ঘটনাটা সপ্তাহ খানেক আগের। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সামনে এসেছে দিন কয়েক আগে। তার পর থেকে মনে হচ্ছে, অভিধানে একটু অদলবদল দরকার। দু’টো শব্দের অর্থ সাংঘাতিক গুলিয়ে গিয়েছে যেন— মানবিক আর পাশবিক।
বর্বরোচিত, নৃশংস, হিংস্র কোনও বিষয়কে বিশেষিত করতে চট করে ‘পাশবিক’ শব্দটা ব্যবহার করে ফেলি আমরা অনেকেই। এই ব্যবহার কতটা সঙ্গত, তা নিয়ে প্রশ্ন আগেও ছিল। কিছুটা মৃদু হয়তো। এ বার প্রশ্নটা ভীষণ জোরালো হয়ে উঠল।
পশুর মতো আচরণকে যদি পাশবিক বলা হয়, তা হলে পাশবিকতা বোধ হয় মানুষের মতো আচরণ বা মানবিকতার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ভাল। পশুর হিংস্রতার কারণ খুঁজে পাই। জীবন সংগ্রামের প্রয়োজনে হিংস্রতা, নৃশংসতার দাস পশু। কিন্তু সভ্য মানুষ কী করে পাঁচতলা বাড়ির উপর থেকে অকারণে একটি নিরীহ পশুকে নীচে ফেলে দিতে পারে এবং সেই পতনের দৃশ্য রেকর্ড করে রাখতে পারে? কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না!
তামিলনাড়ুর দুই ডাক্তারি পড়ুয়া এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। কলেজ ক্যাম্পাসে বেওয়ারিশ ঘুরে বেড়ানো একটা কুকুরকে কাছে ডেকে ভাব জমিয়েছেন। তার পর ছাদে নিয়ে গিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছেন। কুকুরটির সেই অসহায় পতনের মর্মান্তিক দৃশ্য রেকর্ড করে রেখেছেন। মাঝে-মধ্যে রেকর্ডিং দেখে নৃশংস অনন্দ পাওয়ার আকাঙ্খাতেই নিশ্চয়ই!
এঁদের মানুষ বলে ডাকতে হলে, মানবিকতার আভিধানিক অর্থ কী দাঁড়াবে? ব্যতিক্রমী, বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিতে পারছি না নিজের উদ্বেগ। আপাতদৃষ্টিতে এঁরা শুধু সভ্য মানুষ নন, সভ্যতার উপত্যকায় সবচেয়ে আলোকপ্রাপ্ত যে সব শ্রেণি, তারই অংশ। ডাক্তারির ছাত্র এঁরা। এঁদের আচরণে সর্বোচ্চ স্তরের সংবেদনশীলতা কাম্য। মানুষের জীবন-মৃত্যুর মাঝে যে সীমান্ত, সেই সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে থাকার কথা এঁদের। প্রতিটা প্রাণকে নিজেদের সামগ্রিক অস্তিত্ব দিয়ে আগলে রাখার কথা এঁদের। তার বদলে দেখলাম এই প্রচণ্ড মর্ষকাম! একটি নিরীহ প্রাণকে প্রায় মৃত্যুর মুখে ছেড়ে দিয়ে তার অসহায়তার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করা!
চিকিৎসক হওয়ার কোনও অধিকার কি আর রইল এই দু’জনের? এঁরা কখনও চিকিৎসক হয়ে উঠলে কোনও রোগীর পক্ষে নিজের জীবনের ভার এঁদের উপর ছেড়ে দিয়ে কি নিশ্চিন্ত হওয়া সম্ভব হবে? নাকি তা উচিত হবে?
আবার বলছি, এই ঘটনাকে চেন্নাইয়ের ‘ছোট্ট’ একটা ঘটনা অথবা বিচ্ছিন্ন কোনও মানসিকতা ভেবে নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। এমন অসংখ্য ‘বিচ্ছিন্ন’ মানসিকতার নমুনা গত কয়েকদিন ধরে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে বিপুল রক্ত ঝরাল। গোটা সভ্যতাই যদি এমন অগণিত ‘বিচ্ছিন্ন’ মানসিকতায় ভরে উঠতে থাকে, তা হলে সভ্যতা বিপন্ন হবেই।
একটা ‘পাশবিক’ আচরণের কথা বলে ইতি টানি।
জখম অবস্থায় পড়ে থাকা প্রাণীটিকে উদ্ধার করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন অন্য কয়েক জন মানুষই। ‘মানুষ’-এর হাতে আক্রান্ত প্রাণীটি আর কয়েক জন মানুষকে দেখে কোনও প্রতিরোধ বা আক্রমণের চেষ্টা করেনি। নিশ্চিন্তে সঁপে দিয়েছে নিজেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy