মুম্বই হামলার অন্যতম চক্রী জাকিউর রহমান লকভিকে আপাতত জেলেই আটকে রাখছে পাকিস্তান।
গত কাল ইসলামাবাদ হাইকোর্ট লকভিকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিলেও সেই সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে কিছু সমস্যা হওয়ায় তাকে ছাড়তে চাননি জেল-কর্তৃপক্ষ। আজ পাক প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে আপাতত জেলেই আটকে রাখা হবে। কারণ লকভি মুক্তি পেলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় পঞ্জাব প্রশাসন এক নির্দেশিকায় জানিয়েছে, আগামী এক মাস লকভিকে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা জেলে রাখা হবে। ওই সিদ্ধান্তে স্বস্তি জানিয়েছে ভারত। অন্য দিকে পঞ্জাব প্রশাসনের ওই সিদ্ধান্তকে ‘সংবিধানের অবমাননা’ আখ্যা দিয়ে আগামী সপ্তাহে ফের আদালতের দ্বারস্থ হতে চলেছেন লকভির আইনজীবীরা। তাঁদের আশা, প্রথম শুনানিতেই পঞ্জাব প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে খারিজ করে দেবে আদালত।
চার মাস আগে মুম্বই হামলার অন্যতম এই ষড়যন্ত্রকারীকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দিয়েছিল পাকিস্তানের একটি সন্ত্রাস-বিরোধী আদালত। আর গতকাল লকভিকে বিনা শর্তে মুক্তির নির্দেশ দেয় ইসলামাবাদ হাইকোর্ট। ওই সিদ্ধান্ত জানার পরেই তীব্র প্রতিবাদ জানায় ভারত। এ দেশে নিযুক্ত পাক হাই কমিশনার আব্দুল বাসিতকে ডেকে পাঠিয়ে দিল্লির ক্ষোভের কথা জানিয়ে দেন ভারপ্রাপ্ত বিদেশসচিব অনিল ওয়াধওয়া। কিন্তু ভারতের এই উদ্বেগকে গুরুত্ব না দিয়ে পাল্টা চাল হিসেবে ইসলামাবাদে ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার জে পি সিংহকে ডেকে পাকিস্তান জানায়, লকভির মুক্তি নিয়ে অনর্থক শোরগোল তুলছে দিল্লি। ভারতের আপত্তিকে পাত্তা না দিয়ে পাক প্রশাসনের তরফে উল্টে বার্তা দেওয়া হয়, লকভির মুক্তি নিয়ে আদালতের নির্দেশ মানতে বাধ্য সরকার।
কিন্তু কী এমন হল যে, এক দিনের মধ্যে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হল ইসলামাবাদ?
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্র বলছে, ভারতের মতোই লকভি নিয়ে পাক প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ওয়াশিংটনও। মূলত তাদের চাপেই আজ লকভির মুক্তি আটকে যায়। গতকাল লকভির মুক্তির বিষয়টি সামনে আসার পরেই ওবামা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নওয়াজ শরিফের সরকারকে বার্তা দেওয়া হয়। মুম্বই হামলার চক্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি পাকিস্তান দিয়েছে, তা যেন তারা পালন করে। আমেরিকার কড়া বার্তার পরেই লকভিকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত বদল করা হয়।
এর আগে লকভিকে জামিন দেওয়ার পিছনে পাক আদালতের যুক্তি ছিল, তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ নেই। যদিও ভারত বা মার্কিন তদন্ত সংস্থাগুলির বক্তব্য, আসলে পাক আদালতে লকভির বিরুদ্ধে ভুরি ভুরি প্রমাণ জমাই দেয়নি পাক সরকার! মুম্বই হামলা নিয়ে পাক প্রশাসন যে রকম ঢিলেঢালা ভাবে তদন্ত করছে, তাতে লকভি দ্রুত ছাড়া পেয়ে যাবে বলেই আশঙ্কা দিল্লির। ভারতের দাবি, লকভির বিরুদ্ধে বিপুল প্রমাণ জমা দিয়েছিল খোদ পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিও। তাদের চার্জশিটে মুম্বই হামলার পিছনে লকভিকেই অন্যতম দোষী হিসেবে দেখানো হয়েছে। ওই হামলা নিয়ে ভারত যে ডশিয়ারটি পাকিস্তানকে দিয়েছিল, তাতে মুম্বই হামলায় একমাত্র জীবিত জঙ্গি আজমল কাসভের স্বীকারোক্তিতে একাধিক বার লকভির প্রভাবের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া মুম্বই হামলার আর এক চক্রী ডেভিড হেডলির সঙ্গে লকভির কথাবার্তার একাধিক প্রমাণও দেওয়া হয়েছে ওই ডশিয়ের-এ। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে ভাবে লকভির বিরুদ্ধে মামলা সাজানো হচ্ছে, তা আইএসআই-মোলাতন্ত্র ও পাক প্রশাসনের একাংশের নির্দেশে হচ্ছে বলে মনে করছে ভারত।
এই সব কারণে দীর্ঘ দিন ধরে লকভি ও আর এক জঙ্গি নেতা হাফিজ সইদকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য দাবি করে আসছে দিল্লি। খোদ রাষ্ট্রপুঞ্জও লস্কর-ই-তৈবার অন্যতম মাথা লকভিকে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের মতে, ২০০৯ থেকে জেলে থাকলেও ভারত ও আমেরিকা বিরোধী জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে লকভির কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না! কারণ পাক সেনা, আইএসআই ও প্রশাসনের একটা অংশ এ কাজে তাকে সাহায্য করছে। তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে হাফিজ সইদেরও।
এই পরিস্থিতিতে লকভির মুক্তির নির্দেশ চিন্তায় ফেলে দেয় ওয়াশিংটনকে। ভারতের মতো তারাও নওয়াজ প্রশাসনকে বার্তা পাঠায়, লকভিকে ছাড়া হলে গোটা উপমহাদেশে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বেড়ে যাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ব্যাখ্যা, মুম্বই হামলায় একাধিক মার্কিন নাগরিকও মারা গিয়েছিলেন। সে কথা মাথায় রেখেই লকভি এ ভাবে ছাড়া পাক, তা চাইছে না ওবামা প্রশাসন। সেই কারণেই গত কাল কড়া বার্তা দিয়েছিল তারা।
মূলত মার্কিন প্রশাসনের ওই কড়া বার্তা আসতেই নড়েচড়ে বসে ইসলামাবাদ। তার পরেই আজ সকালে জানানো হয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে লকভিকে আগামী এক মাস জেলে আটক করে রাখা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy