অস্তাচলে লৌহপুরুষ?
ষোড়শ লোকসভায় গত পাঁচ বছরে সব ক’টি অধিবেশন মিলিয়ে মোট ৩৬৫টি শব্দ উচ্চারণ করেছেন বিজেপির ‘লৌহপুরুষ’। আর এই ৩৬৫টি শব্দই তিনি বলেছেন ২০১৪ সালে। তার পর লোকসভায় একেবারেই নীরব আডবাণী। ষোড়শ লোকসভার বিভিন্ন অধিবেশনের রেকর্ড ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, বিতর্ক, আলোচনা, প্রশ্নোত্তর, সব কিছু থাকলেও নেই শুধু আডবাণী। এই নীরবতার জন্য অবশ্য বয়স বা শারীরিক অসুস্থতাকে দায়ী করা যাচ্ছে না, কারণ ৯১ বছর বয়সেও লোকসভার আডবাণীর উপস্থিতি অবাক করে দেওয়ার মতো। বরাবরের মতোই সংসদকে নিজের কর্মজীবনের অঙ্গ করে নেওয়া আডবাণীর এই লোকসভাতে উপস্থিতির হার ৯২ শতাংশেরও বেশি, যা অধিকাংশ মন্ত্রী, শাসক এবং বিরোধী দলের সাংসদের কাছে একই সঙ্গে ঈর্ষা এবং লজ্জার বিষয়। ইন্ডিয়া টুডে-তে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট এবং লোকসভার বিভিন্ন অধিবেশনের নথি থেকে পাওয়া গেল আডবাণীর এই অবাক করে দেওয়া নৈঃশব্দের রেকর্ড।
গত কয়েক দশক ধরেই লোকসভায় আডবাণীর উপস্থিতি এক কথায় দাপুটে। শাসক দলে থাকুন বা বিরোধী দলে, আডবাণীর সরব উপস্থিতি দশকের পর দশক চাক্ষুষ করেছে সারা দেশ। যখন অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী, তখন বিরোধীদের আক্রমণ ভোঁতা করতে শাসক দলের মূল কাণ্ডারি ছিলেন তিনিই। আবার যখন ইউপিএ ক্ষমতায় আর প্রধানমন্ত্রিত্বে মনমোহন, তখন শাসক দলকে নাকাল করতে বিরোধী শিবিরের মূল সেনাপতি ছিলেন তিনিই। ২০১৩ সালেও একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে কংগ্রেস শিবিরকে সংসদে কার্যত কোণঠাসা করে দিয়েছিল আডবাণী ব্রিগেড। পঞ্চদশ লোকসভার সেই উজ্জ্বল উপস্থিতির পরই ষোড়শ লোকসভায় আডবাণীর এই হঠাৎ নৈঃশব্দ শুধু বিজেপি নয়, ভারতীয় সংসদের কাছেও বোধহয় ‘অস্বস্তিকর’।
এই লোকসভার আগে বিভিন্ন অধিবেশনে কতটা সরব ছিলেন আডবাণী? লোকসভার নথি ঘাঁটলে সামনে আসছে সেই তথ্য। উদাহরণ হিসেবে নজর রাখা শুধু একটা দিনে, ২০১২ সালের ৮ অগস্ট। অসমে হিংসা এবং অনুপ্রবেশ নিয়ে তখন উত্তাল সংসদ। লোকসভায় সে দিন মুলতুবি প্রস্তাব আনতে চাইছিল বিরোধী শিবির, আর তার নেতৃত্বে ছিলেন আডবাণীই। সেদিন তাঁকে বাধা দিতে ইউপিএ শিবিরের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। লোকসভার নথি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, সেই দিন ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে তাঁকে মোট ৫০ বার বাধা দিয়েছিলেন শাসক দলের সাংসদেরা, কিন্তু কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি আডবাণীর সামনে। শুধু একটি বিতর্কে সেদিন আডবাণী মোট পাঁচ হাজার শব্দের বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: সেনা অভ্যুত্থানের অভিযোগ ভুয়ো, সব কংগ্রেসের ষড়যন্ত্র, তদন্ত চেয়ে মোদীর দ্বারস্থ ভিকে সিংহ
ঠিক সাত বছর পর নাগরিকত্ব বিল নিয়ে ফের উত্তাল অসম-সহ দেশের উত্তরপূর্ব, ফের উত্তাল হল সংসদ। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিল নিয়ে যখন লোকসভায় বিতর্ক তুঙ্গে, তখন ট্রেজারি বেঞ্চে হাজির আডবাণীও। কিন্তু বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা সত্ত্বেও তাঁর মুখ থেকে বেরোয়নি একটিও শব্দ।
সংসদে আগুন ঝরানো বক্তব্য রাখাই আডবাণীর রাজনীতির বরাবরের স্টাইল। শ্লেষ, কটাক্ষ, রসিকতা এবং যুক্তিতে সাজানো বক্তৃতায় বিরোধী পক্ষকে আক্রমণ শানাতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। লোকসভার পুরনো রেকর্ড ঘাঁটলেও সামনে আসছে সেই সরব উপস্থিতির কথাই। দেখা যাচ্ছে, ২০০৯ থেকে ২০১৪, এই পাঁচ বছরে মোট ৪২টি বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন আডবাণী আর উচ্চারণ করেছিলেন প্রায় ৩৬ হাজার শব্দ। বর্তমান লোকসভার থেকে যা প্রায় একশো গুণ বেশি।
আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্য জুড়ে হাতির মূর্তি, মায়াবতীকে টাকা ফেরতের নির্দেশ!
লৌহপুরুষের আর কিছু বলার নেই বা তাঁর বয়স হয়ে গিয়েছে বা তিনি শারীরিক ভাবে অসুস্থ, এই অজুহাত বোধ হয় ধোপে টেকে না । কারণ, নিজের আত্মজীবনী ‘আমার দেশ, আমার জীবন’-এ প্রায় হাজার পৃষ্ঠার বেশি লিখেছেন তিনি, যা থেকে স্পষ্ট, এখনও অনেক কিছু বলার আছে আডবাণীর। লোকসভায় তাঁর উপস্থিতি থেকেও পরিষ্কার, বয়সের কারণে তিনি চুপ হয়ে আছেন, এই বক্তব্যও সঠিক নয়। ২০১৪-২০১৯, এই পাঁচ বছরে ১৬টি অধিবেশনে মোট ৩২১ দিন বসেছিল লোকসভা। তার মধ্যে ২৯৬ দিন হাজির ছিলেন আডবাণী। সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে ৯২.২ শতাংশ, যা যে কোনও সাংসদের কাছেই রীতিমতো ঈর্ষাজনক।
আরও পড়ুন: প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের নোট ‘ফাঁস’, রাফাল নিয়ে ফের সরব রাহুল, পাল্টা তোপ সীতারামনের
এই লোকসভাতেই পাঁচ বছরে মাত্র পাঁচ বারের জন্য মুখ খুলতে দেখা গিয়েছে আডবাণীকে। এই পাঁচ বারের মধ্যে তিনি দু’বার মুখ খুলেছিলেন লোকসভার স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের সময়। শুধু বলেছিলেন, ‘‘আমি এই প্রস্তাব সমর্থন করি।’’ অন্য দু’বার তিনি কথা বলেছিলেন দু’টি সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়ার সময়, যে কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন তিনিই। দু’বারই রিপোর্টের নাম উল্লেখ করে তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘‘আমি সংসদে এই রিপোর্ট জমা দিচ্ছি।’’ শেষ বারের মতো তিনি সংসদে কথা বলেছিলেন কাশ্মীর নিয়ে একটি আলোচনার সময়। সেই আলোচনাতেও তিনি একটি পুরনো রিপোর্টের কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েই চুপ করে গিয়েছিলেন।
অথচ চিরকাল বিষয়টা এরকম ছিল না। এগারো বারের সাংসদ, বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং এই মুহূর্তে বিজেপির সব থেকে অভিজ্ঞ নেতার জীবনে সংসদ সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। ১৯৯৮-২০০৪, এই সময়কালে তিনি ছিলেন এনডিএ সরকারের দু’নম্বর ব্যক্তি, এর পর মনমোহন জমানাতেও বেশির ভাগ সময়টাই তিনি ছিলেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা। শাসক বা বিরোধী, যে আসনেই তিনি বসুন, লোকসভায় বরাবরই উজ্জ্বল ছিল তাঁর উপস্থিতি। লোকসভার রেকর্ড বুক জানাচ্ছে, গত ২১ বছরে তিনি সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০টি বিতর্ক বা আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। তার মধ্যে মাত্র পাঁচটি বর্তমান লোকসভায়, সংখ্যার হিসেবে যা ১.৬ শতাংশ।
কিন্তু কেন নীরব হয়ে গেলেন বিজেপির বহু যুদ্ধের সেনাপতি লালকৃষ্ণ আডবাণী। দীর্ঘ দিনের লড়াইয়ের পর তাঁর দল এখন সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে। বিজোপির এখন প্রশ্নাতীত সংখ্যাগরিষ্ঠতা লোকসভায়। সেই সোনার সময়েই নীরব হয়ে গেলেন লৌহপুরুষ?
সেই প্রশ্নের উত্তর খুজতেই আজকের সোশ্যাল মিডিয়ায় কতটা উপস্থিত আডবাণী এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার শুরু। বিজেপির ফেসবুক পোস্টে ২০১৯ সালে এক বারের জন্যও আডবাণীর নামোল্লেখ নেই। ২০১৮ সালে মাত্র দু’বারের জন্য তাঁর নাম উল্লেখ করেছে বিজেপি। সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও তাঁর এই হারিয়ে যাওয়ার শুরু ২০১৪ সাল থেকেই। ২০১১ সালে সংখ্যাটা ছিল পঁচিশ, ২০১২ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় একুশে। ২০১৩ সালে মোট ৪৩ বার আডবাণীর নামোল্লেখ করা হয়েছিল বিজেপির ফেসবুক পোস্টে। ২০১৪ সালে মাত্র তিন বার, ২০১৫ তে চার, ২০১৬ তে এক এবং ২০১৭ সালে সারা বছরে বিজেপির কোনও পোস্টে কোনও উল্লেখ নেই আডবাণীর।
তা হলে কি আডবাণী নিজেই চুপ করে গিয়েছেন, নাকি তাঁকে চুপ করিয়ে দেওয়া হল, লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে উঠছে সেই প্রশ্নও। এই মুহূর্তে তিনি আছেন বিজেপির মার্গদর্শক মণ্ডলীতে। দলের তরফে তাঁকে বলা হয়েছে, তিনি চাইলে লোকসভা নির্বাচনে লড়তেই পারেন। কিন্তু আডবাণী এখনও স্পষ্ট করে কিছু জানাননি। এখনও তিনি নীরবতার রাস্তাতেই। তাই প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নিয়েই নেবেন আডবাণী, নাকি প্রয়োজন পড়লে ফের হয়ে উঠবেন দলের কান্ডারি? লোকসভা নির্বাচনের আগে যখন একটু হলেও বিপাকে শাসক বিজেপি, তখন এই প্রশ্নই বড় হয়ে উঠছে রাজনীতির অন্দরমহলে।
তথ্যসূত্র: লোকসভা, ফেসবুক
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
(ভারতের রাজনীতি, ভারতের অর্থনীতি- সব গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy