ত্রয়ী: দেবাংশ, তরুল ও জিতিন (বাঁ দিক থেকে)
চতুর্থ শ্রেণিতেই শেখ আনসার আহমেদের বাবা ছেলেকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অটো চালিয়ে সংসার টানা মুশকিল। আনসারও অন্য ভাইদের মতো কাজ ধরলে সংসারে দু’টো বাড়তি পয়সা আসবে।
লেখাপড়ায় চৌকস আনসারের স্কুলের শিক্ষকরা আপত্তি তোলেন। মহারাষ্ট্রের শেলগাঁও-এর সেই আনসার এখন পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের আইএএস। আপাতত দিল্লিতে শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রকের সহকারী সচিব। আগামী মাসে কলকাতায় গিয়ে রাজ্য সরকারের কাজে যোগ দেবেন।
ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা পড়তে অসুবিধা হত কর্নাটকে টুমকুরুর কেম্পা হোন্নাইয়া-র। নিরক্ষর বাবা-মা চিকিৎসা করানোর আগেই, ন’বছর বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারান কেম্পা। এক কাকা দৃষ্টিহীনদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। ইউপিএসসি পরীক্ষার সময় স্ত্রী অচিন্থা দিনে দশ ঘণ্টা করে বই পড়ে শোনাতেন, অডিও নোট তৈরি করতেন। কেম্পাও এখন পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের আইএএস। ভোলেননি, কী ভাবে মা সরকারি অফিসের দরজায় ঘুরে ছেলের প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট জোগাড় করেছিলেন।
তরুণ আইএএস-দের মূল মন্ত্র এটাই: হাল ছেড়ো না। আইএএস-পরীক্ষার্থীদের সেই বার্তা দিতেই কর্মরত আমলারা নিজেদের ব্যক্তিগত লড়াইয়ের গল্প বলতে শুরু করেছেন। সাড়া পড়ে গিয়েছে আমলা মহলে।
গল্পের সূত্রধরের দায়িত্ব নিয়েছেন তিন নবীন আইএএস— দেবাংশ যাদব, তরুল রভীশ ও জিতিন যাদব। মুসৌরির লালবাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে চাকরিতে যোগ দেওয়া তিন তরুণ-তরুণী গত জুনে তৈরি করেছেন ফেসবুক পেজ ‘হিউম্যানস অব এলবিএসএনএএ’। ‘লাইক’২৭ হাজার ছাড়িয়েছে।
ভাবনাটা আসে দিল্লিতে ২৮ বছরের বরুণ চন্দ্রনের আত্মহত্যার পর। দেরি করে পৌঁছনোয় ইউপিএসসি পরীক্ষায় বসতে পারেননি বরুণ। ফিরে এসে আত্মহত্যা করেন। এক সময় জিতিনরাও দিল্লির রাজেন্দ্র নগরে বাড়ি ভাড়া করে থেকে, ইউপিএসসি-র প্রস্তুতি নিতেন। দেবাংশ-জিতিনরা ভাবেন, কিছু একটা করা দরকার।
পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের আইএএস জিতিন বলেন, ‘‘আমরা সবাই ভাবি, এত পরিশ্রম করছি। তার পরেও সফল না হলে জীবনটাই ব্যর্থ। কিন্তু আমাদের থেকেও অনেকে অনেক বেশি কষ্ট করেন, সেটা বোঝা দরকার।’’ হিসেব বলে, প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লক্ষ ছেলেমেয়ে আইএএস-এর পরীক্ষায় বসেন। উতরোতে পারেন হাজার খানেক। জিতিন বলেন, ‘‘সফলের থেকে ব্যর্থদের সংখ্যা যে বেশি, সেটাও জানা দরকার।’’ প্রথম দিকে চ্যালেঞ্জ ছিল, বন্ধু-সহকর্মীদের ব্যক্তিগত কাহিনি বলতে রাজি করানো। এখন অনেকে রাজি হচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গের ধীমান বড়াই যেমন। এমবিএ পড়ার সময়েই জানতে পারেন, বাবা ক্যানসারে আক্রান্ত। ১০ লক্ষ টাকার দেনা শোধ করতে মুম্বইয়ের ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়েছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পরে কলকাতায় দু’এক মাসের জন্য পোস্টিং চান। বস উত্তরে বলেন, সমস্যা মিটেই গিয়েছে। আবার ছুটি কিসের? সেই সপ্তাহেই চাকরি ছাড়েন ধীমান। শুরু করেন আইএএস-এর প্রস্তুতি।
প্রবীণ আমলারা জিতিনদের পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। কিন্তু ধীমানের মতো ২০১৬-র ব্যাচের জিতিনও আগামী মাসে কলকাতায় গিয়ে কাজে যোগ দেবেন। ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। তাই পরের ব্যাচের আইএএস-দের হাতে গল্প বলার দায়িত্ব তুলে দিতে চান তাঁরা। নটে গাছ এখনও যে মুড়োয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy