Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
National News

পাকিস্তানে কেন? দরকারে কবরে যাব, বলছেন সেই নজীবের মা

এনআরসি, সিএএ-বিরোধী স্লোগান এ বার জেএনইউয়ের ‘নিখোঁজ’ ছাত্র নজীব আহমেদের মায়ের মুখেও। তিন বছর পেরিয়ে গেল, খোঁজ নেই ছেলের।

ছেলে রোহিতের স্মরণসভায় বিধ্বস্ত রাধিকা ভেমুলাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন পায়েলের মা আবেদা তদভি। (ডান দিকে) নজীবের মা ফতিমা নাফিজ়।

ছেলে রোহিতের স্মরণসভায় বিধ্বস্ত রাধিকা ভেমুলাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন পায়েলের মা আবেদা তদভি। (ডান দিকে) নজীবের মা ফতিমা নাফিজ়।

স্নেহাংশু অধিকারী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২০ ০৩:২০
Share: Save:

‘কাগজ দেখাব না’!

এনআরসি, সিএএ-বিরোধী স্লোগান এ বার জেএনইউয়ের ‘নিখোঁজ’ ছাত্র নজীব আহমেদের মায়ের মুখেও। তিন বছর পেরিয়ে গেল, খোঁজ নেই ছেলের। হাল ছেড়েছে সিবিআই। মুখে কুলুপ প্রশাসনের। ষাটোর্ধ্ব ফতিমা নাফিজ় তবু এরই মধ্যে আরও বড় লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশের বরেলী থেকে ফোনে বললেন, ‘‘আমি তো ভালই আছি। কিন্তু কাল আমার দেশটার কী হবে? উচ্চবর্ণের হিন্দু ছাড়া বাকি সবাইকে ওরা তাড়াতে চাইছে। মুসলিমদের বলছে, পাকিস্তানে যাও। মগের মুলুক নাকি!’’ একটু থামলেন ফতিমা। তার পরে চোস্ত হিন্দির মধ্যে হঠাৎই পঞ্জাবি টান! ফাঁকে ফাঁকে উর্দুও। ‘‘কেন যাব পাকিস্তানে? যেতে হলে কবরস্থানে যাব, তবে ওই গেরুয়া গুন্ডাগুলোর কয়েকটাকে সঙ্গে নিয়েই যাব,’’ স্বর চড়ল ষাটোর্ধ্ব প্রৌঢ়ার।

২০১৬-র ১৫ অক্টোবর রাতারাতি ‘উধাও’ হয়ে যান নজীব। অভিযোগ, তার আগের দিনই এবিভিপি-র কয়েক জন তাঁকে বেধড়ক মেরেছিল। ওই বছরেরই ১৭ জানুয়ারি আত্মহত্যা করেন হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত গবেষক রোহিত ভেমুলা। অভিযোগ, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে সাত মাসের স্কলারশিপের টাকা আটকে ক্যাম্পাসে তাঁকে একঘরে করে রেখেছিল এবিভিপি-ই। সেই রোহিতের মা রাধিকা ভেমুলাও এখন বলছেন, ‘‘চার বছর অনেক সয়েছি। কিন্তু ব্যক্তিগত শোকের আর সময় কোথায়! ছেলে হারিয়েছি, কিন্তু দেশ হারাতে দেব না। গেরুয়া সন্ত্রাস দেখে আবার আমার রক্ত ফুটছে। সংবিধান তো দেশের মা, সবার অধিকার রক্ষা করে। বিজেপি যখন সেই মাকেই বারবার নিশানা করছে, তখন কি আর চুপ থাকা যায়?’’

আরও পড়ুন: শাহিন-ভিডিয়ো এ বার মেরুকরণ অস্ত্র বিজেপির

কিন্তু রাষ্ট্র এখন যদি সত্যিই কাগজ চায়? রাধিকা আম্মার জবাব, ‘‘কিসের কাগজ? আগে মোদী-শাহ প্রমাণ দিন, ওঁরা নিজেরা কোথা থেকে এসেছেন!’’ দলিত-আদিবাসী দমন, এনআরসি, সিএএ-সহ যাবতীয় ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ রুখতে ছেলের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতেই ‘মাদার্স ফর নেশন’ পদযাত্রার ডাক দিয়েছেন রোহিতের মা।

রাধিকা আম্মার ডাকেই মহারাষ্ট্রের জলগাঁও থেকে রোহিতের স্মরণসভায় গিয়েছিলেন আবেদা তদভি। পায়েলের মা। অভিযোগ, ক্যাম্পাসে জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়েই গত বছর মে মাসে আত্মঘাতী হন মুম্বইয়ের বছর ছাব্বিশের ডাক্তার পায়েল তদভি। শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যানসার, আর মনে জ্বলন্ত কন্যাশোক। তবু নাছোড় আবেদা ফোনে বললেন, ‘‘অন্যায় হলে পথে তো নামতেই হবে।’’

‘তারার দেশে’ যাওয়ার কথা বলে সুইসাইড নোট রেখে গিয়েছিলেন রোহিত। কাউকে দোষারোপ না-করেই লিখেছিলেন, ‘‘আমার জন্মটাই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা!’’ নজীবের মা বলছেন, সমাজের পক্ষে এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে? আর পায়েলের মা আবেদার দুঃখ, ‘‘অপমান সইতে সইতে মেয়েটা আমার শেষে ফোন ধরে শুধু কাঁদত।’’ পরে চার্জশিট দেখে মেয়ের ‘চোট’ বুঝেছেন আবেদা। পায়েলকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে তিন সিনিয়র ডাক্তারের বিরদ্ধে গত কাল, ২৪ জানুয়ারি চার্জ গঠন হওয়ার কথা ছিল বম্বে দায়রা আদালতে। ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা পিছিয়ে গিয়েছে। তার আগেই ৩০ বা ৩১ তারিখে দিল্লিতে ‘মাদার্স ফর নেশন’-এর প্রথম বৈঠক। আবেদা জানালেন, এই বৈঠকে থাকার কথা নির্ভয়ার মায়ের। ডাকা হয়েছে হায়দরাবাদের গণধর্ষিতা তরুণী পশু চিকিৎসকের মা, এমনকি কাঠুয়ার সেই নাবালিকার মাকেও। দেশের স্বার্থে মায়েদের পথে নামার রোডম্যাপ তৈরি হবে ওই বৈঠকেই।

তা বলে ক্যানসার-ভোগা শরীরে রাস্তায়? কাশির দমক সামলে পায়েলের মা বললেন, ‘‘ও কিছু না, একটু ঠান্ডা লেগেছে। কুড়ি দিনের সদ্যোজাতকে নিয়ে তো রাত জাগছে শাহিন বাগের মা-ও। আমরা কী করে ঘরে বসে থাকব?’’ শরীর সায় দিচ্ছে না ফতিমারও। রোহিতের স্মরণসভায় যেতে পারেননি। তবে মাঝখানে ১০ মিনিটের জন্য ঘুরে এসেছেন শাহিন বাগ। ফোনে ফতিমা বললেন, ‘‘অনেক আগে থেকেই মানুষ লোপাটের ছক কষে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। নোটবন্দি, গণপিটুনির পরে এ বার নাগরিকত্বের জুজু দেখাচ্ছে। এর জবাব দেব আমরাই।’’ রোহিতের মা বলছেন, দেশের আইন আর সংবিধান মেনেই যা হওয়ার হবে। তাঁর কথায় ‘‘সাংসদ বা বিধায়ক যখন নই, তখন পথে নেমেই মুখ খুলতে হবে।’’

সিএএ, এনআরসি নিয়ে কথায়-কথায় ফতিমা ফিরে গেলেন বিরানব্বইয়ে। সেই যে-বছর তিনি প্রথম এবং শেষ বার পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। এখন ‘পাকিস্তান’ শুনলেই চিড়বিড় করছেন নজীবের মা। আর সরাসরি বিঁধছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। ফোন রাখার আগে ফের পঞ্জাবি, উর্দু মিশিয়ে বললেন, ‘‘তিন তালাক রদের সময় তো তো খুব ‘বহেন, বহেন’ করতেন! এখন দিল্লির শাহিন বাগ, কলকাতার পার্ক সার্কাসে খোলা আকাশের নীচে শীতের রাতে কুঁকড়ে বসে থাকা মেয়েগুলোর কথা মনে হচ্ছে না? ক্ষমতা থাকলে সরাসরি বেইমান বলুন। পথে নামলে জেলে পাঠান। হম ভি দেখেঙ্গে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE