Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

তথ্যের জন্য এ বার আমাদের ইন্টারনেটের দাসত্ব করতে হবে!

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের ৩০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন হচ্ছে এই বছর। জেনিভায়, সার্ন-এ। সেই প্রসঙ্গে লিখছেন বিশিষ্ট কণাপদার্থবিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ।শুধুই কি তথ্যের জন্য নতুন করে দাসত্বের বেড়ি-বাঁধন পড়তে হবে মানুষকে?

ইনসেটে বিশিষ্ট কণাপদার্থবিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ।

ইনসেটে বিশিষ্ট কণাপদার্থবিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ।

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৯ ১৪:৫৫
Share: Save:

বিশ্বকে তাঁর অন্তর্জালে বেঁধে ফেলার জন্য কি এখন সত্যি-সত্যিই কিছুটা আক্ষেপ করেন স্যর টিম বার্নার্স-লি? তিনিই তো জন্ম দিয়েছিলেন ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব’ বা ‘www’-র

জেনিভায় ‘সার্ন’-এর অনেককেই হালে বলতে শুনেছি, সভ্যতার এই ইন্টারনেট-সর্বস্বতা দেখে নাকি মাঝেমধ্যেই তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে আক্ষেপ করেন বার্নার্স-লি! ভাবেন, আমাদের গোটা সভ্যতাই কি তা হলে এ বার তথ্য বা ইনফর্মেশনের ক্রীতদাস হয়ে যাবে? শুধুই কি তথ্যের জন্য নতুন করে দাসত্বের বেড়ি-বাঁধন পড়তে হবে মানুষকে?

সেটা ছিল ১৯৮৯ সালের ৪ মার্চ। সার্নে লিখিত প্রস্তাব জমা দিলেন টিম। এমন একটা কিছু বানাতে হবে যা তথ্য বা ইনফর্মেশনকে এক লহমায় পৌঁছে দেবে আমাদের নাগালে। তার জন্য আদৌ ছুটোছুটি করতে হবে না। সেই সব তথ্য যাতে হারিয়ে না যায়, তা নিয়ে ততটা ভাবতেও হবে না।

স্যর বার্নার্স-লির দেওয়া প্রস্তাব কার্যকর করতে সার্ন-এর তেমন সময় না লাগলেও আমজনতার হাতে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের পৌঁছতে কিন্তু কিছুটা সময় লেগেছিল। তা পৌঁছেছিল আরও চার বছর পর। ১৯৯৩ সালে। যার মানে, ‘www’-র ঘরে ঘরে পৌঁছনোর বয়স হয়েছে সবে ২৬ বছর। এত অল্প সময়ের মধ্যেই ইন্টারনেট জয় করেছে গোটা বিশ্বকে।

১৯৮৯-র মার্চে সার্ন-কর্তৃপক্ষের কাছে যে গবেষণাপত্র জমা দিয়েছিলেন স্যর টিম বার্নার্স-লি, তার প্রথম পাতা

অনেক জটিলতা দূর করে আমাদের জীবনকে সহজ থেকে সহজতর করে তুলেছে। যত সময় এগবে, ইন্টারনেট ততই আমাদের জীবনকে করে তুলবে আরও আরও সহজ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার কয়েক দশক পর ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’কে ঘিরে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, বিভক্ত হয়ে পড়েছিল নানা রকমের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা, সঙ্কটে, তখন ব্রিটেনের নাগরিক স্যর বার্নার্স-লির উদ্ভাবিত প্রযুক্তিই আমাদের এই গ্রহের মানুষের সম্পর্ককে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করেছে, করে চলেছে। পরিবার, পরিজন ও জন্মের মাটি থেকে ছিটকে যাওয়া ছেলে আজ এই ইন্টারনেটের মাধ্যমেই বহু বহু দূরে থাকা মা, বাবা, স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে এক লহমায়। এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যাওয়ার আগেই।

স্যর টিম বার্নার্স-লি (বাঁ দিক থেকে প্রথম)-র সঙ্গে বিশিষ্ট কণাপদার্থবিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ।

স্যর বার্নার্স-লি কিন্তু আজ থেকে ৩০ বছর আগে এত সব ভেবেটেবে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বানানোর প্রযুক্তির স্বপ্ন দেখাননি। তিনি চেয়েছিলেন সেই সময় সার্নের একটা বড় ধরনের মাথাব্যথা দূর করতে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের নিয়ে কাজ করতে, তাদের ভেঙে আরও নতুন নতুন কণার হদিশ পেতে, আর সেই সবের মাধ্যমে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিরহস্যের জট খুলতে ওই সময় সার্নে চালু হয়েছিল পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটর বা কণাত্বরায়ক যন্ত্র। যেখান থেকে প্রতি মুহূর্তেই বেরচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে কণা আর প্রচুর পরিমাণে ডেটা বা তথ্যাদি। আর সেই তথ্যাদির পরিমাণ এতটাই বেশি যে, একটি সাধারণ কম্পিউটার বা অনেকগুলি কম্পিউটার একজোট করে তাতে সেই সব তথ্যের পুরোটাই ধরে রাখা সম্ভব নয়। যার মানে, সার্নের অ্যাক্সিলারেটর থেকে যতই ‘খাবারদাবার’ বেরিয়ে আসুক না কেন, তা ‘খেয়ে হজম’ করার মতো ‘খাদক’ ছিল না!

আরও পড়ুন- ওদের মুখোশ খুলে দিতে বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলি এখন গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্র

আরও পড়ুন- অন্যান্য প্রযুক্তির মতো, ইন্টারনেটও তার নিজস্ব বিপদ সঙ্গে নিয়ে এসেছে

শুধুই যে সেই সব ‘খাবার’ হজম করার মতো ‘পেট’ ছিল না, তাই নয়; ছিল না সার্নের অ্যাক্সিলারেটর থেকে বেরিয়ে আসা ডেটা বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের মধ্যে কোন সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে, তা খুঁজে দেখার কাজটাও হয় শক্ত ছিল বা ছিল অসম্ভবই।

১৯৮১ সালে সার্নে একটি সাড়াজাগানো আবিষ্কার হয়েছিল। তিন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম, স্টিভেন ওয়েইনবার্গ এবং সেলডন গ্ল্যাসো অঙ্ক কষে দেখিয়েছিলেন, ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিজম আর রেডিও অ্যাক্টিভিটি একই সূত্রে বাঁধা। ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিজম হল সেই জিনিস, যা থেকে আলোর গতিবিধি বোঝা যায়। আর রেডিও অ্যাক্টিভিটি হল সেই জিনিস, যার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বিকিরণ হয়।

ওই তিন বিজ্ঞানী এও দেখিয়েছিলেন, ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিজম আর রেডিও অ্যাক্টিভিটিকে একই সূত্রে বেঁধেছে দু’টি মৌলিক কণা। ‘W’ এব‌ং ‘Z’ বোসন কণা। এই বোসন কণার নামকরণ করা হয়েছে বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন (সত্যেন্দ্রনাথ) বসুর নামে।

জেনিভায় সার্নের গবেষণাগারে বিকাশ সিংহ। ছবি সৌজন্যে: সার্ন

আমার মনে আছে, ওই সময় তিন বিজ্ঞানীর অন্যতম আবদুস সালাম এসেছিলেন ভারতে। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘বোসকে চেনো নাকি?’’ আমি বেশ গর্বের সঙ্গেই ওঁকে বলেছিলাম, ‘‘অবশ্যই চিনি।’’ তার পর সালাম অনেক ক্ষণ ধরে আমার দিকে তাকিয়ে থেকেছিলেন। ভাবছিলেন, এ তো তত বুড়ো নয়!

ওই আবিষ্কারের পর থেকেই সার্নে ভাবনা-চিন্তা শুরু হল, অ্যাক্সিলারেটর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসা ডেটা ‘হজম করা’র জন্য তো বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে! না হলে সব কিছুই তো হারিয়ে যাবে। পণ্ডশ্রম হবে! মৌলিক গবেষণার কাজে বিস্তর বাধা আসবে।

টিম বার্নার্স-লি ‘স্যর’ হয়েছেন অনেক পরে। বলা যায়, হালেই। কিন্তু সেই সময় বার্নার্স-লি-কে সার্নে কেউই তেমন ভাবে চিনতেন, জানতেন না। সার্নের ভাবনা-চিন্তা দূর করতে সহকর্মী রবার্ট কাইলুওকে নিয়ে বার্নার্স-লি ডুবে গেলেন গবেষণায়। ১৯৮৯-র ৪ মার্চ দিলেন লিখিত প্রস্তাব। কী ভাবে সার্নের সমস্যা আশু দূর করা যায়। যা আদতে একটি গবেষণাপত্র।

যখন গোড়াপত্তন হয়েছিল সার্নের, সেই ১৯৫৩ সালেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যা কিছুর আবিষ্কার হবে, সেই সবই গোপন না রেখে আমজনতাকে জানানো হবে। আর সেই আবিষ্কারের যাবতীয় সুফল পৌঁছে দেওয়া হবে আমজনতার হাতে। তাই ’৯৩ সালে সার্ন এই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবকে তুলে দেয় সাধারণ মানুষের হাতে। এখন যে ইন্টারনেট যোগাযোগ চলছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ২০০ কোটি জায়গা থেকে। অথচ, এই টিম বার্নার্স-লি ‘স্যর’ হয়েছেন অনেক পরে।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের আবিষ্কার আরও এক বার প্রমাণ করেছে, গবেষণার তাগিদ বা প্রয়োজনই ইনোভেশন বা উদ্ভাবনের ‘জন্মদাত্রী’।

তবে সমস্যা যে এতে একেবারেই মিটে গিয়েছে, তা কিন্তু নয়। কারণ, বেশ কিছু দিন আগে সার্নে চালু হয়েছে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার বা ‘এলএইচসি’। যেখান থেকে ‘হিগ্‌স বোসন’ কণার আবিষ্কার হয়েছে আজ থেকে ৬ বছর আগে। ২০১৩ সালে। এলএইচসি থেকে আরও আরও বেশি করে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসছে ডেটা, প্রতি মুহূর্তে। এত বেশি পরিমাণে ডেটা কিন্তু এখনকার ইন্টারনেট ব্যবস্থাও হজম করতে পারবে না। তারই জন্য আবিষ্কার করা হয়েছে, ‘গ্রিড কম্পিউটিং’। যা এখনকার ইন্টারনেট থেকেও অন্তত ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী। আমরা এখন কলকাতাতেও যেটা ব্যবহার করছি।

অনুলিখন: সুজয় চক্রবর্তী

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক-তথ্য: অধ্যাপক বিকাশ সিংহ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE