Advertisement
E-Paper

একটা ছোট কাজ দিলাম সেটাও পারলে না

তাঁকে এমনটাই যেন বলতে চেয়েছিলেন মাদার টেরিজা! তাঁর মাদার-সঙ্গের দিনগুলোতে ফিরলেন প্রাক্তন পুলিশ-কর্তা তুষার তালুকদার১৯৯৫ সালের কোনও একদিন।দিল্লিতে দু’দিন ব্যাপী সেমিনার করে শরীরে মনে বিধ্বস্ত।সকাল থেকে দু’এক বার চা কফি ছাড়া বিশেষ কিছু খাওয়া হয়নি। দুপুরে এলাহি লাঞ্চের আয়োজন উপেক্ষা করে দিল্লি প্রশাসনের সৌজন্যে প্রাপ্ত টিকিট ও হাতব্যাগ নিয়ে বিজ্ঞান ভবন থেকে সোজা পালাম বিমানবন্দরের দিকে রওনা দিলাম।

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৬ ০১:৪৭
নির্মল হৃদয়-এ

নির্মল হৃদয়-এ

১৯৯৫ সালের কোনও একদিন।

দিল্লিতে দু’দিন ব্যাপী সেমিনার করে শরীরে মনে বিধ্বস্ত।

সকাল থেকে দু’এক বার চা কফি ছাড়া বিশেষ কিছু খাওয়া হয়নি। দুপুরে এলাহি লাঞ্চের আয়োজন উপেক্ষা করে দিল্লি প্রশাসনের সৌজন্যে প্রাপ্ত টিকিট ও হাতব্যাগ নিয়ে বিজ্ঞান ভবন থেকে সোজা পালাম বিমানবন্দরের দিকে রওনা দিলাম।

বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে বিমানের সিঁড়িতে পা দিলাম যখন প্লেন ছাড়তে আর মিনিট পনেরো। তখন বিমানবন্দরে কড়াকড়ির যুগ শুরু হয়নি।

হাতব্যাগটি ওপরের বাঙ্কে রেখে সিটবেল্ট বেঁধে গুছিয়ে বসতেই দেখি পাশের সিটে অর্থাৎ জানালার ধারে বসে আছেন সদাপ্রসন্ন মাদার।

প্রাথমিক সম্ভাষণ শেষ না হতেই ছদ্ম ব্যঙ্গের সুরে মাদার বললেন, ‘‘বুঝলাম, তুমিই সেই ভিআইপি যার জন্য প্লেন ছাড়তে দেরি হচ্ছিল।’’

হাতঘড়ি দেখে অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘‘মাদার প্লেন ছাড়ার সময় এখনও কিন্তু হয়নি।’’

মাদার বললেন, ‘‘তোমার ঘড়ি কি তোমার মর্জিমতো চলে?’’

মাদারকে নিরস্ত করলাম। বললাম, আজ আমার জীবনের এক বিশেষ দিন। আজই প্রথম একজন নোবেল লরিয়েটের পাশে বসে যাচ্ছি।

মাদার হাসলেন।

দিল্লিতে একটি পুরস্কার গ্রহণের সময়

ছবি: জগদীশ যাদব

প্লেন ছাড়ার কিছু পরেই বিমানসেবিকা খাবারের প্যাকেট নিয়ে হাজির হলেন। বেশ ভালমতো খিদে পেয়েছিল। খাবার দেখে খিদেটা আরও চাগাড় দিল। প্যাকেটটা ট্রেতে রেখে মাদারের দিকে তাকালাম।

জানতাম উনি বাইরে কিছু খান না। অন্তত আমাদের বাড়িতে যে ক’বার এসেছেন আমার স্ত্রী সুষমার সনির্বন্ধ অনুরোধে শুধু জল খেয়েছেন। বলেছেন এই নিষেধাজ্ঞা মিশনারিজ অব চ্যারিটি-র প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য।

মনে পড়ল, বুদ্ধ তাঁর সঙ্ঘের ভিক্ষুদের জন্য একই নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন কয়েক হাজার বছর আগে। ভিক্ষুকরা শুধু মুষ্টিভিক্ষা সংগ্রহ করে সঙ্ঘে জমা করতেন।

সবিস্ময়ে দেখলাম মাদার খাবারের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে তাঁর ঝোলাব্যাগে ঢোকালেন। আর আমার প্যাকেটটিও হাতে তুলে একই জায়গায় নিক্ষেপ করলেন।

আমি কিঞ্চিৎ বিমর্ষ হয়ে অনুনয় করলাম, মাদার আমার সত্যিই খুব খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে চাই। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হল। মাদার তীব্র তিরস্কার ও শ্লেষ মিশিয়ে বললেন— ‘‘তোমার খিদে পেয়েছে? তোমার খিদে পায়? খিদে কি কখনও তোমরা টের পাও? সব সময়ই তোমাদের সামনে খাবার মজুত থাকে। খিদে টের পাবে কী করে? আজ যদি একটু খিদে টের পাও সে তো আনন্দের কথা। সব সময় মাথায় রেখো এই পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ প্রায় অনাহারে থাকে। তাদেরও খিদে পায়, তারা খাবার কুড়িয়ে বেড়ায়। তোমার নিজের শহরের এই রকম মানুষজন কত আছে, তুমি জানো কি? আজ তোমার খাবার এই রকম একজন ক্ষুধার্ত মানুষ খাবে। তোমার গর্বিত বোধ করা উচিত।’’

খিদে ও অপরাধবোধ নিয়ে আমি অধোবদনে রইলাম।

মাদারের ভর্ৎসনা মাঝে মধ্যে একটু চ়ড়া সুরেই হয়েছিল হয়তো। তাঁর দু’য়েকটি শব্দ বিমানসেবিকার কানে গিয়েছিল।

হঠাৎ দেখি সে আরও দু’প্যাকেট খাবার নিয়ে হাজির। ভুলেও তাকালাম না। মাদার হাসিমুখে তাঁদের যথাস্থানে পাঠিয়ে দিলেন।

প্লেন চলছে মসৃণ গতিতে।

মাদার সম্ভবত জপমালা হাতে নিয়ে নীরবে জপ করছেন। ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে কখন একটু ঘুমিয়ে পড়লাম।

তন্দ্রার ঘোরে স্পষ্ট দেখলাম শ্রাবস্তী নগরে করুণাময় বুদ্ধের আহূত সভায় আমিও উপস্থিত। নগরের পাত্রমিত্র-অমাত্য-শ্রেষ্ঠী সকলেই এসেছেন বুদ্ধের আহ্বানে। বুদ্ধ শ্রাবস্তীর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কথা সকলকে স্মরণ করিয়ে জানতে চাইলেন, ক্ষুধার্ত মানুষকে কী ভাবে দু’ মুঠো খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। এই প্রস্তাবে গণ্যমান্যরা সকলেই নতশির, নীরব রইলেন। শুধু রবীন্দ্রনাথের অনুপম ভাষায়— ‘‘বুদ্ধের করুণ আঁখি দুটি। সন্ধ্যাতারা সম রহে ফুটি।’’

এই অস্বস্তিকর নীরবতা ভঙ্গ করে উঠে দাঁড়ালেন সামন্ত জয়সেন। নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘যে আদেশ প্রভু করিছেন, তাই লইতাম শিরে/ যদি মোর বুক চিরে, রক্ত দিলে হত কোনও কাজ। মোর ঘরে অন্ন কোথা আজ?’’

সভাস্থলে আবার সেই নীরবতা। সকলকে সচকিত করে আবার সেই তরুণী ভিক্ষুণী এগিয়ে এলেন। তিনি ‘অনাথপিণ্ডদ-সূতা, বেদনায় অশ্রুপ্লুতা/ বুদ্ধের চরণ রেণু লয়ে, মধুকণ্ঠে কহিল বিনয়ে/ ‘ক্ষুধিতেরে অন্ন জোগাবার/ আজ আমি লইলাম ভার।’

নিস্তব্ধ সভাস্থলে যেন ঝড় বয়ে গেল। সবারই প্রশ্ন—এ কী ভাবে সম্ভব?

ভিক্ষুণী জানালেন ‘‘আমার ভাণ্ডার আছে ভরে/তোমা সবাকার ঘরে ঘরে।’’

অর্থাৎ এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়ে যাঁদের একটু অন্নসংস্থান আছে তাঁরা সেই সঞ্চিত অন্নের একটা অংশ ভাগ করে নেবেন একেবারে অন্নহীন মানুষদের সঙ্গে। তা হলেই কেউ একেবারে অভুক্ত থাকবেন না।

প্লেনে কিছু একটা ঘোষণা হচ্ছিল।

সেই আওয়াজে তন্দ্রাভঙ্গ হল। শুনলাম, আধঘণ্টার মধ্যে প্লেন দমদম এয়ারপোর্টে নামবে। দুই বিমানসেবিকা মস্ত বড় একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে অভুক্ত পরিত্যক্ত খাবার, খাবারের প্যাকেট, জলের গ্লাস সংগ্রহ করে ব্যাগে ভরতে লাগলেন। পুরো প্রক্রিয়াটি দেখাও বেশ অস্বস্তিকর।

হঠাৎ মাদার জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এই ব্যাগটা নিয়ে এ বারে ওরা কী করবে, একটু জেনে নিয়ে বলতে পারো কি?’’

উত্তরে বললাম, ‘‘আমি জানি।’’ ব্যাগটা কোথাও রাখা থাকবে। দমদমে প্লেন নামলে যারা প্লেন পরিষ্কার করে, সেই সাফাইকর্মীরা এই ব্যাগটা নিয়ে যেখানে প্লেনের সব পরিত্যক্ত আবর্জনা জমা হয় সেইখানেই রেখে দেবে।

মাদার শুধু বললেন, ‘‘এই ব্যাগটা আমার চাই। তুমি আমার হয়ে কথা বলো।’’

বোতাম টিপতেই বিমানসেবিকা এলেন। নিতান্তই অল্প বয়স, হয়তো সম্প্রতি কাজে নেমেছেন।

তাঁকে মাদারের প্রস্তাবটি পেশ করতেই, তিনি বিস্মিত হয়ে তাঁর সিনিয়রকে ডেকে দিলেন। স্টুয়ার্ড মহোদয়কে একই কথা বলতে উনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন এই ব্যাগটি যথাসময়ে ফেলে দেওয়া হবে। এর কোনও রকম অন্যথা করা সম্ভব নয়। এই কথা বলে তিনি তাঁর কাজে গেলেন।

মাদার শুনেছিলেন সব। তবুও আমি বিমানবিভাগের কর্মীর মতোই একই কথা মাদারকে বুঝিয়ে বলতে শুরু করলাম।

তিনি একরাশ বিরক্তি মুখে নিয়ে আমাকে থামালেন। বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন। আমার মনে হল, তিনি যেন বললেন, ‘‘তোমার মতো অপদার্থকে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়াটাই ভুল হয়েছে।’’

আবার বিমর্ষ হলাম।

কিছুক্ষণ পরেই আমাদের প্লেন ল্যান্ড করলে যাত্রীরা ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে মালপত্র নামিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আমি উঠতে যেতেই মাদার বললেন, ‘‘অপেক্ষা করো। সবাইকে নামতে দাও।’’

অতএব বসে পড়লাম।

সেখান থেকেই চোখে পড়ল চলমান সিঁড়িটা এসে প্লেনের দরজায় লেগে গেল। নিরাপদে ভ্রমণ-সমাপ্তির আনন্দে যাত্রীরা দ্রুত নামতে লাগলেন।

আমাকে নিতে অফিসের গাড়ি এসেছে। এয়ারপোর্ট থানার একজন অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন।

মাদার হাউজ থেকে মিশনারিজ অফ চ্যারিটির গাড়ি এসেছে মাদারকে নিয়ে যেতে।

প্লেন প্রায় ফাঁকা হয়ে যেতে সাফাইকর্মীরা উঠতে লাগলেন। অপেক্ষমাণ পুলিশ অফিসারও উঠে এলেন।

এ বার মাদার উঠলেন। পিছনে আমি।

তিনি সোজা ক্রু কেবিনে গিয়ে আবর্জনার ব্যাগটি দু’ হাতে উঠিয়ে নিলেন। সেই স্টুয়ার্ডটি এগিয়ে এসে হা-হা করে আপত্তি জানালেন।

মাদার সক্রোধে আপত্তি অগ্রাহ্য করলেন। আমি আমাদের অফিসারটিকে অল্প কথায় বুঝিয়ে বললাম মাদারের সংকল্প। পুলিশ অফিসার ব্যাপার বুঝে একজন সাফাইকর্মীর হাতে ব্যাগটি ধরিয়ে তাকে নিয়ে নামতে শুরু করলেন। মাদার ও আমি কথা না বাড়িয়ে অনুগমন করলাম। মাদারের গাড়ি পর্যন্ত গিয়ে বিদায় জানালাম।

মাদার স্মিতমুখে বললেন, ‘‘যাক তোমার একটা সাহায্য পেলাম।’’ ওই বিষয়টা (অর্থাৎ তাঁর তিন হাজার সন্তানকে দৈনিক খাওয়ানোর ব্যাপারটা) নিয়ে আমি একটু ভেবেছি। তোমার সাহায্য লাগবে। তোমাকে পরে খুলে বলব।’’

নানা কাজের ব্যস্ততায় এই অলৌকিক অভিজ্ঞতা একটু চাপা পড়ে গেল।

একদিন আমাদের পুলিশ সমিতির লোকজন এলেন তাঁদের বার্ষিক অনুষ্ঠানের বিষয়টি আলোচনার জন্য। কলকাতা পুলিশের প্রায় সকলেই এই সমিতির সদস্য।

ঠিক হল প্রধান অতিথি হবেন মাদার টেরেসা। তিনি যেহেতু ফুলের অপচয় ও পীড়ন অপছন্দ করেন তাই ঠিক হল চাল ও ডালের প্যাকেট দিয়ে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হবে।

নির্দিষ্ট দিনে মাদার এলেন অনুষ্ঠানে। এবং সকলের সঙ্গে সহাস্যে কথাবার্তা শুরু করলেন।

মাদারের হাতে চাল-ডালের প্যাকেট তুলে দেওয়ায় তিনি একটু যেন ছদ্মবিস্ময়ে আমাকে বললেন, ‘‘সে কি এইটুকু?’’

মাদারকে আশ্বস্ত করে বললাম কালই মাদার হাউজে দুটি লরি, প্রচুর চাল-ডাল আলু পেঁয়াজ, ও পুরনো জামাকাপড় নিয়ে পৌঁছোবে। মাদারের মুখ এক অপার্থিব সরল হাসিতে ভরে গেল।

সংবর্ধনার উত্তরে মাদার আমাদের সকলকে বিস্মিত করে নির্ভুল সহজ বাংলায় তাঁর বক্তব্য রাখলেন।

তাঁর আবেদন— আর্তজনের সেবায় সক্ষম মানুষেরা সর্বদাই যেন এগিয়ে আসেন সম্পূর্ণ নিজের গরজে, কারণ এ কোনও বুঝিয়ে বলবার বিষয় নয়। এটাই তাঁদের কর্তব্য।

কয়েক দিন পর মাদারের ফোন। বললেন, ‘‘তোমাদের সমিতির লোকদের আমার ধন্যবাদ জানিয়ো। তাঁদের পাঠানো চাল-ডাল কাপড়ে আমার ছেলেমেয়েদের বেশ কিছুদিন চলে যাবে। আর সেই সময়ের মধ্যে আমাদের প্ল্যানটাও চালু করতে হবে।’’

কয়েক দিন পরে লাউডন স্ট্রিটে আমার সরকারি আবাসে মাদার উপস্থিত হলেন তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে। তাঁর উপস্থিতি অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে তুলল চারপাশ। কিছুক্ষণ সকলের সঙ্গে হাসি- ঠাট্টা গল্প করে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, ‘‘এ বারে কাজের কথা।’’

আমার স্ত্রী তাঁকে একটু কিছু খাবার খেতে বললেন। তিনি সহজ কথায় বললেন, তিনি বা তাঁর মিশনের কেউই বাইরের কিছু খান না। সেটা তাঁদের নিয়মবিরুদ্ধ। শুধু একটু জল খেতে পারেন।

বুঝলাম যে শহরে, যে পৃথিবীতে এত নিরন্ন মানুষের হাহাকার, অনাহারে এত শিশুর অকালমৃত্যু—সেখানে খাবারের বিলাসিতা যে একেবারে নিষিদ্ধ আচরণ এই সার সত্যটা তিনি ও তাঁর মিশনের সব মানুষই সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চান।

প্রেমদান-এ নিজের জন্মদিনে

.আমার আবার কেন জানি না মনে হল, আমার সামনে যিনি উপবিষ্টা, তিনি যেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানুষ গৌতম বুদ্ধ। কঠোর উপবাস ও তপস্যায় গৌতম বুদ্ধ বুঝতে চেয়েছিলেন জীবনের সারসত্যকে। উপবাসে মৃতপ্রায় হয়ে তিনি উপলব্ধি করেন ক্ষুধার নিবৃত্তিই মানব জীবনের প্রধান সত্য।

মাদার সহজেই বুঝিয়ে দিলেন, ক্ষুধার্তের অন্ন জোগাবার পরিকল্পনা।

তিনি বললেন, ‘‘জানো তো বড় বড় হোটেল রেস্তোরাঁয় দিনের শেষে অবিক্রিত খাবার নষ্ট করে ফেলা হয়। সেই খাবারটা সংগ্রহ করে আমার তিন হাজার ছেলেমেয়েকে খাওয়াতে হবে। তোমার কাজ হবে দোকানগুলো চিহ্নিত করে এই প্রস্তাবে রাজি করানোয়। এই খাবার সংগ্রহ করে আমাদের হাতে তুলে দেবে আমাদের সহযোগী এনজিও-র কিছু ভলান্টিয়ার। ওদেরকে বলে দেব তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে,’’ এই কথা বলে মাদার উঠে পড়লেন।

আমার মনে পড়ল প্লেনের ঘটনা।

কয়েক দিন পরে এনজিও-র প্রতিনিধিরা এলেন। তার মধ্যেই আমাদের কাজের অংশটা করে ফেলা শুরু হয়েছে। ভালই সাড়া পাওয়া গেছে।

আলোচনায় সিদ্ধান্ত হল প্রথমে তিরিশটা হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে খাবার সংগ্রহ শুরু হবে। রেফ্রিজারেটেড স্টোরেজ সমন্বিত গাড়ির ব্যবস্থা করবেন ওঁরা। আমরা পরিচয় করিয়ে দেব যাঁরা উদ্বৃত্ত খাবার দেবেন তাঁদের সঙ্গে। প্রথম সাতদিন আমাদের লোকজনও থাকবে ব্যবস্থাটি সুষ্ঠু ভাবে চালু করতে।

বেশ কিছু দিন কেটে গেল।

মাদার বিদেশে গেলেন যেমন তাঁকে যেতে হয় মাঝেমধ্যে। এনজিও-র সাড়াশব্দ নেই। কখনও দেখা হয়ে গেলে বলেন, আমরা প্রস্তুত হচ্ছি। মাদার ফিরে এলেই একটা বড় প্রেস কনফারেন্স করে কাজটার উদ্বোধন হবে।

যদি বলা হয় কাজটা শুরু করে দেওয়া হোক, উত্তর দেন, স্পনসররা রাজি নয়। বুঝলাম মাদারকে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স হলে তবেই স্পনসররা টাকাপয়সা দেবেন। না হলে নয়। আর টাকা পয়সা পেলে তবেই গাড়ি কিনে এই কাজের জন্য তৈরি করা হবে। ততদিন ক্ষুধার্তরা অপেক্ষায় থাকুন।

আমরাও অপেক্ষা করি মাদারের প্রত্যাবর্তনের। এই বিজ্ঞাপন-স্পনসর সমন্বিত জগতের সঙ্গে আমাদের বিশেষ পরিচয় নেই।

বেশ কিছু দিন পরে মাদার ফিরে এলেন। ফিরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একটু সুস্থ হতে, একদিন দেখা হল। ম্লান হেসে বললেন,
‘‘কাজটা শুরু হল না তো!’’

শিশুভবনের দরজায়, ১৯৫৮

চুপ করে রইলাম।

কীই বা বলতে পারতাম!

অল্প দিন পরে আমার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। তার কিছু দিন পরে মাদারও পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। ক্ষুধার্তের অন্ন জোগানোর জন্য মাদারের পরিকল্পনা সম্ভবত পরিত্যক্ত হল। তিনি বুদ্ধের মতো জীবনের সারসত্য বুঝেছিলেন। আমরা অকৃতী, অধম। তাই মনপ্রাণ দিয়ে এই সত্য গ্রহণ করিনি। খুব ছোট করেও কাজটা শুরুই করতে পারিনি।

এই সহজ, সরল, প্রচারবিমুখ নিঃস্বার্থ বিদেশিনি সঙ্গত কারণেই এই শহরটিকে কর্মক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এই শহর তাঁকে নানা ভাবে উত্ত্যক্ত করেছে।

কেন তিনি পরিত্যক্ত অথবা সহায় সম্বলহীন মানুষকে, কুষ্ঠ রোগীকে পথ থেকে তুলে আনেন, তাঁদের খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন সাধ্যমতো—এই প্রশ্ন উঠেছে বারে বারে।

বলা হয়েছে তিনি সি আই এ-র চর। আজ তিনি সব প্রশ্নের উর্ধ্বে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। তাঁকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ভ্যাটিকান সিটিতে সেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হবে।

তাঁকে এত কাছে পেয়েও মনে প্রাণে নির্দেশ গ্রহণ করতে পারলাম না—এই অনুশোচনায় ক্রমাগত দগ্ধ হই। বুঝতে পারি আমরা তাঁর কাজের যোগ্য হতে পারিনি। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।

যেদিন হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেন সেদিনই আমার জন্ম।

সেই যুদ্ধের ভয়াবহতার আঁচ নিতান্ত বাল্যকালেই টের পেয়েছিলাম। ব্ল্যাক আউট, সাইরেনের তীব্র আওয়াজ, রাস্তায়-ঘাটে ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড়, রেশনের দোকানে ভিড় —সবই মনে পড়ে।

অনেক কথা কানে গেঁথে যেত বড়দের নিরন্তর আলোচনা শুনে। শুনতাম নেতাজি আসছেন আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে। দেশ স্বাধীন হবে। সব সমস্যার সমাধান হবে। মনে আছে, সারাদিন করুণ সুরে অন্নহীন মানুষের আর্তনাদ—‘একটু ভাতের ফেন দেবে গো!’

তাঁরা জানতেন ভাত রান্না হওয়ার পর ভাতের ফেন সাধারণত ফেলে দেওয়া হয়। সেইটুকুই তাঁরা চাইতেন।

মা একদিন রাতে খাবার পরে উদ্বৃত্ত কয়েকটি রুটি আমাকে অর্থাৎ চার পাঁচ বছরের শিশুর হাত দিয়ে বাড়ি নীচে আর্তনাদ মুখর আন্নপ্রার্থীদের দিয়ে আসতে বললেন। আমি নীচে নামতেই তাঁরা এগিয়ে এলেন। তাঁদের হাতে সেই রুটি দিয়ে কেন জানি না ভয় পেয়ে আমি ছুটে ফিরে এলাম। সেই স্মৃতি কখনও মন থেকে মুছে যায়নি।

বড় হয়ে জেনেছি খেতে না পেয়ে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ সেবার মারা গিয়েছিলেন। তাঁদের খাবার চালান হয়ে গিয়েছিল খুব লাভজনক যুদ্ধের রসদ হয়ে।

জেনেছিলাম তাঁরা কখনও কোনও খাবারের দোকান, কালোবাজারির ভাণ্ডার— কিছুই লুঠ করতে যাননি। তাঁরা নির্ভর করেছিলেন যাঁরা খেতে পান তাঁদের শুভবুদ্ধি, সহানুভূতির জন্য। যুদ্ধের নির্মমতা, অনিশ্চিত স্থায়িত্ব যেন সবাইকেই নির্মম করে দিয়েছিল।

তার পরে প্রায় এই একই দৃশ্য দেখেছি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বাংলা ভাগ হওয়ার পর।

তার পরে আরও কত কী ঘটল নানা দেশে। আমরা বুদ্ধি দিয়ে বুঝে নিলাম দেশের সমাজের ব্যাপক পরিবর্তন না ঘটলে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এই ভাবেই অনাহারে থাকবেন। হৃদয় দিয়ে অনুভব করলাম এ শুধু ভাবের ঘরে চুরি।

এ ভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া যে মানুষের চরম স্বার্থপরতা মাদার টেরেসা অথবা অনাথপিণ্ডদ-সূতা এ কথা সহজেই বুঝেছিলেন।

তাই তাঁরা বলতে পেরেছিলেন ‘ক্ষুধার্তরে অন্ন জোগাবার আজ আমি লইলাম ভার।’

মাদারের ছবির দিকে তাকিয়ে দেখি তাঁর মুখে মৃদু হাসি।

চোখে নীরব ভর্ৎসনা।

যেন বলছেন, ‘একটা সহজ ছোট কাজ দিলাম সেটাও করতে পারলে না।’

আত্মধিক্কারে নতশির হই।

Mother teresa
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy