ইবোলার টিকা আবিষ্কারে ভারতীয় বিজ্ঞানী
এ বার বাজারে আসছে ভয়ঙ্কর ইবোলা ভাইরাসের হানাদারি থেকে বাঁচার রক্ষাকবচ! ইবোলার টিকা। ২০১৭-তেই। ইবোলার ওই টিকার নাম- ‘আরভিএসভি-ঝেবোভ’।
ইবোলার টিকার যুগান্তকারী আবিষ্কারটি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (‘হু’) নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল। যার পুরোভাগে রয়েছেন এক ভারতীয় মহিলা ভাইরোলজিস্টও। ভাবনা চাওলা। ভাবনা ‘হু’র অধীনে থাকা ‘ডক্টরস্ উইদাউট বর্ডার’-এর অন্যতম সক্রিয় সদস্য। পঞ্জাব-কন্যা ভাবনা এখন কাজ করছেন দক্ষিণ সুদানে।
গত তিন বছর ধরে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় মহামারীর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইবোলা ভাইরাস। ভারতে প্রথম ইবোলা ভাইরাসের হানাদারির শিকার হওয়ার ঘটনাটি ঘটে আমদাবাদে, ২০১১-য়। তার পর ২০১৪ সালে দিল্লিতে ইবোলায় আক্রান্ত হন আরও এক জন। ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি’র পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে ভারতে ইবোলায় আক্রান্ত হয়েছেন বা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার। তবে যে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় পেশাগত ও অন্যান্য কারণে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে রয়েছেন বা ওই সব দেশ থেকে যাওয়া-আসা করেন নিয়মিত, তাঁদের নিয়ে হিসেব কষা হলে, সংখ্যাটা এক লক্ষ বা তারও অনেকটা বেশি হতে পারে।
ইবোলা ভাইরাস। অণুবীক্ষণের নীচে।
অগ্নিপরীক্ষায় ইবোলার টিকার সাফল্যের সঙ্গে উতরে যাওয়ার গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘দ্য ল্যান্সেট’-এ। যার ‘লিড অথর’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হেল্থ সিস্টেমস অ্যান্ড ইনোভেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর-জেনারেল বিশিষ্ট চিকিৎসক মেরি-পাউলি কিনি। গবেষণাপত্রে কিনি লিখেছেন, ‘‘ইবোলার টিকা পরীক্ষায় একেবারে একশোয় একশো পেয়েছে। মানে, ১০০ শতাংশ সফল হয়েছে ইবোলার টিকা। ফলে, আমরা নিশ্চিত, ইবোলার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার বর্মটা আমরা পেয়ে গিয়েছি।’’
কী ভাবে ইবোলার টিকা প্রথম বারের জন্য সফল হল পরীক্ষায়?
মেরি-পাউলি কিনি (বাঁ দিকে) ও ভাবনা চাওলা
গবেষকদলের অন্যতম সদস্য ভারতীয় মহিলা ভাইরোলজিস্ট ভাবনা চাওলা আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে সুদান থেকে ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘গিনি সরকারের সহযোগিতায় ইবোলার ওই নতুন টিকাটির পরীক্ষা চালানো হয়েছিল গিনিতে। গত বছরের শেষ থেকে চালানো হয়েছিল ওই পরীক্ষা। পরীক্ষাটি চালানো হয়েছিল গিনির উপকূলবর্তী বাসে-গিনি এলাকায়। আর সেই পরীক্ষাটি চালানো হয়েছিল পর্যায়ক্রমে। যার নাম- ‘রিং ভ্যাকসিনেশন’। এই পদ্ধতিতে স্মল পক্সের (গুটিবসন্ত) টিকাও এক সময় পরীক্ষা করা হয়েছিল। ওই টিকা দেওয়ার জন্য গড়ে ৮০ জনকে নিয়ে এক-একটি ‘ক্লাস্টার’ বা ‘রিং’ বানানো হয়েছিল। মোট ‘রিং’ বা ‘ক্লাস্টার’-এর সংখ্যা ছিল ১১৭টি। পুরুষ ও মহিলা সহ ৫ হাজার ৮৩৭ জনকে দেওয়া হয়েছিল ওই টিকা- ‘আরভিএসভি-ঝেবোভ’। ১৮ বছর বয়সের বেশি যাঁদের বয়স, শুধু তাঁদেরকেই ওই ইবোলা টিকা দেওয়া হয়েছিল। তাতে দেখা গিয়েছে, গিনির যে সব এলাকায় ইবোলা কার্যত মহামারীর আকার নিয়েছে, সেখানে যাঁদের ওই টিকা দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা ১০ থেকে ৩০ দিন পরেও ইবোলায় আক্রান্ত হননি। ইবোলা ভাইরাস তাঁদের শরীরে ‘ছোবল’ বসাতে পারেনি বিন্দুমাত্র। আর সেই একই এলাকায় যাঁদের ওই টিকা দেওয়া হয়নি, তাঁদের মধ্যে ২৩ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন ইবোলা ভাইরাসের হানাদারিতে।
ইবোলা ভাইরাস। অণুবীক্ষণের নীচে।
‘হু’র তত্ত্বাবধানে ওই টিকাটি বানিয়েছে মার্ক, শার্প ও ডোহমে সংস্থা। টিকাটি এখন রয়েছে লাইসেন্স পাওয়ার অপেক্ষায়। আশা, আগামী বছরেই ওই টিকা এসে যাবে বিশ্ব বাজারে। ১৯৭৬ সালে ইবোলা ভাইরাসের হানাদারির প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল আফ্রিকায়। কিন্তু গত তিন বছরে শুধু গিনিতেই ইবোলায় আক্রান্তের সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। আর কঙ্গো, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, সুদান, গ্যাবন, উগান্ডা, লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন ও নাইজেরিয়া সহ মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে ইবোলায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা গত তিন বছরে পৌঁছেছে প্রায় ২ লক্ষে। ২০১৪ সালে গিনি, লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়া আর সিয়েরা লিওনেই শুধু ইবোলায় আক্রান্ত হয়েছিলেন দু’হাজারের বেশি মানুষ। মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছিল প্রায় দেড় হাজারের কাছাকাছি।’’
ইবোলা: ইতিহাস, কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা। ভিডিও
কতটা ভয়ঙ্কর এই ইবোলা ভাইরাস?
ভাবনার কথায়, ‘‘ইবোলা ভাইরাসের নামটি এসেছিল গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের ইবোলা নদীর নামে। ওই নদীর জলেই প্রথম হদিশ মিলেছিল এই মারাত্মক ভাইরাসটির। এর মোট পাঁচটি প্রজাতি এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। তার মধ্যে তিনটি প্রজাতি অত্যন্ত মারাত্মক। যাদের ‘ছোবলে’ মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। ওই তিনটি প্রজাতির ইবোলা ভাইরাসের হানাদারিতে মৃত্যু হয়েছে ৯০ শতাংশ আক্রান্তের।’’
ইবোলা ভাইরাস। অণুবীক্ষণের নীচে।
ইবোলা ভাইরাস। অণুবীক্ষণের নীচে।
ভারতের পক্ষে কতটা বিপজ্জনক এই ইবোলা ভাইরাস?
পুণের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি’র (এনআইভি) অধিকর্তা দেবেন্দ্র মৌর্য বলেছেন, ‘‘একে বলা হয় ‘এশিয়ান ইবোলা ভাইরাস’। অন্য নাম- ‘ক্রিমিয়ান কঙ্গো হেমোরেজিক ফিভার ভাইরাস’ (সিসিএইচএফ)। আমাদের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, গত তিন বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইবোলা ভাইরাসের হানাদারির ঘটনা ঘটেছে মোট ১৭টি। তাতে সরকারি হিসেবেই কম করে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১১ সালে আমদাবাদেই প্রথম ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এখন দেশের প্রায় সব রাজ্যেই ওই ভাইরাসের হানাদারির ঘটনা ঘটেছে অল্প-বিস্তর। তার মধ্যে হিমাচল প্রদেশ, গুজরাত, রাজস্থান ও ওড়িশাতেই ইবোলার হানাদারির ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। যেটা আরও উদ্বেগের ঘটনা, তা হল, ডেঙ্গি আর ইবোলার উপসর্গগুলি প্রায় একই রকমের। তাই অনেক সময়েই চিকিৎসকেরা ঠিক মতো বুঝতে না পেরে যাকে ‘ডেঙ্গিতে মৃত’ বলে ঘোষণা করেছেন, তাঁদের অনেকেরই ইবোলায় মৃত্যু হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। এ ছাড়াও অন্তত ৮০ হাজার ভারতীয় রয়েছেন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। তাদের একটা বড় অংশই রয়েছেন মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে। তাঁদের মাধ্যমেও ভারতে ইবোলা ছড়িয়েছে। আগামী দিনেও ভারতে ওই ভাবে ইবোলা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া আর তা মহামারী হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে যথেষ্টই।’’
ছবি সৌজন্যে: ভাইরোলজিস্ট ভাবনা চাওলা, ‘ডক্টরস্ উইদাউট বর্ডার’ ও ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি’, পুণে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy