নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
প্রায় পাঁচ বছর আগে বিজেপি স্লোগান তুলেছিল ‘ঘর-ঘর মোদী’। বিরোধীরা বলছেন, মেয়াদ ফুরোনোর মুখে ষোলো কলা পূর্ণ হল তার। কাল রাতে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে মোদী সরকার, যাতে বলা হয়েছে— ‘দেশদ্রোহী’ সন্দেহে যে কোনও ল্যাপটপ, কম্পিউটারে আড়ি পাততে পারবে আইবি থেকে দিল্লি পুলিশ। দেখে নিতে পারবে আমজনতার কম্পিউটারের সব তথ্য। জাতীয় নিরাপত্তার ছুতোয় আসলে যা ব্যক্তিপরিসরে হস্তক্ষেপ— দাবি বিরোধীদের।
গত রাতের বিজ্ঞপ্তিতে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৬৯ ধারায় বলা হয়েছে, ১০টি তদন্তকারী সংস্থা প্রয়োজনে যে কোনও কম্পিউটারে আড়ি পাততে বা নজরদারি করতে পারবে। যে কোনও কম্পিউটারে থাকা সব তথ্য ডিক্রিপ্ট বা পাঠোদ্ধারের অধিকার থাকবে সংস্থাগুলির কাছে। বিজ্ঞপ্তিতে আলাদা করে মোবাইলের কথা বলা না হলেও, মন্ত্রক জানিয়েছে— স্মার্টফোনগুলি কার্যত কম্পিউটার হওয়ায় নজরদারির আওতায় থাকবে সেগুলিও। বিরোধীরা বলছেন, ভোটের ঠিক আগে শোয়ার ঘরেও আড়ি পাতা শুরু করল মোদী সরকার। যা হয়ে থাকে উত্তর কোরিয়ার মতো দেশে। যদিও পাল্টা যুক্তি দিয়ে কেন্দ্র জানিয়েছে, এই আইন নতুন নয়। কোন সংস্থা নজরদারি ও তদন্ত করতে পারবে, মোদী সরকার কেবল তা স্পষ্ট করে দিয়েছে মাত্র।
এর পরেই মোদীকে ভীত একনায়ক বলে আজ আক্রমণ করেছেন রাহুল গাঁধী। পাঁচ রাজ্যে ভোটের পরে উজ্জীবিত বিরোধীদের আজ সংসদের বাইরে ও ভিতরে ফের একজোট করে দেয় ওই বিজ্ঞপ্তি। বিরোধীদের মতে, এত দিন যা নিয়মের বেড়াজাল রেখে সরকার আড়ালে-আবডালে করত, ভোট বাজারে সেটাই তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে করতে খোলা ছুট দেওয়া হল। ওই বিজ্ঞপ্তির ফলে লোকসভা ভোটের ঠিক চার মাস আগে আমনাগরিক থেকে বিরোধী— সকলের উপরই বেলাগাম নজরদারি করতে পারবেন মোদী সরকার। রাহুল বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী আসলে যে ভীত একনায়ক, তা দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল।’’
আরও পড়ুন: পেঁয়াজের দাম জোটে না, চাষির জোটে দড়ি
সংসদে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হওয়ায় গুজরাত থেকে মুখ খোলেন অমিত শাহ। রাহুলকে আক্রমণ শানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘মানুষকে ভয় দেখিয়ে জাতীয় সুরক্ষা নিয়ে ফের এক বার রাজনীতি করছেন রাহুল।’’ অন্য দিকে সংসদে সরকারের হয়ে নামেন সেনাপতি অরুণ জেটলি। রাজ্যসভায় সম্মিলিত বিরোধী আক্রমণের মুখে জেটলির সাফাই, ‘‘এটি কোনও নতুন সিদ্ধান্ত নয়। ২০০৯ সালে ইউপিএ-র সিদ্ধান্ত এটি। কারা নজরদারি করবে, আমরা কেবল সেটি চিহ্নিত করে দিয়েছি।’’
মন্ত্রী মুখে ওই দাবি করলেও, সরকারি নির্দেশ কিন্তু তা বলছে না। ইউপিএ জমানায় কারওর উপরে নজরদারি করার প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রসচিব বা নিদেনপক্ষে যুগ্ম সচিব বা আইজি পর্যায়ের অফিসারের অনুমতি লাগত। কিন্তু গত কালের জারি হওয়া বিজ্ঞপ্তিতে এ নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি। বিরোধীদের বক্তব্য, এর সুযোগে সন্দেহ হলেই যে কোনও ব্যক্তির মোবাইল বা কম্পিউটারে নজরদারি করতে পারবে সরকার। কারও অনুমতির প্রয়োজন হবে না। বিরোধী শিবিরের মনোবল নষ্ট করতে ওই আইনের অপব্যবহার হবে বলেও আশঙ্কা বিরোধীদের। আর সেই প্রশ্নেই সরকারকে চেপে ধরেছেন এসপি, তৃণমূল, কংগ্রেস, আরজেডি, আপ। যদিও আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ পরে যুক্তি দেন, ‘‘এ ক্ষেত্রেও নজরদারি চালাতে গেলে স্বরাষ্ট্রসচিবের অনুমতি প্রয়োজন হবে।’’ তবে তা কেন বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ নেই, তার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি প্রসাদ। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও জানায়, ‘প্রত্যেকটি নজরদারির ঘটনাই স্বরাষ্ট্রসচিব বা রাজ্য সরকারের অনুমতি সাপেক্ষ।’ কিন্তু তাতে বিতর্ক থামছে কই!
স্বভাবতই উঠে এসেছে ব্যক্তিপরিসরের অধিকারের বিষয়টিও। বিরোধীদের বক্তব্য, কিছু দিন আগেই আধার কার্ড নিয়ে মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল ব্যক্তিপরিসরের অধিকার জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এক জন মানুষ কী খাবেন বা কার সঙ্গে মেলামেশা করবেন তা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রের নেই। সেই সূত্র ধরেই তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়ের বক্তব্য, ‘‘ইন্টারনেট-স্মার্টফোন, ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপের তথ্য আদানপ্রদান সরকারি নজরদারির আওতায় আসার অর্থই হল সেই ব্যক্তিপরিসরে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ।’’
সকালে দ্রুত লোকসভা মুলতুবি হয়ে যাওয়ায় রাজ্যসভায় সরকারকে চেপে ধরেন বিরোধীরা। পাল্টা জবাবে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ দেখিয়ে প্রকারান্তরে বিরোধীদের মনোভাব নিয়েই প্রশ্ন তোলেন জেটলি। ক্ষুব্ধ কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদের বক্তব্য, ‘‘প্রশ্ন তুললেই সরকারের চোখে বিরোধীরা দেশ-বিরোধী হয়ে যান। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক-রাফাল আর এখন নজরদারি-প্রশ্ন তুললেই বিরোধীরা দেশদ্রোহী!’’
শীতের ছুটির পরেই সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন-এর মতো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি। আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহদের মতে, ওই বিজ্ঞপ্তি জারি করে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ লঙ্ঘন করেছে সরকার। প্রবীণ আইনজীবী বিশ্বজিৎ দেব বলেন, ‘‘৬৬-এ ধারা খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে ব্যক্তিপরিসরের স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার। আর আইটি আইনের ৬৯-এ ধারায় বলা হয়েছে, কারওর উপর নজরদারি করতে হলে নির্দিষ্ট কারণ দেখাতে হবে। তা না হলে এটি আইন ও সংবিধান বিরোধী।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy