Advertisement
০৭ অক্টোবর ২০২৪
Art

আলোর জগতে অন্ধকারের প্রতিনিধি

১৯৪২ থেকে ’৪৮ সালের মধ্যে বিনোদবিহারী আরও দু’টি দেওয়ালচিত্র করেন শান্তিনিকেতনে। একটি চিনা ভবনে এবং অপরটি হিন্দি ভবনে। সেগুলি এখানে দেখানো সম্ভব হয়নি।

An image of the art

সম্পদ: প্রদর্শনীতে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের করা চিত্রকর্ম। —ফাইল চিত্র।

শমিতা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৩ ০৮:৩১
Share: Save:

শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি, গ্যালারি রসা-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে। বিশেষ প্রদর্শনী এই কারণে যে, শান্তিনিকেতনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই শিল্পীর কাজ যেন ইতিহাসের পাতা থেকে দর্শকের সামনে তুলে ধরে তাঁদের চমকে দেওয়া হল। অনবদ্য উপস্থাপন করেছেন আর শিব কুমার। এই প্রদর্শনীতে শিল্পীর ১৯২৪ থেকে ১৯৪২ সালের অনেক কাজই একত্রিত করা হয়েছে, যা অত্যন্ত দুর্লভ। সব নবীন শিল্পী, শিল্পসমালোচক, শিল্পরসিক এবং আরও অনেক মানুষকে সমৃদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে এই প্রদর্শনী, যা চলবে ২০ জুন পর্যন্ত।

প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ বিনোদবিহারীর করা ‘সিনস ফ্রম শান্তিনিকেতন’ স্ক্রোল। যে তিনটি স্ক্রোল এখানে দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে এটিই প্রথম। পরিমাপে ১৩ মিটার লম্বা। জাপানি এবং চিনা স্ক্রোলের পদ্ধতিতে করা, দৃষ্টিকে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে যেতে বাধ্য করে এই ছবি।

নেপালি টেক্সচারসমৃদ্ধ কাগজে ড্রাইব্রাশ-এর প্রয়োগকৌশল ব্যবহার করেছেন শিল্পী। ইন্ডিয়ান লাল এবং কালো কালি দিয়ে করা। কাগজের ছেড়ে দেওয়া অংশটিকেই বিনোদবিহারী জমি এবং আকাশ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ওই ইন্ডিয়ান লাল রঙের ব্যবহারেই ক্ষয়ে-যাওয়া জমি এঁকেছেন। এবং ওই রং হালকা করে দূরত্বও দেখিয়েছেন। এ ছাড়া কালো রং দিয়ে এঁকেছেন খেজুর গাছ, তাল গাছ এবং ঝোপঝাড়ের ছবি। আবার হালকা লাল রঙে এঁকেছেন লাল মাটির ছায়া এবং খোয়াইয়ের উঁচুনিচু অংশ। নেপালি কাগজে অদ্ভুত একটা টেক্সচার আছে। সেখানে শুকনো তুলির লাল এবং কালো রঙে এক দিকে শান্তিনিকেতনের প্রবল দাবদাহের একটা কঠিন আবহাওয়া সৃষ্টি করেছেন। আবার সেখানে শিল্পীমনের এক বিষণ্ণতামাখা একাকিত্বও অনুভব করা যায়। এক দিকে খোয়াইয়ের রুক্ষতাকেও যেমন তুলে ধরেছেন, সেই রকম শান্তিনিকেতনের মরসুমি পরিবর্তনগুলিও ধরেছেন। এখানে আমরা সবুজ আর্থ কালারের প্রয়োগ দেখি, যখন বৃষ্টির পরে সব বন-জঙ্গল সবুজ হয়ে উঠেছে। জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে এলে আবার মোনোক্রোম বা একরঙা ছবি। সব শেষে বীরভূমের এক রুক্ষতার এবং নিঃসঙ্গতার ছবি। যেন আবার পরের বছর প্রকৃতির ওই চেনা খেলাটি চলবে। ছয় ঋতুর আলাদা আলাদা রূপ ধরা হয়েছে স্ক্রোলে। অনবদ্য একটি কাজ। এটি ১৯২৪ সালে করা।

এ বার আসা যাক ‘ভিলেজ সিনস’ স্ক্রোলে। এটি মূল ছবি নয়, ছবির প্রিন্ট বা প্রতিরূপ। দৈর্ঘ্যে ২ মিটার লম্বা এই স্ক্রোলটি খোয়াইয়ের চেয়ে ছোট, কিন্তু অসম্ভব রঙের বাহারে সমৃদ্ধ। যাঁরা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে শান্তিনিকেতনে গিয়েছেন, তাঁরাই বিশাল খোয়াই প্রান্তরের মধ্যে মধ্যে এই রকম এক একটি গ্রামাঞ্চল দেখে থাকবেন। এগুলি যেন মরুভূমির মধ্যে এক টুকরো মরুদ্যানের মতো। এক ফালি আশ্রয়স্থল। ছোট ছোট কুটির, শান্ত পরিবেশ এবং বড় বড় শাল, শিমুল গাছের ছবি এঁকেছেন এলামাটি, সবুজ আর্থ কালার এবং পোড়া কমলা রং দিয়ে। জলে ভেজা মাটির রং এনেছেন শিল্পী বিনোদবিহারী, পাতলা জলরঙের ওয়াশে। জলরং একটির সঙ্গে অপরটি মিলেমিশে একটা মোহময় জগত তৈরি করেছে। আবার এই সমস্ত রংই হঠাৎ একসঙ্গে হয়ে এক ঘন রঙের ঝাড়ের জন্ম দিয়েছে। বৃষ্টিধোয়া গাছগাছালি আরও বৃষ্টির অপেক্ষারত। কারণ আকাশে গাঢ় মেঘ। এই জলরঙের ছবি সম্ভবত ১৯৩৮-’৩৯ সালে করা। এখানে শিল্পীর প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে একটু পরিবর্তন লক্ষণীয়। এই ছবিটি অনেক প্রাণবন্ত। মানুষকে যেন আহ্বান করে।

এ বারে আসি তৃতীয় স্ক্রোলের কথায়। এটির নাম ‘সিন ইন জাঙ্গল’। ১৯৪০-’৪২ সালের কাজ। সিলিংয়ে যে দেওয়ালচিত্রটি করেছিলেন, তারও পরে।

এই কাজটির বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি কলাগাছের কাণ্ডের ভিতরের তরুমজ্জার উপরে জলরঙে এঁকেছেন। এই স্ক্রোলটি ক্যালিগ্রাফিক ভাষায় করেছিলেন বিনোদবিহারী। জলরঙের এক অপূর্ব নিদর্শন। সবুজ আর্থ কালারের গাঢ় এবং পাতলা ব্যবহার। এ ছাড়া তাঁর প্রিয় ইয়ালো অকার এবং কালো রঙে (গভীরতার জন্য) বড় মোটা বটগাছের গোড়ায় এক অলস দুপুরের গল্প। বেশ কিছু মানুষ বসে গল্প করছে। কেউ লাঠি হাতে দাঁড়ানো। খেজুর গাছের মাথাগুলি দেখা যায় না। নীচে ঘন কাশফুলের বন। তার মধ্য দিয়ে কুকুর ও আরও কিছু পশু দৃশ্যমান।

প্রকৃতি, মানুষ, পশুপাখি এবং গ্রামজীবনের প্রতি অঢেল ভালবাসা থেকে শিল্পী শান্তিনিকেতনের এই স্ক্রোলগুলি এঁকেছেন। কারণ, তিনি তো তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছেন।

এ বার আসা যাক একটি ছাদের মুরাল বা দেওয়ালচিত্রে। এটির ছবি তুলে তার পিছনে আলো ফেলে দেখানো হয়েছে সিলিংয়ে। কাজটি শিল্পী শেষ করেছেন ১৯৪২ সালে। এটি এগ-টেম্পারায় করা। এগ-টেম্পারা মানে সে যুগে দেশি মাটির রং গুঁড়ো করে বা পিষে ফেলে তার পরে সেই রং বাঁধার জন্যে ডিমের কুসুমের সঙ্গে মিলিয়ে ছবি আঁকার রীতি ছিল। পরের যুগে শিল্পীরা শিরীষ আঠা দিয়ে সেই কাজ করতেন।

‘বীরভূম ল্যান্ডস্কেপ’ নামে আর একটি কাজও চোখ টানে। শিল্পী কুড়ি বছর বীরভূমে থাকার পরে সে জায়গার সব কিছু অন্তঃস্থ করার ফলেই এই দেওয়ালচিত্র এক চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছে। এই কাজের দৃশ্যাবলি অন্য স্ক্রোলগুলির মতো একমাত্রিক বা রৈখিক নয়। একেবারে মাঝখানে একটি জলাশয়কে কেন্দ্র করে কত যে গাছের সমারোহ! ওই জলাশয়কে ঘিরেই গ্রামীণ জীবনের একটা সম্পূর্ণ ছবি পাওয়া যায়। ১৯৪২ সালে শেষ করা এই বর্ণময় সিলিং তাঁর করা শেষ প্রকৃতির ছবি। এটিও ক্যালিগ্রাফিক পদ্ধতিতে আঁকা।

১৯৪২ থেকে ’৪৮ সালের মধ্যে বিনোদবিহারী আরও দু’টি দেওয়ালচিত্র করেন শান্তিনিকেতনে। একটি চিনা ভবনে এবং অপরটি হিন্দি ভবনে। সেগুলি এখানে দেখানো সম্ভব হয়নি। তবে সেগুলির বিষয়ে উল্লেখ না করলে বিনোদবিহারীর কথা সম্পূর্ণ হয় না। একটি শান্তিনিকেতনে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার জীবন নিয়ে এবং অপরটি মধ্যযুগীয় সাধুসন্তদের জীবন নিয়ে। শেষে নিসর্গচিত্র থেকে সরে গিয়ে তখন মানুষের ছবি আঁকছেন বিনোদবিহারী। সেখানে আঙ্গিকের চূড়ান্ত বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন। অতি আধুনিক এই সব দেওয়ালচিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সৃষ্টি করে গিয়েছেন কিংবদন্তি এই শিল্পী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Art artist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE