Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কেন হয় ব্রেস্ট ক্যানসার? ‘চক্রী’দের হদিশ মিলল মহাকাশ গবেষণায়!

কেন হয় ব্রেস্ট ক্যানসার? কে বা কারা দায়ী ওই মারণ-ব্যাধির জন্য? কাদের চক্রান্তে ওই ভয়াবহ রোগ বাসা বাঁধে আমাদের দেহে? অবাক লাগলেও সত্যি, তার হদিশ মিলল এমন এক প্রযুক্তির মাধ্যমে যার উদ্ভাবন হয়েছিল মহাকাশ গবেষণায়! মহাকাশযানে থাকা ব্যাকটেরিয়াদের হাত থেকে গোটা মহাকাশকে বাঁচানোর তাগিদেই ওই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়েছিল। আর সেই প্রযুক্তি দিয়েই কিছুটা নাগাল পাওয়া গেল ব্রেস্ট ক্যানসারের ‘ষড়যন্ত্রকারী’দের! এই প্রথম।

স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত কোষ।

স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত কোষ।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৬ ১৮:০০
Share: Save:

কেন হয় ব্রেস্ট ক্যানসার? কে বা কারা দায়ী ওই মারণ-ব্যাধির জন্য? কাদের চক্রান্তে ওই ভয়াবহ রোগ বাসা বাঁধে আমাদের দেহে?

অবাক লাগলেও সত্যি, তার হদিশ মিলল এমন এক প্রযুক্তির মাধ্যমে যার উদ্ভাবন হয়েছিল মহাকাশ গবেষণায়! মহাকাশযানে থাকা ব্যাকটেরিয়াদের হাত থেকে গোটা মহাকাশকে বাঁচানোর তাগিদেই ওই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়েছিল। আর সেই প্রযুক্তি দিয়েই কিছুটা নাগাল পাওয়া গেল ব্রেস্ট ক্যানসারের ‘ষড়যন্ত্রকারী’দের! এই প্রথম।

আর সেই ‘বিরল’ আবিষ্কারের সঙ্গে জুড়ে গেল এক ভারতীয়ের নাম। পরাগ বৈশম্পায়ন। নাসার বায়োটেকনোলজিস্ট এই দক্ষিণ ভারতীয়ের দৌলতেই কার্যত ব্রেস্ট ক্যানসারের ‘নাটের গুরু’দের এই প্রথম চেনা-জানা গেল।

কী ভাবে তা সম্ভব হল?

ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরি (জেপিএল) থেকে পাঠানো ই-মেলে পরাগ আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, ‘‘এর আগে যা কখনও হয়নি, আমরা সেটাই করেছি। মহাকাশ প্রযুক্তি দিয়ে আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছিলাম ‘ব্রেস্ট ডাক্টাল ফ্লুইড’ (স্তনগ্রন্থির নালীর মধ্যে থাকা তরল বা রস)-এ কোন কোন জীবাণু (মাইক্রো-অরগ্যানিজ্‌মস্‌) বা ব্যাকটেরিয়া থাকে। সেখান থেকেই এই নতুন পথের হদিশ মিলেছে। ‘ব্রেস্ট ডাক্টাল সিস্টেম’ বলতে বোঝায়, প্রচুর স্তনগ্রন্থি আর তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ রাখার জন্য একটি মূল নালী আর প্রচুর ছোট ছোট নালিকা। ওই গুচ্ছ গুচ্ছ স্তনগ্রন্থি থেকেই স্তনদুগ্ধ (ব্রেস্ট মিল্ক)-এর নিঃসরণ হয়। ওই ব্যাকটেরিয়াগুলো তখন ‘ডাক্টাল ফ্লুইড’ থেকে স্তনদুগ্ধে এসে মেশে। তা ছাড়াও স্তনবৃন্ত কোনও ভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠলেও তার গোড়ার দিকটার কোষ, কলাগুলোয় এক ধরনের তরল বা রসের নিঃসরণ হয়। যাকে বলে, ‘নিপ্‌ল অ্যাসপিরেট ফ্লুইড’। ওই তরলেও ‘হানাদার’ ব্যাকটেরিয়াদের মিশে যেতে দেখা যায়। আমরা দেখেছি, যে সব মহিলার ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছে, তাদের স্তনগ্রন্থির নালীর রসে যে যে ব্যাকটেরিয়া থাকে, কোনও সুস্থ মহিলার স্তনগ্রন্থির নালীর রসে সেই ব্যাকটেরিয়াগুলো থাকে না। শুধু তাই নয়, আমরা এটাও দেখেছি, ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলাদের স্তনগ্রন্থির নালীর রসে ওই ‘হানাদার’ ব্যাকটেরিয়ারা রাক্ষসের মতো বংশবৃদ্ধি করে। আর সেটা করে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। এর থেকে অন্তত এটুকু বোঝা গিয়েছে, ব্রেস্ট ক্যানসারের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

কী ভাবে ছড়ায় ক্যানসার: দেখুন ভিডিও।

তারাই মূলত ব্রেস্ট ক্যানসারের ‘ষড়যন্ত্রকারী’! ব্রেস্টের (স্তন) কোষ (সেল) আর কলায় (টিস্যু) যে নানা রকমের ব্যাকটেরিয়া থাকে, তার প্রমাণ আগেই মিলেছিল। আর সেই ব্যাকটেরিয়ারা যে স্তনগ্রন্থির নালীর রসেও থাকে প্রচুর পরিমাণে, তাতেও কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু সেই স্তনগ্রন্থির নালীর রসে থাকা কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া যে ব্রেস্ট ক্যানসারের অন্যতম কারণ, এই প্রথম সেটা জানা গেল। অন্তত ৯৬ শতাংশ ক্ষেত্রে যে তারাই ব্রেস্ট ক্যানসারের কারণ, এটা নিয়ে আর কোনও সংশয়ের অবকাশ রইল না।’’ পরাগের এই সাম্প্রতিক গবেষণার খবরটি ছাপা হয়েছে অনলাইন বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস্‌’-এ।

আরও পড়ুন- মানুষের আয়ু আরও ৬ গুণ বাড়তে পারে! সত্যি?

ব্রেস্ট ক্যানসারের ক্ষেত্রে যে বিশেষ কয়েকটি ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকা রয়েছে, কী ভাবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন গবেষকরা?


নাসার গবেষণাগারে ভারতীয় বায়োটেকনোলজিস্ট পরাগ বৈশম্পায়ন।

হায়দরাবাদের সন্তান পরাগ জানাচ্ছেন, ‘‘আমরা পরীক্ষা চালিয়েছিলাম ২৩ জন সুস্থ, সবল মহিলা আর ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত ২৫ জন মহিলার ওপর। সেখান থেকে আমরা যে সব তথ্য পেয়েছিলাম, সেগুলো আমরা মহাকাশ প্রযুক্তির ‘নেক্সট-জেনারেশান জেনোমিক সিকোয়েন্সিং’ পদ্ধতিতে খতিয়ে দেখেছি। বিশ্লেষণ করেছি।’’

কিন্তু ব্রেস্ট ক্যানসারের ‘ষড়যন্ত্রকারী’দের সন্ধানে মহাকাশ প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর ভাবনাটা তাঁদের মাথায় এল কী ভাবে?


ব্রেস্ট ক্যানসারের ‘ষড়যন্ত্রকারী’ (বেগুনি রং) ব্যাকটেরিয়া।

পরাগের ব্যাখ্যায়, ‘‘মহাকাশে যখন কোনও মহাকাশযান পাঠানো হয়, তখন যথাসম্ভব চেষ্টা করা হয় যাতে কোনও ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীব তাতে না থাকে। কিন্তু কোনও মহাকাশযানের ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারটিকে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কারণ, সেটা পৃথিবী থেকে যাচ্ছে আর তার পর পৃথিবীর ঘন বায়ুমণ্ডলকে ভেদ করে মহাকাশে পৌঁছচ্ছে। এই যাত্রাপথের পুরোটাই ব্যাকটেরিয়া আর অণুজীবে ভরা। তাই কিছু ব্যাকটেরিয়া তো থেকেই যায় মহাকাশযানে। আর মহাকাশযানের দৌলতে তা মহাকাশেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে ভর-শূন্য (মাইক্রোগ্র্যাভিটি) অবস্থায় সেগুলো ভাসতে থাকে। যা মহাকাশচারীদের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। এই সমস্যা মেটানোর জন্যই ওই বিশেষ মহাকাশ প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়েছিল। যা মহাকাশে থাকা নানা রকমের ব্যাকটেরিয়ার হদি‌শ দিতে পারবে। ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান বা তাদের রকমফেরের হালহদিশের জন্য এর চেয়ে ভাল কোনও প্রযুক্তি এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের হাতে নেই।


ব্রেস্ট ক্যানসারের ‘মূল চক্রী’রা (হলুদ রং)। অণুবীক্ষণের তলায়।

তাই ব্রেস্ট ক্যানসারের ক্ষেত্রেও ব্যাকটেরিয়াদের ভূমিকা রয়েছে কি না, থাকলে কোন কোন ব্যাকটেরিয়া সেখানে ‘মূল ষড়যন্ত্রকারী’র ভূমিকা নেয়, তা জানার জন্যই ওই মহাকাশ প্রযুক্তিতে ব্যবহার করার কথা ভাবা হয়েছিল। এর ফলে, আধুনিক চিকিৎসায় মহাকাশ প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর পালে বাতাস বইতে শুরু করল।’’

তা হলে কি নাসার গবেষণা আর শুধুই ‘গগনচুম্বী’ না থেকে এ বার মাটিতে নেমে এল?

‘বল’টায় ‘বিষের ছোবল’ থাকলেও, ভারতীয় বায়োটেকনোলজিস্টের সরাসরি ‘স্ট্রেট ড্রাইভ’- ‘‘নাসা এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির মহাকাশ গবেষণাকে বহু দিন ধরেই আধুনিক চিকিৎসা-গবেষণায় কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে। মহাকাশ প্রযুক্তিগুলোকে সার্জারি বা চিকিৎসা-গবেষণায় কাজে লাগানোর প্রস্তুতি, তোড়জোড়ও চলছে। আমাদের এই গবেষণাতেও পাশে পেয়েছি ক্যালিফোর্নিয়ার ডক্টর সুসান লাভ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রধান বিশিষ্ট ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সুসান লাভ, জন ওয়েন ক্যানসার ইনস্টিটিউটের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডেলফিন লি’কে।’’

ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: নাসা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE