Advertisement
E-Paper

বাতিল হওয়ার ভয়টা ইদানীং চেপে ধরে

কিন্তু ভাল কাজের ইচ্ছেটা এখনও মরেনি। অবজ্ঞা, অপমান, না-পাওয়ার নানা কথায় অকপট দুলাল লাহিড়ী। সামনে দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় ওঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে পাঠানো বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর চিঠিটা বহু দিন শ্রদ্ধাভরে তুলে রেখেছিলেন। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এ জমিদারের চরিত্রে ডাক পেয়েও শেষ মুহূর্তে ছিটকে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে, আজও গলা ধরে আসে।

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

ওঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে পাঠানো বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর চিঠিটা বহু দিন শ্রদ্ধাভরে তুলে রেখেছিলেন।

‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এ জমিদারের চরিত্রে ডাক পেয়েও শেষ মুহূর্তে ছিটকে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে, আজও গলা ধরে আসে।

পেশাদার তবলিয়া হয়ে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও বাজিয়েছেন। সেই তবলা বাজানোও ছেড়েছিলেন এক রাতের অপমানে।

আজও স্বপ্ন দেখেন ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ভুবন সোম’, কিংবা ‘জলসাঘর’-এর বিশ্বম্ভর রায়ের মতো কোনও চরিত্র যদি পান!

তিনি দুলাল লাহিড়ী।

পাবনায় সুচিত্রা সেনের পাশের বাড়িতে জন্ম নেওয়া আদ্যন্ত অভিনয়-মনা একজন মানুষ।

হঠাৎ মনোজ মিত্রর ফোন।

‘‘তোমাকে তপনদা এন-টি টু স্টুডিয়োতে নিয়ে যেতে বলেছেন।’’

তপন সিংহ সে সময় মনোজ মিত্রর ‘সুন্দরম’ নাট্যদলের নাটক দেখতে যান। ‘সাজানো বাগান’। তার পরই তিনি মনোজ মিত্রকে ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এ কাস্ট করেন।

জমিদার হচ্ছেন উত্তমকুমার। শাসন-এ বাগান তৈরি হয়েছে, ওখানেই শ্যুটিং হবে।

তার মাঝেই হঠাৎ সেই ঐতিহাসিক বোমাটি ফাটালেন উত্তমকুমার, ‘‘শ্যুটিং দু’মাস পিছিয়ে দিতে হবে। বম্বেতে কাজ পড়ে গেছে।’’

তপন সিংহর পক্ষে শিডিউল পিছনো সম্ভব নয়। ঠিক তখনই মনোজ মিত্রকে দিয়ে দুলাল লাহিড়ীকে ডাক পাঠান তপনবাবু।

যেতেই বলেন, ‘‘আমি ঠিক করলাম, জমিদার হোক দুলাল।’’

সারা শরীরে শিহরন খেলে গিয়েছিল শুনে। সাড়ে তিন দশক বাদেও সে কথা বলতে গিয়ে চোখ চকচক করে উঠল।—

‘‘ভেতরে ভেতরে কী যে হচ্ছে তখন আমার! উনি স্ক্রিপ্ট হাতে দিয়ে বললেন, তুমি আর মনোজ পাশের ঘরে গিয়ে একবার দেখে নাও। দেখব আবার কী! উত্তেজনায় ফুটছি। মনোজদা অন্য একটা ঘরে গিয়ে বললেন, ‘কিচ্ছু দেখতে হবে না! ও তো হুবহু সাজানো বাগান। তোমার সবটাই জানা।’ তাই রিহার্সালের নামে চুটিয়ে গল্প হল দু’জনের।’’

পরদিন। আবার গিয়েছেন। তপনবাবু, মনোজ মিত্র ছাড়াও সে দিন ভীষ্ম গুহঠাকুরতা, দেবিকা মিত্র রয়েছেন। খানিক বাদে এলেন প্রযোজক ধীরেশ চক্রবর্তী। তপনবাবুকে ডেকে বললেন, ‘‘একটু বাইরে আসবেন? কথা আছে।’’

দু’জনে বাইরে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরেও এলেন তপন সিংহ। গম্ভীর মুখ। চোখটা নামানো। প্রায় শোকাহতর মতো লাগছে।

ধীরে ধীরে বললেন, ‘‘স্যরি দুলাল, তোমায় নিতে পারছি না। উনি বলছেন, সিনেমায় মনোজ নতুন। তার ওপর আর একজন নতুন নেওয়াটা ঝুঁকির। জমিদার হবে দীপঙ্কর দে। ভেরি ভেরি স্যরি। পরের বার...।’’

কান-মাথা সব ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। তবু দুলাল বললেন, ‘‘না, না। ও ভাবে বলতে হবে না, প্রযোজক না চাইলে আপনি আর কী করবেন!’’

টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া স্বপ্নকে সঙ্গে নিয়ে উদভ্রান্তের মতো রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলেন দুলাল।

এর পর অবশ্য তপনবাবু ডেকেছিলেন ‘আদালত ও একটি মেয়ে’-তে। আর থিয়েটারে ওঁর গানের গলা শুনে ‘বৈদূর্য রহস্য’য়। গানও গাইয়েছিলেন। কিন্তু ‘বাঞ্ছারাম’ অধরাই রয়ে গেছে। দগদগে ক্ষত হয়ে।

সে বার ছিটকে গিয়েছিলেন। আরেক বার নিজেকেই সরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।

‘গৃহযুদ্ধ’ করবেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ডাক পড়ল।

‘‘ছোট্ট একটা চরিত্র। ইন্সপেক্টরের। করবেন?’’

সবিনয়ে বললেন, ‘‘করব। কিন্তু থিয়েটারের দিনগুলোয় আমি শ্যুটিং করতে পারব না।’’

সিনেমা-করিয়েদের কাছে তখন এই কথাটা নতুন নয়। থিয়েটারের তখন রমরমা সময়। বৃহস্পতি-শনি-রবি স্টেজ-শো। প্রযোজক-পরিচালকরা শ্যুটিং-এর সময় ঠিক করেন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থিয়েটারের কথা মাথায় রেখেই। তাই বুদ্ধদেবও রাজি হলেন দুলালের কথায়।

দিন কয়েক বাদে কৃষ্ণনগরে নাটকের কল-শো। এ দিকে সে দিনই আবার শ্যুটিঙের ‘ডেট’ ফেললেন পরিচালক। দুলাল বললেন, ‘‘আমি কী করে শ্যুটিং করব? আপনাকে তো আগেই বলেছি...।’’

রেগে উঠলেন পরিচালক, ‘‘এই জন্যই থিয়েটারওলাদের নিতে চাই না। আপনাদের নিলে হাজারটা ঝামেলা।’’

রাগে, অভিমানে বাড়ি ফিরে ঠিক করেছিলেন, এ ছবি আর করবেন না। এর পরেই অবাক কাণ্ড!

একজনকে দিয়ে ক্ষমা চেয়ে চিঠি পাঠালেন পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। চিঠি পড়ে চোখে জল এসে গিয়েছিল! ফিরে গিয়েছিলেন সেট-এ। বহু দিন শ্রদ্ধাভরে সে-চিঠি রেখে দিয়েছিলেন কাছে।

থিয়েটার-অন্ত প্রাণ। সে-শুধু গ্রুপ থিয়েটার বলে নয়, বাণিজ্যিক থিয়েটারের টানও তাঁর প্রবল। আর ঠিক এ কারণেই সংঘাত লেগে গিয়েছিল নিজের নাট্যদল ‘সুন্দরম’-এর সঙ্গে।

প্রযোজক হরিদাস সান্যালের ব্যানারে ‘রাজকুমার’ নাটক করবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সটান ‘সুন্দরম’-এর ঘরে এসে তিনি মনোজ মিত্রকে বললেন, ‘‘দুলালকে আমার চাই। তোমায় ছেড়ে দিতে হবে।’’

মনোজবাবু দুলালকে কী করে ছাড়বেন! গ্রুপ থিয়েটার মানে তো আর শুধু অভিনয় নয়, দলের অনেক কাজ আছে। দুলাল তার অনেক কিছুর দায়িত্বে। তখন ‘সাজানো বাগান’ চলছে। দর্শক দেখছে ভিড় করে। তার অভিনয়েও দুলাল। মনোজ মিত্রর মন বুঝে দুলাল বললেন, ‘‘যদি অনুমতি না দেন, করব না। কিন্তু সৌমিত্রদাকে সে কথা আপনাকে কিন্তু বলতে হবে।’’

থমকে গিয়ে গম্ভীর মুখে মনোজবাবু বললেন, ‘‘আপত্তি আর কী!’’

‘রাজকুমার’ করতে গেলেন দুলাল। প্রথামত দলের ঘরে বোর্ডে লেখা হল, ‘বৃহস্পতি-শনি-রবি দুলাল লাহিড়ী অভিনয় করতে পারবে। বাকি দিন অন্য কেউ করবে’।

সেই মতো তেমনই এক দিন অহীন্দ্র মঞ্চে গিয়ে দেখেন, দলের অন্য একজন তাঁর চরিত্রটিতে অভিনয় করবেন বলে মেকআপ নিয়ে বসে আছেন। দুলালকে ঢুকতে দেখে তিনি যেন ভূত দেখলেন!

মনোজবাবু বললেন, ‘‘আমি অনেক ভেবে দেখলাম, এ বার থেকে ও-ই করুক। তুই না থাকলে তবে অন্যরা করবে... এটা ঠিক ভাল হচ্ছে না।’’

মনটা চুরমার হয়ে গেলেও মানতে বাধ্য হলেন। এর পর থেকে গ্রুপে গেলেই বাণিজ্যিক থিয়েটার নিয়ে বাঁকা কথা। তখনই মনে মনে ইচ্ছে হয়েছিল, মনোজ মিত্রকেও যদি একদিন বাণিজ্যিক থিয়েটারে আনা যায়!

আচমকাই সুযোগ এসে গেল। প্রস্তাব হরিদাস সান্যালেরই। মনোজ মিত্রকে তিনি বোর্ডে আনবেন। রাজি করাতে হবে দুলালকে।

দুলালেরই অনুরোধে মনোজ মিত্রর বাড়িতে গিয়ে কথা বললেন প্রযোজক। প্রথম দিনেই কিছুটা হলেও যেন অন্য রকম শোনাল মনোজবাবুকে। দুলালকে বললেন, ‘‘ভদ্রলোক তো বেশ ভালই মনে হল। আমার সব শর্ত মেনে নিলেন।’’

পয়লা বৈশাখ প্রথম শো। মাঝে মাস তিনেক সময়। নিজের ‘সুখসারী’ নাটকটি থেকেই মনোজ মিত্র লিখলেন ‘দম্পতি’। কমেডি। হই হই করে সে-নাটক চলল। ‘সুন্দরম’-এর বোর্ডে লেখা হল, ‘মনোজ মিত্র বৃহস্পতি, শনি, রবি দলের শো করতে পারবেন না।’ তাতে মনে মনে যে কী প্রচণ্ড তৃপ্তি পেয়েছিলেন, আজও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই দুলালের। তবে আজও বলেন, ‘‘মনোজদার কাছেই আমার অভিনয়ের গ্রামার শেখা। আর সৌমিত্রদা (চট্টোপাধ্যায়) শিখিয়েছেন ডিসিপ্লিন।’’

‘‘রাজকুমার যখন হচ্ছে, গোলপার্ক-এ থাকতাম। সৌমিত্রদা তখন লেক অ্যাভিনিউ-তে। শো-এর দিন বেলা এগারোটা-সাড়ে এগারোটা নাগাদ চলে আসতেন ওঁর অ্যাম্বাসাডরটা নিয়ে। এর পর সোজা হল। ঢুকেই গট গট করে মঞ্চে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন প্রপস্, লাইট... সব। টানা ঘণ্টা দুই-আড়াই। প্রত্যেকদিন। তখনই বুঝেছিলাম, থিয়েটার করতে গেলে কী ভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খেয়াল রাখতে হয়, আর কতটা ডেডিকেশন লাগে কাজটা করতে,’’ কাঁকুড়গাছিতে ওঁর চার তলার ফ্ল্যাটে বসে বলছিলেন দুলাল।

যখন প্রফেশনাল অভিনয়ে আসছেন, তখন সত্যজিৎ রায়ের শেষ লগ্ন। তবু ‘ঘরে বাইরে’, ‘গণশত্রু’র ফ্লোরে যেতেন, কাজ দেখতে। মৃণাল সেনের সঙ্গে সম্পর্কটা নিবিড়। কিন্তু কারও কাছেই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেননি।

অঞ্জন দত্ত-র ‘ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা’য় আছেন। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ধূমকেতু’-তেও কাজ করলেন। বলছিলেন, ‘‘ওঁর ‘শব্দ’, ‘সিনেমাওয়ালা’ দুটোই আমার খুব ভাল লাগার ছবি। ওর মধ্যে একজন ‘তপন সিংহ’-কে দেখতে পাই আমি। ওর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে একটা ব্যাপার হল। ও সচরাচর আমায় অভিনয় নিয়ে কিছু দেখাতে চাইত না। বলত, তোমায় আবার কী দেখাব! শুধু ছোট্ট একটা জায়গায় একটা এক্সপ্রেশন করে দেখালো। আমি এত বছর অভিনয় করেও ওর মতো পারলাম না। ও অবশ্য আমারটাই মেনে নিল। কিন্তু সে দিন আবার করে বুঝলাম অভিনেতা হিসেবেও কৌশিক কত বড়!’’

কাজ করলেন মৈনাক ভৌমিকের সঙ্গেও। এখনও ডাক আসেনি সৃজিত মুখোপাধ্যায় বা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে।

বলছিলেন, ‘‘বাংলা ছবির ভালমন্দ নিয়ে যাই-ই তর্ক থাক, আমি কিন্তু নতুন যাদের সঙ্গে কাজ করলাম, একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, ওদের চরিত্র বোঝানোর ধরনটা বেশ অন্য রকম। প্রস্তুতিটাও।’’

এখনও ‘পারমিতার একদিন’-এর আগে অপর্ণা সেনের বাড়িতে ওয়ার্কশপের কথা ভুলতে পারেন না। কিংবা ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে কাজ করার সময় ফ্লোরে ওর ক্যামেরা বসানো নিয়ে খুঁতখুতানি, মনে গেঁথে আছে।

আর এঁদের সঙ্গে কাজ করার পরও প্রথম জীবনের পরিচালকদের কথা উঠলে দরদ উথলে ওঠে গলায়।—‘‘কী করে ভুলি স্বপন সাহা, সুজিত গুহ, অনুপ সেনগুপ্ত, হরনাথ চক্রবর্তী, প্রভাত রায়দের কথা? ওঁরাই তো আমায় পরিচিতিটা দিয়েছে। ফলতায় একবারের কথা মনে পড়ে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়িতে শ্যুটিং। মাত্র সাত দিনে আট লাখ টাকারও নীচে ছবি করেছিলেন স্বপন। ফিনফিনে কাগজের সেট। এতই পলকা, খুব সাবধানে নড়াচড়া করতে হত। কোত্থাও কিচ্ছু নেই, একটা ছাদে খচাখচ করে চকের দাগ কেটে অভিনেতা-অভিনেত্রী কে কোন ঘর থেকে অভিনয় করবেন, মাপজোক করে ফেললেন... অদ্ভুত ছিল ওঁর কাজের ঢং...! অ্যামেজিং!’’

মঞ্চ। সেলুলয়েড। তার বাইরে যদি প্রেম থাকে তো গান। জীবনেও শেখেননি, কিন্তু বরাবরই সুরে গান। আর বাড়িতে থাকলে গান তাঁর সারাক্ষণের সঙ্গী। তবলাটা শিখেছেন। তা’ও পাকেচক্রে। মা কিছুকাল সেতার শিখেছেন অন্নপূর্ণাদেবীর কাছে। তার পর গুরু অবশ্য অন্য একজন।

দুই বোনের একজন ধ্রুপদী গানে তালিম নিয়েছেন। অন্য জন বিরজু মহারাজের কাছে কত্থক শিখতেন।

এত জনের জন্য তবলিয়া রাখতে গেলে তো দেনার দায়ে পড়তে হবে! তাই ওঁর সঙ্গীতপ্রিয় বাবা দুলালকে তবলা শিখিয়েছিলেন পণ্ডিত নান্কু মহারাজের কাছে।

এতই নাম হচ্ছিল, কলেজে পড়ার সময় ডাক পেয়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাজাতে। তখনই পূরবী সিনেমা হল-এর এক কনসার্টে গিয়ে অপমানে অভিমানে এক রাতেই তবলার ইতি।

বাজাচ্ছিলেন এক সেতারিয়ার সঙ্গে। দু’জনেই জমিয়েছিলেন সে দিন প্রায় যুগলবন্দির মেজাজে। এ দিকে অনুষ্ঠান শেষ হতে আয়োজকদের নজর, আহ্লাদ, বিদায়ের তোড়জোড় সব সেই সেতারিয়াকে ঘিরেই। হাজার বার ডাক পেড়েও লাভ হয়নি। শেষে সবার অলক্ষ্যে একা বাজনা হাতে নিজেই ট্যাক্সি ধরে ফিরে এসে মা’কে সব শুনিয়ে বলেছিলেন, ‘‘প্রাপ্য স্বীকৃতির বদলে যেখানে অপমান জোটে, লাভ কী বাজিয়ে!’’

দেশভাগের সময় পাবনা থেকে উৎখাত হয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে যখন এ পারে চলে আসেন, তখন এক বছরও বয়স নয়।

স্কটিশ স্কুল, সুরেন্দ্রনাথ কলেজের গণ্ডি পেরনোর পর ওঁর হোসিয়ারি ব্যবসায়ী বাবা চেয়েছিলেন ছেলে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হোক। সে আর হল না। মঞ্চের পোকা যে কামড়ে বসেছে ছোট্ট বেলা থেকেই!

পাড়ায় কেষ্টদা (বিদ্যুৎ চট্টোপাধ্যায়) নাটক করাতেন। সেই সব দিনের কথা মনে আছে আজও। সন্ধের পড়া ফেলে জানলায় দাঁড়িয়ে জুলজুল চোখে রিহার্সাল দেখা, রাত্তিরে ঢালাইয়ের কাঠ চুরি করে স্টেজ তৈরি, সুপারি গাছ কেটে গেট, পাঠ্য বইয়ের খাঁজে নাটকের বই রেখে পার্ট মুখস্থ করা...।

বাবা ধরে ফেলেছিলেন। বকেননি। শুধু বলেছিলেন, ‘‘তোমায় আর পড়তে হবে না, শুধু যে কাজটা করতে চাইছ, মন দিয়ে করো।’’

তার পর থেকে অভিনয়। অভিনয়। আর অভিনয়। একটা দিনের জন্যও চাকরি করেননি।

কাঁড়ি কাঁড়ি মেগা সিরিয়াল করেছেন। তার মধ্যে ভাল লাগার কোনগুলো জানতে চাইলে ‘কুয়াশা যখন’, ‘শিশিরের শব্দ’, ‘সিংহবাহিনী’, ‘কমলাকান্তের জবানবন্দি’র মতো বেশ কয়েকটির নাম আওড়ান।

তার পরেও বলেন, ‘‘বড় পর্দার খিদে কি তাতে মরে! মাঝে মেগা করা ছেড়েও দিয়েছিলাম। ভাল্লাগছিল না। আবার রাজি হলাম। এই তো জর্জিয়া গেলাম, বহু দিন বাদে মেগা-রই কাজে।’’

বছর পাঁচেক অগে একটা ছবির পরিচালনা করেছিলেন। ‘বৃষ্টির ছায়াছবি’। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত প্রযোজক। সে ছবিও আটকে। বলছিলেন, ‘‘জেল পালানো এক আসামি তার প্রেমিকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এক বৃষ্টির রাতে। ছবিতে শুধু তারই গল্প। কাহিনি-চিত্রনাট্য মনোজদার (মিত্র)। সাহেব চট্টোপাধ্যায় নায়ক। ঋতু নিজে নায়িকা। কমলিকা, রাজেশ শর্মা, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীরা আছে। বিক্রম ঘোষের মিউজিক। এই ছবিটা মুক্তি পেলেও কিছুটা হয়তো বোঝাতে পারতাম ভাল কাজের চাওয়াটা আমার মধ্যে কী ভাবে বেঁচে।’’

অক্টোবরের ২৯-এ সত্তরে পড়ছেন। এখনও তর তর করে চার তলা ওঠেন-নামেন দিনের মধ্যে বারকয়েক। সাড়ে পাঁচটা থেকে মর্নিংওয়াক, জিম, প্রাণায়াম। কাজ না থাকলেও দিন ফুরোতে প্রায় রাত এগারোটা-সাড়ে এগারোটা।

নিয়ম করে ব্লগ লেখেন। ট্যুইটার, হোয়াটস্-আ্যাপ। কালেভদ্রে ফেসবুক। ছুটি থাকলেই সন্ধেবেলায় নাটক, সিনেমা। নয়তো স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। তাছাড়া নিজের নাটকের দল ‘যোজক’ তো আছেই।

দুই ছেলে বেঙ্গালুরুতে। দু’জনের সংসারে মাঝে মাঝে স্ত্রীর সঙ্গে বসে সংলাপের মক্সোও চলে। দিব্যি চাঙ্গা আছেন। তবু আজকাল যেন একটা আশঙ্কা ঘুণপোকার মতো জানান দিয়ে যায়। বলছিলেন, ‘‘কাজ না পাওয়ার, বাতিল হওয়ার ভয়টা মাঝে মাঝে চেপে ধরে। কত জন তো বলে, তুমি খুব পাওয়ারফুল অভিনেতা, তেমন করে ডাক আসে কই! অভিনয়টাই আমার জীবনের শেষ কথা। আমি অভিনেতা বাই চয়েস, নট বাই ডিফল্ট! বাবা-মা দু’জনেরই মৃত্যু সংবাদ যখন আসে, তখনও আমি কাজে। বিষাদের বৃষ্টি হয় মাঝে মাঝে। মনে হয়, কোনও নৈরাজ্যের বাসিন্দা হয়ে যাব না তো? ক্যামেরার সামনে কিংবা স্টেজে দাঁড়ালেই মনে হয়, ‘‘টাইম ইজ নাও, ইফ নট নাও, দেন হোয়েন?’’

সময়টা এখনই, তা যদি না হয়, আর কখন?

বাইরে পচা ভাদ্রের ভরদুপুরের আকাশটা গুম মেরে আছে! ঘরে গান বাজছে, ‘গগনে গগনে আপনার মনে... কী খেলা তব...।’

বৃষ্টি নামল বলে, এখনই।

তা যদি না’হয়, আর কখন?

Debshankar Mukhopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy