Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
general-election-2019-national

মুখিয়া-পতিদের রাজত্বেও বিহারে ‘আজাদি’র মুখ মনোরমারা 

বিহারের সারণ জেলার সাগুনি গ্রামের কাছারিঘর বাদানুবাদে তেতে উঠেছে। বিন্দু কুমারী টলার পাত্রী নন। সোজা বলে দিলেন, ‘‘না পোষায় তো উচ্চতর আদালতে যান। বৈধ প্রমাণ ছাড়া আমি নিকাহ হয়েছে বলে মানব না।’’ 

নিজের গ্রামে মনোরমা। নিজস্ব চিত্র

নিজের গ্রামে মনোরমা। নিজস্ব চিত্র

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
পটনা শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৯ ০৫:০০
Share: Save:

চার ভাইয়ের এক ভাই পঁচিশ বছরেরও বেশি নিখোঁজ। তাঁর সম্পত্তির একটা বিলিবন্দোবস্ত প্রয়োজন। ভ্রাতৃবধূ বড় দেওরের সংসারে থাকেন। কিন্তু কনিষ্ঠ দেওরের দাবি, ওঁর নাকি নিকাহ হয়ে গিয়েছে। ফলে প্রাক্তন স্বামীর সম্পত্তিতে হক নেই। মহিলাকে বঞ্চিত করার ফিকির নয় তো এটা? নিকাহ-র বৈধ প্রমাণ কোথায়?

বিহারের সারণ জেলার সাগুনি গ্রামের কাছারিঘর বাদানুবাদে তেতে উঠেছে। বিন্দু কুমারী টলার পাত্রী নন। সোজা বলে দিলেন, ‘‘না পোষায় তো উচ্চতর আদালতে যান। বৈধ প্রমাণ ছাড়া আমি নিকাহ হয়েছে বলে মানব না।’’

তৃণমূল স্তরে ছোটখাটো বিবাদ-বচসা মেটানো, ন্যায়বিচার করার দায়িত্ব গ্রাম কাছারির। নির্বাচিত সরপঞ্চ সে কাছারির বিচারক, আইনি সহায়তা করার জন্য রয়েছেন ন্যায়মিত্র। নির্বাচিত পঞ্চরাও আছেন। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সরপঞ্চ রায় দেবেন। সাগুনির একটি স্কুলঘরে সকলে জড়ো হয়েছেন। সাগুনি আদতে বিন্দুর শ্বশুরবাড়ির গ্রাম। জাত পরিচয়ে তিনি অতি-পিছড়ে বর্গভুক্ত। সে দিক থেকে কাছারি সরপঞ্চ হিসেবে বিন্দুর জয় বিহারের চলতি ছকের বাইরে। কারণ, সাগুনির আসনটি সংরক্ষিত আসন নয়। পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করা বিন্দু উঁচু জাতের ভোটেই জিতেছেন। গ্রামের অধিকাংশই মেনে নিয়েছেন, বিন্দুই গ্রামে সব চেয়ে শিক্ষিত, কাছারির দায়িত্ব তাঁর হাতেই যাওয়া উচিত।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

একা হাতে ছক উল্টে দিয়েছেন মনোরমাও। সালোয়ার কামিজের সঙ্গে জহর কোট আর ওড়না, বাইক চালিয়ে এলাকা চযে বেড়ান। মনোরমা কুমারী, সারণেরই গরখা জেলা পরিষদের সদস্য। গরখা ব্লকের গবেন্দ্রি গ্রামে বাড়ি, পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মনোরমা সব চেয়ে ছোট। পরিবারে একমাত্র তিনিই লেখাপড়া শিখেছেন, গ্রামের মধ্যে প্রথম মেয়ে হিসেবে হাইস্কুলে গিয়েছেন। জাত পরিচয়ে তিনিও অতি-পিছড়ে বর্গের। মনোরমার শৈশব কেটেছে শুধু অভাব আর অপমান দেখে। পাশের গ্রামের ভূমিহার এসে মাকে বলেছে, গম ঝাড়াই করে দিতে। মায়ের শরীর খারাপ, যেতে চাননি। উঁচু জাত হাঁসুয়া বের করে বলেছে, না যাবি তো কেটে রেখে দেব!

আট কিলোমিটার দূরে স্কুল। বান্ধবীর সঙ্গে বৃত্তির পয়সা দিয়ে সাইকেল কিনলেন। গ্রামে নিত্য টিপ্পনি, ‘‘কালেক্টর বনেগি কেয়া?’’ কালেক্টর হতে গেলে যত দূর পড়াশোনা চালাতে হত, অভাবের সংসারে সেটা সম্ভব হল না। তবে মনোরমা ঠিক করে নিলেন, বিয়ে-শাদি নয়। এই পরিবেশটা বদলাতে চেষ্টা করাই তাঁর ব্রত। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় চাকরি করছিলেন। সাইকেল থেকে তত দিনে তিনি মোটরবাইকে সওয়ার। ২০১৬ সালে জেডিইউ থেকে জেলা পরিষদে দাঁড়ানোর প্রস্তাব এল।

বিন্দু-মনোরমাদের উঠে আসার পিছনে নারী স্বশক্তিকরণে সরকারের ঝোঁক অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। —নিজস্ব চিত্র।

নিজের উপার্জনে তৈরি পাকা বাড়িতে বসে মনোরমা শোনাচ্ছেন তাঁর কাহিনি। ‘‘সাত পাঁচ ভেবে আমি তো রাজি হয়ে গেলাম। পরিচিত মহলে বলেও ফেললাম। তার পরে ওঁরা বললেন, ওঁদের অন্য প্রার্থী ঠিক হয়েছে। রাগ হল, জেদও চেপে গেল। ভোটে আমি দাঁড়াবই। নির্দলই সই। নিজেই বাইক চালিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজের প্রচার করলাম, সঙ্গে আমার এক বান্ধবী থাকত কেবল। আর কেউ না। প্রায় পাঁচ হাজার ভোটে জিতে গেলাম। কাজ করতে গিয়ে দেখি, যে সব মেয়ে জিতে এসেছেন অন্যান্য পদে, বেশির ভাগই কেউ স্বামী, কেউ দাদার কথায় চলেন। আমাকে তো পরামর্শ দেওয়ারও কেউ নেই, সাহায্য করারও নেই। কিছু নেই বলে আজাদিটা আছে!’’

বিন্দু-মনোরমাকে দিয়েই কি আজকের বিহারকে বোঝা সম্ভব? স্থানীয়রা বলবেন, কিছুটা হ্যাঁ, কিছুটা না। বিন্দু-মনোরমাদের উঠে আসার পিছনে নারী স্বশক্তিকরণে সরকারের ঝোঁক অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষত পঞ্চায়েতে মেয়েদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন, ‘জীবিকা’ প্রকল্পে গ্রামীণ উপার্জনে জোর, স্কুল আর পুলিশে মেয়েদের জন্য ৩৫ শতাংশ সংরক্ষণ বাহুবলী-রাজ্যে একটা সামাজিক পরিবর্তনের সূত্রপাত করেছে। আর কিছু না হোক, মেয়েদের সামগ্রিক উপস্থিতিটাই একটা দৃশ্যগত বদল ঘটিয়ে দিচ্ছে।

আবার একই সঙ্গে এই বদল যে অনেকাংশেই নাম-কা-ওয়াস্তে, সে উদাহরণও ভূরি ভূরি! যেমন বিহারের গ্রামাঞ্চলে এখন এসপি, এমপি-দের রমরমা। সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ বা মেম্বার অব পার্লামেন্ট নয় কিন্তু। এখানে এসপি মানে সরপঞ্চ-পতি, এমপি মানে মুখিয়া-পতি! ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।

শহরের ছবিটা কী? পটনার মোড়ে মোড়ে মহিলা ট্রাফিক কনস্টেবলদের হাজিরা নজর এড়ানোর জো নেই। গত বছরের শেষ দিকে এই মহিলা পুলিশদের একাংশই কিন্তু ফেটে পড়েছিলেন বিক্ষোভে। পুলিশ লাইনের মধ্যে পুলিশেরই গাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন পুলিশ-মেয়েরা, যার জেরে চাকরি খোয়ান শতাধিক। কেন? অনুঘটকের কাজ করেছিল সবিতা কুমারী নামে এক ট্রেনি কনস্টেবলের মৃত্যু। কর্তব্যরত অবস্থাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান সবিতা। মেয়েদের অভিযোগ ছিল, ডেঙ্গি আক্রান্ত সবিতার ছুটি বাতিল করে তাঁকে জোর করে পাঠানো হয়েছিল ডিউটিতে।

পরে কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত অজস্র অসুবিধার কথা মহিলা কমিশনকে জানিয়েছিলেন সেই মেয়েরা। যা স্পষ্ট ইঙ্গিত করছিল, মহিলাদের চাকরি দেওয়া হয়েছে বটে। কিন্তু না তৈরি তার পরিকাঠামো, না তৈরি তাকে গ্রহণ করার মতো মন। সংবাদমাধ্যমে ওঁরা এখন আর মুখ খুলতে চান না তেমন। কিন্তু পটনারই একটি নারী সংগঠনের তথ্যানুসন্ধান রিপোর্টে তাঁদের যে বক্তব্য উঠে এসেছে, তা ভয়ঙ্কর। সেখানে মেয়েরা অভিযোগ করেছেন, নিয়মিত গালিগালাজ, যৌন হয়রানি, কুপ্রস্তাব তো ছিলই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় ডিউটিতে পাঠানো হত শৌচাগারের ব্যবস্থা ছাড়াই। পুরুষ সহকর্মীরা বলতেন, ‘‘ছেলেদের কাজে এসেছ যখন, ছেলেদের মতো রাস্তাতেই...।’’ ঋতুকালীন প্রাপ্য ছুটি চাইতে গেলে শুনতে হত, ‘‘ছবি-সহ প্রমাণ দেখাও আগে!’’

সমাজকর্মী কাঞ্চন বালার পর্যবেক্ষণ, নারী স্বশক্তিকরণের কথা বলে নাম কেনার দিকে নীতীশ সরকারের যতটা আগ্রহ, বাস্তবটা তার সঙ্গে মেলে না তত। ১৯৭৪-এর আন্দোলন থেকে উঠে আসা কাঞ্চন পরপর শুনিয়ে যান, মুজফ্‌ফরপুর, পটনা, জেহানাবাদ, সীতামঢ়ি, নওয়াদা— মেয়েদের উপরে ঘটে চলা অসংখ্য হিংসার নারকীয় কাহিনি, সম্প্রতি প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে যেখানে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। হাওয়ায় কান পাতলে শোনা যায়, মুজফ্ফরপুর হোমের ঘটনা আসলে হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

তবু...তবু বিহারে এ বার নির্বাচন কমিশনের প্রচার দেখলে মনে হতে পারে, ভোটটা বুঝি মেয়েদেরই। পটনার গাঁধী ময়দান ঘিরে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার ডাক দিয়ে যত ব্যানার, তার মধ্যে সিংহভাগই মেয়েদের মুখ। ছাপ্পা আর বুথ দখলের স্বর্ণযুগ অতিক্রান্ত যে! মাথা গুনতি ভোট টানতে মেয়েদের বড় দরকার। গোলঘর চত্বরে উপস্থিত গিন্নিবান্নিদের ডেকে সংবাদমাধ্যমও বোঝাচ্ছে, ‘‘আপনারা তো ঘর সামলান। দেশ সামলানোর কাজেও আপনাদের মূল্যবান মতামতটা জানান!’’

শহরের প্রাণকেন্দ্র ছাড়িয়ে একটু এগোলেই কুম্রহার। সেখানেই প্রাচীন পাটলিপুত্রের প্রত্নক্ষেত্র। সনাতন সাম্রাজ্যের ধ্বংসশেষের সেই প্রস্তরখণ্ড থেকে পাঁচিলের বাইরে তাকালে চোখে পড়ে ৫৬ ইঞ্চির ব্যানার, ফির এক বার...। প্রক্সিই হোক বা সাচ্চাই হোক, এ বার ‘কিংমেকার’ হতে পারেন মেয়েরাও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE