নিজস্ব চিত্র।
বেজায় ‘টানাটানি’ সংসারে। লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আসছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক দলকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে ঝাঁপাতে চাইছে কংগ্রেস। শুধু জোটে যে কাজ হবে না, ক্ষমতায় ফেরার জন্য নিজেদের আসনসংখ্যাও যে অনেকটা বাড়াতে হবে, তা-ও কংগ্রেস নেতৃত্ব খুব ভাল ভাবেই জানেন। কিন্তু পরিস্থিতি যে রকম, তাতে ‘সর্বশক্তি’ দিয়ে ঝাঁপালেও কাজ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে খোদ এআইসিসি। কারণ ‘শক্তি’টাই কমে গিয়েছে। দলের কোষাগার বেহাল। দ্রুত হাল ফেরাতে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে দিল্লিতে। তলব করা হয়েছে সব রাজ্যের সভাপতি এবং কোষাধ্যক্ষদের।
দেশে মুখ্যমন্ত্রীর সংখ্যা ৩১। কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীর সংখ্যা মাত্র ৩। একটাও বড় রাজ্য হাতে নেই। মাঝারি আকারের পঞ্জাব আর মাত্র ১১ লক্ষ জনসংখ্যার মিজোরাম— দখলে আপাতত এই দুই রাজ্য। আর রয়েছে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পুদুচেরি।
লোকসভায় কংগ্রেসের আসনসংখ্যা ৪৮। এর আগে কোনও লোকসভায় এত নীচে নামেনি কংগ্রেসের আসনসংখ্যা। রাজ্যসভার ইতিহাসেও কংগ্রেসের এত খারাপ অবস্থা কখনও দেখা যায়নি। ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে এই প্রথম বার কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে দ্বিতীয় স্থানে চলে গিয়েছে।
সংখ্যা বা অঙ্কগুলোর দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়, কংগ্রেসের প্রভাব কমতে কমতে কোথায় পৌঁছেছে। এর আগেও কংগ্রেসকে শোচনীয় পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়েছে। ১৯৭৭ সালে দেশজুড়ে অপ্রত্যাশিত প্রত্যাখ্যানের মুখ দেখতে হয়েছিল ইন্দিরা গাঁধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসকে। ১৯৯৬,১৯৯৮, ১৯৯৯-এর লোকসভা নির্বাচনগুলোতেও সংসদের নিম্নকক্ষে কংগ্রেসের চেহারা খুব ভাল ছিল না। কিন্তু অনেকগুলি রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতা ধরে রেখেছিল। বৃহত্তম দল ছিল রাজ্যসভাতে।
জরুরি বৈঠকের চিঠি। নিজস্ব চিত্র।
শুধু আইনসভাগুলোয় নয়, আইনসভার বাইরের নানা ক্ষেত্রেও প্রভাব বহাল রাখতে কংগ্রেস সক্ষম হয়েছিল ক্ষমতার বাইরে যাওয়া সত্ত্বেও। শিল্প মহল থেকে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী, সামাজিক সংগঠন থেকে শিল্পকলা-সংস্কৃতির জগৎ— সব ক্ষেত্রেই দলের শিকড় ছিল গভীরে। প্রভাব ছিল অটুট। ফলে ক্ষমতার বাইরে থেকেও দলের অবস্থা জরাজীর্ণ হয়ে পড়েনি এর আগে কখনও।
এ বার কিন্তু সেই অবস্থাই হয়েছে। তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগও রয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে। খবর এআইসিসি সূত্রেরই। কেউই প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বা ঘনিষ্ঠ পরিসরে অনেকেই মেনে নিচ্ছেন যে, দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প মহল এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের উপরে কংগ্রেসের প্রভাব হু হু করে কমেছে গত চার বছরে। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের নেতৃত্বে বিজেপি যে রকম বেনজির ভঙ্গিতে বিরোধীদের কোণঠাসা করার নীতি নিয়েছে, তার জেরেই কংগ্রেসকে এতটা বেকায়দায় পড়তে হয়েছে বলে তাঁরা মনে করছেন।
এই বেকায়দায় পড়ার ছাপটা সবচেয়ে বেশি করে অনুভূত হচ্ছে কংগ্রেসের কোষাগারে। রাজনৈতিক দল যত প্রভাবশালী হয়, তার কোষাগার ততই যে ফুলে-ফেঁপে থাকে, সে কথা বলাই বাহুল্য। স্বাভাবিক কারণেই প্রভাব কমতেই তহবিলও হালকা হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন প্রভাবশালী শিবির থেকে যে মোটা অঙ্কের চাঁদা মিলত নিয়মিত, তবহিলের সেই সব উৎস ক্রমশ শুকিয়ে গিয়েছে। ফলে লোকসভা নির্বাচনের ছ-সাত মাস আগে পৌঁছে কোষাগার নিয়ে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড বেজায় চিন্তায় বলে এআইসিসি সূত্রের খবর। দলীয় তহবিলের অবস্থা যে রকম, তাতে বিজেপির বিপুল অর্থবলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নির্বাচন লড়া প্রায় অসম্ভব বলে এআইসিসি-র সিনিয়র সদস্যদের কেউ কেউ মনে করছেন। তাই অত্যন্ত দ্রুত পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার চেষ্টা শুরু করেছে ২৪ আকবর রোড।
আরও পড়ুন: ভোটে দাঁড়াতে চান? ফেসবুকে ১৫০০০ লাইক, টুইটারে ৫০০ ফলোয়ার নিয়ে আসুন
৬ সেপ্টেম্বর ‘ওয়ার রুম’ বৈঠক ডেকেছে কংগ্রেস। এআইসিসি-র অন্যতম সাধারণ সম্পাদক অশোক গহলৌতের স্বাক্ষর করা একটি চিঠি পৌঁছেছে প্রতিটি প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে। সেখানে লেখা হয়েছে, ৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১১টায় ১৫ নম্বর গুরুদ্বার রকাবগঞ্জ রোডের অফিসে বৈঠক ডাকা হয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিগুলির সভাপতি এবং কোষাধ্যক্ষদের বৈঠকে উপস্থিত থাকতে হবে। দলীয় সংগঠনের জন্য তহবিল বা সম্পদ জোগাড়ের চেষ্টা কোন পথে করা হবে, তা নিয়েই বৈঠকে আলোচনা হবে বলে চিঠিতে লেখা হয়েছে।
শুধুমাত্র প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এবং কোষাধ্যক্ষদের নিয়ে হাইকম্যান্ড বৈঠকে বসতে চাইছে— এর অর্থ কী, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে খুব একটা দ্বিমত নেই। তাঁদের একাংশের মতে, কংগ্রেসের কোষাগারের হাল কতটা শোচনীয়, তা গহলৌতের এই চিঠি থেকেই স্পষ্ট। নির্বাচনী তহবিল জোগাড়ের হবে কোন পথে, তা খুঁজে বার করার জন্য দিল্লিতে ওয়ার রুম বৈঠক ডাকতে হচ্ছে কংগ্রেসকে— এই পরিস্থিতি খুব একটা মসৃণ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয় না বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
আরও পড়ুন: নিকাহ্ হালালা’র জন্য চাপ, শ্বশুরের ধর্ষণের শিকার হলেন উত্তরপ্রদেশের মহিলা
গহলৌতের এই চিঠি বা ৬ সেপ্টেম্বরের বৈঠকের আলোচ্য সম্পর্কে এআইসিসির কেউ আপাতত মুখ খুলছেন না। এআইসিসির অন্যতম সচিব তথা বাংলার এআইসিসি পর্যবেক্ষক গৌরব গগৈয়ের অন্যতম সহকারী বি পি সিংহ এড়িয়ে গেলেন জবাব। ৬ সেপ্টেম্বরের বৈঠকের প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, ‘‘আমি গহলৌতজির কোনও চিঠি দেখিনি। তাই বলতে পারব না।’’ কিন্তু দলের কোষাগারের হাল কেমন? অবস্থা কি খুব শোচনীয়? বি পি সিংহ বললেন, ‘‘আমি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারব না। এটা আমার এক্তিয়ারভুক্ত নয়।’’
পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসও কোনও মন্তব্য করতে চায়নি ৬ সেপ্টেম্বরের বৈঠক প্রসঙ্গে। দিল্লিতে কী নিয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছে, তা প্রদেশ কংগ্রেসের অধিকাংশ সদস্যেরই গোচরে নেই। যাঁরা জানেন, তাঁদের মুখে কুলুপ। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর রাজনৈতিক সচিব নিলয় প্রামাণিক মুখ খুললেন। তবে রেখে-ঢেকে। বললেন, ‘‘প্রদেশ সভাপতি এবং কোষাধ্যক্ষদের নিয়ে যখন বৈঠক ডাকা হয়েছে, তখন তহবিল নিয়ে কথা হতেই পারে। কিন্তু তার থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো উচিত নয় যে, কংগ্রেসের কোষাগারের হাল খারাপ।’’
তা হলে কি কংগ্রেসের কোষাগারের হাল খুব ভাল? এ প্রশ্নের জবাব মিলছে না। তবে নির্বাচনী তহবিল নিয়ে চাপা উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে।
(ভোটের খবর, জোটের খবর, নোটের খবর, লুটের খবর- দেশে যা ঘটছে তার সেরা বাছাই পেতে নজর রাখুন আমাদের দেশ বিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy