Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

আজাদির ডাক ছাত্রসমাজ থেকেই বা আসছে কেন?

মানুষের অস্তিত্বের পরিচয়কে ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই করারই ডাক এটা। মনে করছেন সুমন্ত্র মাইতি।কর্মসূত্রে বেশ কিছু দিন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে থাকাকালীন একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম। ও দেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও হয়েছিল। খেয়াল করে দেখেছিলাম, তাঁরা যথাসম্ভব ‘ভারতীয়ত্ব’ বজায় রাখার চেষ্টা করেন, জীবনযাপনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে আচার অনুষ্ঠান’ও পালন করেন সাধ্যমতো।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুযারা পথে।—ফাইল চিত্র।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুযারা পথে।—ফাইল চিত্র।

সুমন্ত্র মাইতি
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১৭:০০
Share: Save:

কর্মসূত্রে বেশ কিছু দিন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে থাকাকালীন একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম।

ও দেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও হয়েছিল। খেয়াল করে দেখেছিলাম, তাঁরা যথাসম্ভব ‘ভারতীয়ত্ব’ বজায় রাখার চেষ্টা করেন, জীবনযাপনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে আচার অনুষ্ঠান’ও পালন করেন সাধ্যমতো। অনেকে খাদ্যাভ্যাসের সংস্কারও বজায় রাখতেন বৈকি। ভারতবর্ষ সম্পর্কে ওঁদের কৌতূহলও বেশ চোখে পড়ার মতো (প্রায়শই আমাকে সেই কৌতূহল নিরসন করতে হত)।

প্রথম দিকে আমি প্রায়শই একটা ভুল করতাম। কোনও ভারতীয় বংশোদ্ভূতের সঙ্গে আলাপ হলে জিজ্ঞেস করতাম, ‘‘আর ইউ অ্যান ইন্ডিয়ান?’’

জবাব মিলত, ‘‘নো, আই অ্যাম আ সাউথ আফ্রিকান।’’

অনেক পরে ভেবেছি, এই প্রশ্নটাই যদি ঘুরিয়ে করতাম, ‘‘আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?’’ হয়তো উত্তর পেতাম, ‘‘হ্যাঁ। আমার পূর্বপুরুষ ভারতবর্ষ থেকে আগত।’’

কিন্তু পরিচয় তার একটাই। সাউথ আফ্রিকান।

ক্রমবর্ধমান এই ‘ডায়াস্পোরা’কে মাথায় রেখেই বলছি, বহুত্ববাদের এই প্যাকেজ, অর্থাৎ কি না যাকে আমরা বলি ভৌগোলিক সীমারেখা, তাকে তো অস্বীকার করা যাচ্ছে না।

নিন্দুকেরা অবশ্য রাষ্ট্র নামক চিরকালীন খলনায়কের দমননীতি কিংবা ‘ভয় না ভক্তি?’র কূট প্রশ্ন ছুড়ে দেবেন। কিন্তু ইতিহাসের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দেখা যাবে যে দমনের স্থায়িত্ব চিরকালীন নয়। মানুষ তাই এই খাল বিল পাহাড় পর্বত দিয়ে চলে যাওয়া অজস্র কিলোমিটারের কাঁটাতার কিংবা প্রাচীর নিজের অস্তিত্বের পরিচয়ের সঙ্গেই মিশিয়ে নিয়েছে সানন্দে।

আহ্বানটা যখন দেশকে বরবাদ করে দিয়ে টুকরো টুকরো করার, তখন সেটা স্রেফ কিছু জমি, জল আর গাছপালার ভাগ নয়। মানুষের অস্তিত্বের পরিচয়কে ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই করারই ডাক এটা। এই ইতিহাসের সঙ্গে তো আমরা এত দিনে পরিচিত, তাই না? অন্তত আমার মতো নন-ইন্টেলেকচুয়াল মধ্যমেধার দেশপ্রেমিকের কাছে এই আহ্বানের মানেটা তাই-ই।

কিন্তু প্রশ্নটা থেকে যায়, কেন এই আজাদির ডাক? আরও মাথাব্যথার প্রশ্নটা হল যে এই ডাক ছাত্রসমাজ থেকেই বা আসছে কেন?

ছাত্র রাজনীতি কতটা ‘ইজমে’ আবদ্ধ সে ব্যাপারে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। আমি ছাত্রদের সিনসিয়ারিটিকে অস্বীকার করছি না। কিন্তু একটা ইজমে পুরোপুরি বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করার জন্য যে ব্যপ্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, ছাত্রাবস্থায় সেই পথটুকু অতিক্রম করা যায় কি? মনে হয় না। ফলে ছাত্র রাজনীতির মূল নির্যাস, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনোভাবকে মূলধন করে পেছনে কিছু গভীর রাজনৈতিক দাবার চাল চলছে কি না, সে ব্যাপারেও কিছু নির্মোহ বিশ্লেষণ করা যাক।

আরও পড়ুন:

গায়ের জোরে ২+২=৫?

জেএনইউ কিংবা যাদবপুরে আজাদির স্লোগান তোলার পরিপ্রেক্ষিত ও মোটিভ নিয়ে আলোচনা করা যাক।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, কাশ্মীর না হয় বিতর্কিত ইস্যু। কাশ্মীরের জন্য না হয় সংবিধানে অন্য সংস্থান আছে, অন্য আইন আছে। কিন্তু কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের সংবিধান মেনে চলা অন্যান্য অঙ্গরাজ্যেরও ‘আজাদি’র দাবি যখন একই মঞ্চে উঠছে, তখন এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়ায় অসুবিধে আছে বৈকি।

কাশ্মীরের মানুষও কি আদৌ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান? আমার মনে হয় যে চান না। বরঞ্চ কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় পাকিস্তান, আইএসআই আর তাদের পোষা কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। আর এদের তালে তাল মিলিয়েই কিছু রাজনৈতিক দল ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছে। এই প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের কারণ স্বল্প নাকি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক পরিকল্পনা সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু সাধারণ বিচারবুদ্ধি বলে যে আদৌ যদি তারা কাশ্মীরিদের সমস্যার সমাধানে উৎসাহী হন তা হলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে সওয়ালেই চাপ সৃষ্টি করুন। কাশ্মীরের জন্য আলাদা সাংবিধানিক সুবিধে তুলে দেওয়ার কথা বলুন। কাশ্মীর যাতে মূলধারার ভারতের সঙ্গে মিশে যেতে পারে সে ব্যাপারেই সরব হোন।

প্রশ্ন উঠবেই যে, কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গেই আসতে হবে কেন? পাকিস্তানের সঙ্গে নয় কেন বা আজাদ কাশ্মীর নয় কেন? পাকিস্তানের সঙ্গে গেলে কী হবে তা আমরা ভাল করেই জানি। আর আজাদ কাশ্মীর যে আদৌ আজাদ কাশ্মীর থাকবে না তা-ও সবাই জানি। ওটা প্রথমে আজাদ কাশ্মীর থেকে পাক নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর হবে, তার পর পাক অধিকৃত কাশ্মীর হবে আর শেষে আর একটি পাক প্রদেশ হবে। সুতরাং আজাদ কাশ্মীর চাওয়া আর কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়া একই ব্যাপার।

আর এইখানেই আমার আপত্তি। আজাদ কাশ্মীরের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে নমো নমো করে সমালোচনা করেই বাড়তি উদ্যমে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের আজাদির দাবি তোলা এক মারাত্মক বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের জন্ম দেবে সন্দেহ নেই। কাল দেশের অন্যান্য অংশেও আওয়াজ উঠতে পারে আজাদির। চিন্তা করার সময় এসেছে বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে ফ্রিডম/আজাদি কথাটার অপভ্রংশ যেন তৈরি না হয়ে যায়।

ছাত্রসমাজের হয়তো এই দায় নেই। প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাবকে উস্কে দিয়ে কিছু পোড়খাওয়া রাজনৈতিক দল হয়তো বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির হাত শক্ত করছে, কিন্তু তাকে মোকাবিলা করতে গিয়ে অপরপক্ষ জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেমকে ‘পলিটিক্যাল রেটরিক’-এ নামিয়ে আনছেন। সামগ্রিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিচার করলে এটাও চিন্তার বিষয় বৈকি।

তবে দেশপ্রেম কিংবা জাতীয়তাবাদ নিয়ে মতানৈক্য থাকতেই পারে, বাক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে দেশের সমালোচনার অধিকার'ও আছে, কিন্তু ভারত তেরা টুকরে হোঙ্গে স্লোগানের পাশাপাশি, আজাদির স্লোগান মিশিয়ে দেওয়াকে কখনওই গঠনমূলক বলা চলে না, বরং তা যথেষ্ট ইন্ধনমূলক।

পুনশ্চ: বাবার হোটেলে খাচ্ছি বলে বাবাকে সম্মান করতে হবে, এ রকম মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। মা জন্ম দিয়েছে বলেই অকৃত্রিম মাতৃভক্ত হতে হবে এরকম দাবও কেউ করে না। কিন্তু ভাবার চেষ্টা করছি, মা-বাবা জন্ম দিয়েই ডাস্টবিনে ফেলে রেখে চলে গেলে কী হত? সার্ত্র, কাফকা পড়া বাঙালির ইন্টেলেকচুয়ালিটির নিরিখে যুক্তিটা যাত্রাপালার মতো শোনাল বটে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাস্তব আর পিলে চমকে দেওয়া চিন্তাভাবনার তফাৎটা এখানেই।

(লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE