—ছবি এএফপি।
বিজিবি’র লঞ্চটা চরের কাছাকাছি ঘেঁষতেই এ পারের ঘাটে একটা ব্যস্ততা ছড়াল। শেষ শীতের হলদেটে ঘাসে ফের এক বার চুনের গুঁড়ো ছড়ানোর ফাঁকে ইসমাইল শেখ বিড় বিড় করে, ‘‘কদ্দিন পরে গো!’’
পদ্মা পাড়ের দেশ উজিয়ে জংলা পোশাক পরা বিজিবি জওয়ানেরা ঝুপঝাপ লাফিয়ে ঘাটে নামতেই বিএসএফের কমান্ড্যান্ট এগিয়ে গিয়ে ছিলেন, ‘আইয়ে ভাই আইয়ে...’ ও-পারের ক্যাপ্টেন এক গাল হাসি নিয়ে বুকে বুক মেলাতেই ঢালু মাঠের উপর থেকে বিউগল বেজে ওঠে। দীঘল হরফে ‘রিপাবলিক ডে’, পদ্মার কোল থেকে উড়ে আসা হিমহিম হাওয়ায় সবুজ-সাদা লম্বা ফেস্টুন ফড়ফড় করে ওড়ে। আজ প্রজাতন্ত্র বিকেলে দু’বাংলার ভলিবল।
টানটান চেয়ার পড়েছে চরে। শামিয়ানার নীচে লম্বাটে টেবিলের উপরে সোনালি রোদ্দুরে রুপোলি কাপ। আখরিগঞ্জের বাজার থেকে জল ছেটানো গোলাপ-গ্ল্যাডুলাস। অথৈ পদ্মাকে মুখ ভেংচে মিনারেল জলের বেঁটে বোতল। ইসমাইল বলে, ‘‘পদ্মা পাড়েও পানির পয়োজন হয় রে, এও দেখতি হইল!’’
চরের খোলে নদী ছলাৎ ছলাৎ ছেনালি করে। আবছা বিকেল নামছে ও-পাড়ের চরে। কলাইয়ের খেত। নির্মল চর গুমরে মরে, ‘একটা দানাও তুলতে পারি কই, সব বাংলাদেশিরা লইয়া যায়।’ তা যাক, এই সব দিনে ইসমাইলের অন্তরে এখনও যেন মোচড় দিয়ে ওঠে গোদাগাড়ি ঘাটে লঞ্চের হাঁকাড়ি— ‘দেরি নাই, দেরি নাই...ছাইর্যা দিল ঢাকা-রংপুর’।
আজ উনিশ বছর হল। এমনই এক ২৬ জানুয়ারি রাতে, নিঃসারে পদ্মা ভেঙে এ পাড়ে চলে আসা ইসমাইল এখনও মনে মনে পড়ে আছে সেই বাণীপুরের মাঠে। ইসমাইল বলছেন, ‘‘এক দুপুরে সব শ্যাস হইয়্যা গেসিল।’’ স্ত্রী-তিন তিনটে ছেলে আর বছর তিনেকের মেয়েকে নিয়ে পদ্মার খাল ভেঙে এনায়েৎপুরে এক ‘সম্বন্ধী’র বাড়ি পাড়ি দিয়েছিল ইসমাইল। শীতের ভরা নদীতে সে দুপুরে ভরভরন্ত মানুষ। ইসমাইল বলে, ‘‘সাঁতরে পাড়ে উঠে দেখি থইথই নদী, বিবি-বাচ্চাগুলারে সব গিল্যা খাইস্যে!’’ বাণীপুরে আর থাকতে পারেননি ইসমাইল। বিড় বিড় করেন, ‘‘পরাণডা কেমন ছেঁড়াখুঁড়া হইয়া গ্যাসিল’’। সেই মাঠ-বাড়ি-গোয়াল যেন গিলে খেতে আসছে তাকে। তার পর? ইসমাইল বলে, ‘‘তার পর আর কি, পলায়ন। প্রজাতন্ত্র দিবসে সীমান্ত খানিক খোলা থাকে। পদ্মায় ডিঙা ভাসিয়ে চুপি চুপি আইলাম এ দ্যাশে।’’
তবু প্রজাতন্ত্র দিবসের দুপুরে এখনও তাঁকে তাড়া করে সেই নদী, মেয়ের মুখ আর ডুবন্ত এক নৌকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy