চিত্রণ: সুব্রত চৌধুরী
বাঙালি তখনও ব্রকোলির স্বাদ পায়নি।
রাঁধতে গিয়ে যখনতখন ক্যাপসিকাম, কারিপাতা, চাটমশলা দিয়ে বসত না।
জলখাবারকে ‘ব্রেকফাস্ট’ বলে মোমো-পাস্তা না খুঁজে দিব্যি লুচি-তরকারি, কী দুধ-মুড়ি বা কলা-আম চেটেপুটে খেত।
সময়টা তেমনই।
প্রাক্-দুপুর। আঁকার ইস্কুল-ফেরতা ভাগ্নে তেতে পুড়ে এসেছে মামাবাড়িতে।
তার ইন্টিরিয়র ডেকরেটর মেজোমামা তাকে তরিবত করে মাছভাজা আর পিতলের গ্লাসে এক পাত্র শরবত খাওয়ালেন।
ফিশ ফ্রাই-টাই নয়। স্রেফ ভেটকি মাছ ভাজা।
নুন-হলুদ মাখানোই ছিল। গরম সরষের তেলে ঝিরি ঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ ছেড়ে দিয়ে অল্প বাদামি হতে না হতেই তাতে লম্বা লম্বা কাটা টোম্যাটো দিলেন। সেটা গলতে না গলতেই নুন। আর সব শেষে মাছ ফেলে ভাজা। অল্প আঁচে। নামানোর কিছু আগে চেরা কাঁচালঙ্কা দিলেন ছড়িয়ে। ব্যস্।
সেই মেজমামা এখন বৃদ্ধ। ভাগ্নেটিও যৌবন-উত্তীর্ণ চাকুরে। ভরপুর সংসারী। কিন্তু মামার সেই ভাজা মাছের স্বাদ এখনও তাঁর মুখে লেগে।
বিজয়গড়ের তরুবালা সরকার। কাঠবাঙাল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ওঁর তখন ভরা সংসার। নিজে হাতেই রাঁধতেন। শুরুর পাতে ‘সুক্তানি’ করার ঝামেলায় না গিয়ে প্রায়ই করতেন তেতোর ডাল। বলতেন, ‘‘তিতার ডাইল।’’ কাটা উচ্ছে বা করলা ভাজা, না-ভাজা মুগ ডালে ফেলে। কেন? ভাজলে কী হবে?
উত্তর দিতেন, ‘‘তিতার ডাইলে সোয়াদ হইব না।’’
সে-ডালের যে কী অমৃত স্বাদ, বাড়ির সবাই জানতেন। পাড়াপড়শিরও অনেকে। বছর চারেক আগে তরুবালাদেবীর শ্রাদ্ধতেও রাখতে হয়েছিল তাঁর প্রিয় ‘তিতার ডাইল’।
ফুরফুরে সাদা ভাতের পাশে বাঙালি পাতের অলঙ্কার ছিল শাক।
সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এক বার লিখেছিলেন, ‘‘বাজারে গিয়ে লাল নটে দেখলে মন নেচে ওঠে। কী আর এমন জিনিস। এক অধ্যাপিকা আমাকে একবার সামান্য মশলা দেওয়া সেদ্ধ নটেশাক খাইয়েছিলেন। সরু চালের ভাতে যেই ডলে দিলুম, অমনি ম্যাজেন্টা রং। সামান্য শাকেরই কী স্বাদ রান্নার গুণে। এখনও জিভে লেগে আছে আমার।’’
যাদবপুরের শ্রী কলোনির এক পরিবার। দেশভাগের পরে খুলনার আদি নিবাস ফেলে এ পারে চলে এসেছিলেন।
আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে, এক নভেম্বরে তাঁদের নাতনির বিয়ে। তাতে দুপুরের মেনু হয়েছিল, ভাত আর কচি বেগুন দিয়ে নতুন ওঠা কই মাছের তেল ঝোল। কালো জিরে ফোড়ন দেওয়া। ঝোলের রং কালচে সবুজ। শুকনো লঙ্কা বাটা বা গুঁড়ো নেই। কিন্তু অমৃত। সরষের তেলের ঝাঁঝ, কাঁচা লঙ্কার ঝাল, বেগুনের মিষ্টি স্বাদ আর নতুন কইয়ের গন্ধ মিলেমিশে একাকার। মেনুটি বলে দিয়েছিলেন কনেকর্তা, তথা কনের মাতামহ। তখন তিনি প্রান্ত-প্রৌঢ়।
এ কালের আর কেই বা এ সব পদের নাম মুখে আনবে! এমন বহু পদ তাই ক্রমশই ‘হারানে’র দলে।
বিয়ের দুপুরে এখন বাড়ির লোকজনের জন্য কই মাছ রেস্তোয় কুলোবে না অনেকেরই। যাঁদের কুলোবে, তাঁরা ভাবতেও পারবেন না। বাসা বা বিলিতি পাঙাসের মতো স্বাদগন্ধহীন অদ্ভুতুড়ে মাছ সোনামুখ করে খেয়ে নেওয়া বাঙালির কই মাছ খেতে বড় সমস্যা— কাঁটা!
কইয়ের কাঁটা ও মাথা চিবিয়ে শেষ রসবিন্দুটুকু বার করে নিতে আজকের ‘বং’-রা জানে না, বাঙালি কিন্তু জানত।
পানভোজন বিশেষজ্ঞ রাধাপ্রসাদ গুপ্ত বহু কাল আগে লিখেছিলেন, বাঙালিরা দিনের খাবার খেতে খেতেই রাত্তিরে কী চর্বচোষ্য হবে, তাই নিয়ে ভাবনা শুরু করে দেন।
সে ‘রাম’ও নেই, নেই সে অযোধ্যাও!
দু-পাঁচ জন হয়তো আজও বলতে পারেন, তবে সেই সব পদকে স্মরণীয় করে রাখতে যে ছোট্ট একটা ‘টাচ’-এর প্রয়োজন, তা জানান দেওয়ার লোক কই!
লীলা মজুমদারের কাঁচকি মাছের রান্নার কথা মনে পড়ে?
ওঁর কথায়, ‘‘সে (কাঁচকি) এত খুদে যে একসঙ্গে রাখলে দেখায় যেন মুক্তোর ঢিপি। কাঁটা আছে বলে মালুম দেয় না কোনও সময়ে। তাকে সরষে বাটা, আদা বাটা, নুন, লঙ্কা কুচো আর সরষের তেল দিয়ে মেখে, দশ মিনিট ঢিমে আঁচে বসিয়ে খেয়ো দিকিনি। অমৃতের সঙ্গে কোনও তফাত লাগবে না।’’
কাঁচকি মাছে আদাটা হল মাস্টার স্ট্রোক! ওটা না দিলেই আঁশটে গন্ধ বেরবে।
এই ধরনের ‘টাচ অব আর্ট’ না-জানা, না-বোঝা, না-ভাবা থাকলেই হাতড়াতে হবে— ‘উনি যেন কী ভাবে এটা করতেন, আমি ঠিক পারি না।’
তবে হাতের গুণ ছিল তো বটেই! রন্ধনবিশেষজ্ঞা শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন স্বীকার করে নিচ্ছেন, কাঁচা মাছের তেল ঝাল তাঁর শাশুড়ির অন্নপূর্ণা দেবী যেমনটা রাঁধতেন, তাঁর নিজের হাতে সেটা কোনও ভাবেই আসে না।
শতরূপা বললেন, ‘‘মায়ের মতো আমিও কড়াইয়ে তেল গরম করে তাতে শিলে বাটা হলুদ আর শুকনো লঙ্কা জলে গুলে দিই। কষতে কষতে যখন তেল বেরিয়ে আসে, নুন হলুদ মাখানো কাঁচা মাছও ছাড়ি। ঢিমে আঁচে ফোটার পর অল্প গ্রেভি থাকতে থাকতে এক চিমটেরও কম চিনি দিয়ে অল্প কাঁচা তেল ছড়িয়ে নামাই। কিন্তু মায়ের মতো আর হয় না। ওটা মায়ের হাতের গুণ ছিল।’’
তিনি বলছিলেন, পাকা পোনা মাছ, পারশে, ট্যাংরা, আড়, বোয়াল— সব রকম মাছেই এই চলবে। তেলটা একটু বেশি লাগবে, এই যা! আর খবরদার, হলুদেরও কিন্তু গুঁড়ো চলবে না, বেটে নিতে হবে। শতরূপার কথায়, ‘‘মাছের অল্প গ্রেভি দিয়ে মেখেই অনেকটা ভাত দিব্যি খেয়ে নেবেন।’’
বাঙালির রান্নার আকর-গ্রন্থ ‘পাকপ্রণালী’-র রচয়িতা বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়।
তিনি লিখেছেন, ‘‘হিন্দুদের মধ্যে যেমন চর্ব, চুষ্য, লেহ্য, পেয় প্রভৃতি নানাবিধ উপাদেয় খাদ্য ব্যবহারের প্রথা দেখা যায়, পৃথিবীর মধ্যে আর কোনও জাতির সেরূপ প্রণালী দৃষ্টিগোচর হয় না।’’
কিন্তু ওই যে, ব্যবহৃত না হতে হতে ক্রমশ সেসব ইতিহাসের খাতায়।
সহজপাঠের এক ছত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে কালের দু’টো পদের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন।— ‘খৈ আর দৈ খাও/বই রাখো তুলে/কৈ মাছ ভাজা খেতে/শৈল গেছে ভুলে।’
চিড়ে-দই নয় কিন্তু। দই দিয়ে মেখে খই। আর এ কালের ডায়েটেশিয়ান রেশমী রায়চৌধুরী মেদ ঝরাতে চাওয়া বহু পুরুষ-মহিলাকে বলছেন, ‘‘কর্নফ্লেক্স-দুধ-টুধ নয়, প্রাতরাশে খই আর টক দই খেলে ফল মিলবে।’’
রুই-ইলিশ-তপসে-পারশে-ভেটকি-মৌরলার বদলে কই মাছ ভাজার কথাও বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এমনিতে কই-ফুলকপি, তেল কই, কই মাছের হরগৌরী বা গঙ্গা-যমুনা, সরষে কই, কই কালিয়া অনেকেরই জানা।
কিন্তু কই মাছ ভাজা?
উত্তরটা মিলল ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্কিত এক ব্যক্তির কাছে।— ‘‘কই খুব পাকাও হবে না, আবার কচিও হওয়া চলবে না। সেই রকম মাছের দু’পিঠে লম্বালম্বি ভাবে হাল্কা চিরে নিয়ে নুন-হলুদ মাখিয়ে ভাল করে ভেজে নিয়ে মিহি করে কুচোনো ধনেপাতা, অল্প গোলমরিচের গুঁড়ো আর ভাজা মশলার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিন। প্রয়োজনে অল্প আমচুর। ওটাই কই মাছ ভাজা।’’
বারুইপুরের এক পরিবার। এক সময় ফি বছর ভাইফোঁটার দিন যাঁদের বাড়িতে পাত পড়ত অন্তত ৫০-৬০ জনের।
এক-এক বছরে এক-একটি আইটেম থাকত স্পেশ্যাল।
১৯৮৭ সালের কথা।
সে বার স্পেশ্যাল, পমফ্রেট মাছের বড়া। কিন্তু গৃহকর্ত্রী ও প্রাক্তন পর্বতারোহী ইন্দিরা বিশ্বাস, তাঁর আইনজ্ঞ স্বামী ও স্কুলপড়ুয়া কন্যা আগের রাতে প্রচণ্ড টেনশনে।
কী ব্যাপার? না, মাছের বড়া থেকে আঁশটে গন্ধ কিছুতেই যাচ্ছে না।
বারবার বড়ার ‘ট্রায়াল’ দেওয়া হচ্ছে আর প্রতি বারই ‘এরর’।
শেষমেশ জানা গেল, কাঁটা ছাড়ানো মাছ শুধু নুন দিয়ে সিদ্ধ করলেই হবে না, ওটা তেল মশলা দিয়ে ভাল করে কড়াতে পাক দিয়ে, তার পরেই ছোট ছোট বল পাকিয়ে বেসনের গোলায় ডুবিয়ে ভাজতে হবে।
ওই ইন্দিরা দেবী এক বার ছোট ভাইয়ের হবু শ্বশুরবাড়ির লোকদের মাত করে দিয়েছিলেন কুমড়োর পায়েস খাইয়ে!
এমন মাথা খাটানো জিনিসটাই বাঙালির রান্না থেকে স্রেফ হারিয়ে গিয়েছে। ছেঁচকি, ঘণ্ট, চচ্চড়ি, ডালনা, ছোঁকা বা ছক্কা, এই সব ক’টি আইটেম যে একে অপরের থেকে আলাদা, এক-একটির জন্য তরকারি কোটা থেকে শুরু করে আঁচ ও তেল-মশলা সবই যে অন্য রকম, এই ধারণাই বা আছে ক’জনের?
স়ঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বরাবরই বিশ্বাস করেন, ‘‘মাছ, মাংস হল ফাঁকিবাজি। রাঁধুনির কেরামতি যত নিরামিষ রান্নায়।...দুধ দিয়ে সামান্য চালকুমড়ো এমন রাঁধা যায়! সবাই মাছ-মাংস ফেলে ছুটে আসবেন।’’
চালকুমড়োর মতোই আর এক অ-কুলীন সবজি হল থোড়। কিন্তু পরিপাটি করে কুচিয়ে কাটা থোড় ভাপিয়ে নিয়ে, তার সঙ্গে ঘিয়ে তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে গোবিন্দভোগ চাল, নারকোল কোরানো, কিশমিশ, পরিমাণমতো নুন-চিনি দিয়ে রাঁধা থোড়ের পোলাও স্রেফ দেবভোগ্য!
একই রকম অনির্বচনীয় আহার্য, কাঁচা অড়হর ডাল সিদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে শিম-বেগুন সমেত রান্না।
ঠাকুরবাড়ির কন্যা ও রন্ধনচর্চার পথ দেখানো বিভিন্ন বইয়ের রচয়িতা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীও লিখেছেন, ‘‘নিরামিষ আহারে এত বৈচিত্র্য আছে যে বিনা আমিষের সাহায্যে রসনার তৃপ্তির কোনও অভাবই হয় না।…আমাদের দেশীয় নিরামিষ আহারগুলিও এত সুস্বাদু ও এত বিচিত্র প্রকারের যে সে সকল আহারে কেহ তৃপ্ত না হইয়া যাইতে পারে না।’’
নিরামিষ রান্নায় কেরামতির মাত্রা টের পেয়েছিলেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় দু’দশক আগে।
অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের শিষ্য হওয়ার সুবাদে বহু যুগ ধরে সপরিবার শীর্ষেন্দু আমিষ ছোঁন না।
অথচ দেওঘরের সৎসঙ্গ আশ্রমেই তাঁর পাতে কি না পড়ল মাগুর মাছের ঝোল!
হাঁ হাঁ করে উঠলেন নিষ্ঠাবান ধার্মিক, ‘‘এ কী, মাগুর মাছ কেন?’’
মুচকি হেসে অভয় দিলেন পরিবেশনকারী, ‘‘খেয়েই দেখুন না।’’
মুখে তুলে যেন অপার্থিব স্বাদ পেলেন ‘পার্থিব’-র রচয়িতা!— ‘‘পদের নাম মাগুর ধোঁকা। ডালের সঙ্গে শোলাকচু বেটে মাগুর মাছের মতো টুকরো টুকরো করে ধোঁকা বানিয়ে রান্না। আর কচুর পাতা দিয়ে প্রতিটি টুকরো এমন ভাবে ঢেকে দেওয়া, যাতে মনে হয় মাগুর মাছের চামড়া।’’
ব্যঞ্জনে মাগুর ধোঁকা নামটি ব্যঞ্জনাময়। কারণ, কচুর ধোঁকাকে মাগুর মাছের আকার দিয়ে ধোঁকা দেওয়া বা বোকা বানানো হচ্ছে যে!
শীর্ষেন্দুর আর একটি প্রিয় পদ কচুর সিংড়ি।
ভোজনরসিক সাহিত্যিকের কথায়, ‘‘কচু কাটার মুন্সিয়ানার মধ্যেই এই পদের স্বাদ জড়়িয়ে। শোলাকচু কাটতে হবে স্প্রিং-এর মতো। তার পর সেগুলো বেসনে মাখিয়ে ডুবো তেলে ভেজে তুলে নিতে হবে। শেষে ঘি দিয়ে তৈরি ঘন ঝোলে ফেলে ফোটাতে হবে।’’
শীর্ষেন্দুর স্মৃতিতে রয়েছে বড় বড় টুকরো করে কাটা লাউ আর অল্প উচ্ছে দিয়ে ঘি সম্বর দেওয়া মটর ডাল। উচ্ছে দিলেও তেতো স্বাদ হবে না, রান্নার গুণ এমনই!
ডালের অপার মহিমায় যে তরল হওয়া সম্পর্কও ফের গাঢ় হতে পারে, তার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গল্পে।
পাকাপাকি বিচ্ছেদ না হলেও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন স্বামী-স্ত্রী।
স্বামী তাঁর চিঠিতে অন্যান্য কথার সঙ্গে স্ত্রীকে কাঁচা মুগডালে কী সম্বর দেবেন, কাতর ভাবে জানতে চান।
দেশান্তরে থাকা স্বামী জানান, সব কিছুই করছেন, কিন্তু কিছুতেই স্বাদ খুলছে না, যেমনটি তাঁর স্ত্রীর হাতে খুলত।
চিঠির উত্তর দিয়ে স্বামীকে ওই মহিলা জানিয়েছিলেন, কড়া গরম করে সাদা তেলে অল্প মাখন ফেলে আদা ফোড়ন দিতে হবে।
হায় প্রেম!
এমন রন্ধন-রহস্যের চাবিকাঠি যাঁদের হাতে থাকে, সেই পাচক বা রাঁধুনিকে খাবারের ঈশ্বর বলে বর্ণনা করেছেন বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়।
তাঁর ভাষায়, ‘‘ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ— এই চতুর্বিধ সাধনের উপাদান দেহ বা স্বাস্থ্য, সেই স্বাস্থ্য আবার খাদ্যের উপর নির্ভর করে, পাচক এই খাদ্যের বিধাতা।’’
কিন্তু সেই পাচক যদি আলু-ফুলকপি-মটরশুঁটির ডালনায় কাঁড়ি কাঁড়ি টোম্যাটো সস ঢালে, তখন কি আর তাঁকে বিধাতা বলা যায়?
কিংবা তিনি যখন জিজ্ঞেস করেন, ‘তেল কই কি লাইট হবে না রিচ করব?’, তখন তাঁর উপর কি আর ভরসা রাখা যায়?
এক ভোজনরসিক পূর্ববঙ্গীয়কে বলতে শুনেছিলাম, ‘তেলকই লাইট হবে কি না’ জানতে চাওয়া আর বিরিয়ানিতে পেঁপেসিদ্ধ দেব কি না বলার মধ্যে কোনও তফাত নেই।
ফর্মুলা শিখে রান্না হয় না। হাতযশ, বাস্তবজ্ঞান কাজে লাগাতে হয়। রেসিপি পড়ে আর ঘড়ি দেখে রাঁধতে গেলে সে রান্নায় খাবার হবে বটে, কিন্তু ফারাক একটা হবেই— অনেকটা অভিধান খুলে শব্দ বেছে বেছে বাক্য লেখার মতো।
কলেজ জীবনে উত্তর কলকাতার এক বনেদি বাড়ির গৃহবধূর স্নেহের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল। তিনি যত বারই কলঙ্কহীন লুচির সঙ্গে গোটা পটলভাজা খাইয়েছেন, তত বারই পটল ছিল নির্মল সবুজ, ভাজা বা পোড়ার দাগবিহীন, অথচ সুসিদ্ধ।
মাতৃসমা তাঁর হাতেই প্রথম খাওয়া ক্ষীরকমলা। মোষের দুধের ঘন অথচ ধবধবে সাদা ক্ষীর করে তার মধ্যে কমলালেবুর কোয়া টুকরো টুকরো করে মেশানো। কোয়ার গায়ের পাতলা ছালটাও তুলে ফেলে।
তার এক যুগ পরে দক্ষিণ কলকাতার এক নামী মিষ্টান্নের দোকানের কমলালেবুর পায়েস নামে যে বস্তুটি পাওয়া গেল, সেটা ওই একই ব্যাপার, তবে পাতলা ছাল ছাড়ানোর যত্নটা সেখানে নেই!
ইদানীং অবশ্য রন্ধনপটিয়সী কেউ কেউ পুরনো কিছু বাঙালি রান্না একটুআধটু ‘ইমপ্রোভাইজ’ করছেন। বাঙালি মতেই। তার স্বাদ কিন্তু খারাপ নয়।
শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন। ক্ষীরকমলাকেই নিজের মতো করে বদলে নিয়েছেন।
ক্ষীর অল্প দিয়ে তার বদলে একটু ছানা মিশিয়ে এবং কমলালেবুর সঙ্গে ভাল জাতের কমলাভোগ টুকরো করে দিয়ে।
এ বারের ভাইফোঁটাতেই শতরূপা দেবীর ননদ তাঁকে খাইয়েছেন পটল বাটা! পটলের খোসা ছাড়িয়ে দানা শুদ্ধ সেটা বেটে কড়াইয়ে তেল গরম করে নুন-চিনি-লঙ্কাবাটা আর অল্প দই ও ছানা মিশিয়ে পাক।
সে নাকি অমৃত!
বাঙালি রসনার তৃপ্তির জন্য গৃহিণীর উদ্ভাবনী শক্তি কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনও এমন ধারালো।
তবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, ‘‘অনেক রান্নাই এখন হারিয়ে যাচ্ছে। আগে শুধু বাড়ির গিন্নিরাই নন, বাড়ির বামুন ঠাকুররাও যথেষ্ট ভাল রাঁধতেন। তাঁদের হাতে হলুদ বাটা, জিরে বাটা দিয়ে রাঁধা সাদামাঠা ঝোলও ছিল অপূর্ব।’’
আর এখন?
তরকারির পদ খেতে চাইলে বাঙালির জোটে মিক্সড ভেজিটেবল কিংবা পনির বাটার মসালা।
ডাল চাইলে ডাল ফ্রাই!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্যুরিস্ট লজে এই ক’দিন আগে এক দল বাঙালি অতিথি ঢুকে তাজ্জব হয়ে গেলেন—‘‘ডিনারে চিকেন চাউমিনের সঙ্গে মাটন দোপিঁয়াজা নিন, ভাল লাগবে!’’
বলা যায় না, এটাই হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বং-বাঙালির আহ্লাদে চেটেপুটে খাওয়ার ‘ফিউশন ফুড’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy