলে লালুপ্রসাদের আরজেডিতে। কিন্তু হেরে গেলেন। ২০১৩ সালের উপনির্বাচনে ফের মহারাজগঞ্জের আরজেডি সাংসদ। ২০১৪ সালে ধরাশায়ী মোদী-ঝড়ে। এবং এর পরেই তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ল আরও এক ঝড়।
২২ বছর আগের সেই ‘ঘোষিত’ অপরাধের জেরে ২০১৭ সালে জেলবন্দি হলেন ‘বাহুবলী’ প্রভুনাথ। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন ঠাকুর প্রভুনাথ সিংহ। রসৌলি বাজারে একটি ওষুধের দোকানে বসে সেই কাহিনি শোনাচ্ছিলেন আমন সিংহ। অশোক সিংহের এক তুতো ভাইপো। পরিবারের বিভিন্ন জনের মুখে মুখে শোনা ‘কহানি’ শেষ করে আমনের বক্তব্য, ‘‘মহারাজগঞ্জ কি দাবাং কো কানুন নে দাবা দিয়া।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
সারণের চারটে ও সিওয়ান জেলার দু’টি বিধানসভা আসন নিয়ে মহারাজগঞ্জ লোকসভা ক্ষেত্র। এখানকার মানুষ বলেন, বিহারের ‘চিতোরগড়’। রাজপুত আধিক্যের কারণেই এই শিরোপা। প্রায় ১৪ লক্ষ ভোটারের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ রাজপুত ভোট। রয়েছে ভূমিহার ও যাদবদের আধিপত্যও। পূর্ব উত্তরপ্রদেশ লাগোয়া এই আসনে ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন তৎকালীন জনতা দল সভাপতি চন্দ্রশেখর। কাবলপুরার বৃদ্ধ, ঠাকুর রণবীর সিংহ অবশ্য প্রবল জাত্যাভিমানে বললেন, ‘‘ঠাকুর চন্দ্রশেখর’’। রাজপুত চন্দ্রশেখর জাতপাতের তকমা ছাড়তে পারিবারিক ‘সিংহ’ পদবি ছেড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নিজের আসন বালিয়া ছাড়া দ্বিতীয় আসনে লড়ার প্রশ্ন যখন উঠেছিল, চন্দ্রশেখর কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন রাজপুত-প্রধান মহারাজগঞ্জকেই। রণবীরবাবুর কথায়, ‘‘দু’টি আসনে জিতে তিনি যখন তাঁর সাবেক আসন বালিয়া রেখে মহারাজগঞ্জ ছাড়লেন, আমরা খুব দুঃখ পেয়েছিলাম।’’
বিহারের ‘চিতোরগড়’-এর সাংসদ তালিকায় চোখ বোলালেই বোঝা যায় ‘রাজপুত ঠাকুর’দের জয়জয়কার। এবং সকলেই এলাকায় রীতিমতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ হিসেবেই স্বীকৃত। এরই মধ্যে ‘বাহুবলী’ প্রভুনাথ ছিলেন ঠাকুরদের বিশেষ পছন্দের। কারণ তাঁর ওই ‘দাবাং’ বা ডাকাবুকো হাবভাব। ২০১৪ সালে প্রভুনাথকে হারিয়ে মহারাজগঞ্জের সাংসদ হন সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ ‘ভূমিহার’ নেতা জনার্দন সিংহ সিগরিওয়াল। পেশায় শিক্ষক সিগরিওয়াল সাংসদ হওয়ার আগে পর্যন্ত ছপরার বিধায়ক ছিলেন। ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রীও। এবং ‘চিতোরগড়’-এর ‘ঐতিহ্য’ ভেঙে গত পাঁচ বছরে তিনি ‘ভদ্রলোক’ সাংসদের একটা ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন। জালালপুরের বিজেপি কর্মী রাকেশের কথায়, ‘‘মানুষের বিপদে-আপদে জনার্দনবাবু সব সময়েই পাশে থেকেছেন। সে কারণেই এ বারও তিনি জিতবেন।’’
জনার্দনবাবুর এ বারের প্রধান প্রতিপক্ষ আরজেডি প্রার্থী রণধীর সিংহ। রাজপুত এবং জেলবন্দি প্রভুনাথের ছেলে। কিন্তু বাহুবলী প্রভুনাথের ছেলেটি ‘দাবাং’ প্রজাতির নয় বলে আক্ষেপ আরজেডির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একাংশের। মহারাজগঞ্জের আরজেডি অফিসে বসে রাজীব রঞ্জনের বক্তব্য, ‘‘রণধীর ভি পড়িলিখি আদমি। অচ্ছা লেড়কা। জেন্টল ভি হ্যায়।’’ তাতে আশপাশে বসা দু’তিন জন যুবক ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘‘আরে উসসে কেয়া হোগা! দাবাং চাহিয়ে, দাবাং।’’ রাজীব রঞ্জন আশ্বস্ত করেন তাঁদের, ‘‘আরে প্রভুনাথজি কা পরছায়া হ্যায় না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy