Advertisement
১৯ মে ২০২৪

সন্ত টেরিজা

ভ্যাটিকানের এই ডাক পেতে আর মাত্র কয়েক দিন। তার আগে আঠারো বছরে তাঁর গৃহত্যাগ, জাহাজে কলকাতা পাড়ি, কোঁচড়ে পাঁচ টাকা মাত্র সম্বল করে ধীরে ধীরে ‘মাদার টেরিজা’ হয়ে ওঠার কাহিনি জুড়ছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য আর তো সপ্তাহ তিনেক পর মাদার টেরিজাকে সেন্টহুডে বরণ করতে চলেছে ভ্যাটিকান। এক দশক আগেই এই ধরনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল ওঁর বেয়াটিফিকেশন বা আশীর্বাদধন্য হওয়া দিয়ে। যাকে ধরা হয় ক্যাননাইজড হওয়া বা সন্ত হয়ে ওঠার আগের পর্ব।

চিত্রণ: শেখর রায়

চিত্রণ: শেখর রায়

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৬ ০২:১৪
Share: Save:

আর তো সপ্তাহ তিনেক পর মাদার টেরিজাকে সেন্টহুডে বরণ করতে চলেছে ভ্যাটিকান।

এক দশক আগেই এই ধরনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল ওঁর বেয়াটিফিকেশন বা আশীর্বাদধন্য হওয়া দিয়ে। যাকে ধরা হয় ক্যাননাইজড হওয়া বা সন্ত হয়ে ওঠার আগের পর্ব।

বেয়াটিফিকেশন পর্বে খোঁজ শুরু হয় আশীর্বাধন্যের ঘটানো অন্তত দুটি মিরাকল বা অলৌকিক কীর্তির। মাদারের জীবনের এমন কি‌ছুর খোঁজ রাখি কিনা জানতে আমার কাছে সে-সময় একটি ছোট্ট দল এসেছিল।

মিরাকল? বলেছিলাম, ‘‘মাদার টেরিজার মিরাকল তো একটা নয়, অজস্র।’’

হাসতে হাসতেই সেই ছেলেরা টেপ রেকর্ডার খুলে বলল, ‘‘বলুন তা হলে, শুনি।’’

বললাম, ‘‘প্রথম মিরাকলটা মাদার টেরিজা নিজে।’’

ছেলেরা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘‘হ্যাঁ, আরও দু’জন এই কথাটা বলেছেন।’’

সেই দু’জনের মধ্যে বিখ্যাত টেনিস প্লেয়ার নরেশ কুমারের স্ত্রী সুনীতা কুমার ছিলেন কিনা জানি না। তবে বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত তাঁর ‘ব্লেসেড টেরিজা অব কলকাতা’ বইয়ে এমন কয়েকটি বৃত্তান্ত শুনিয়েছেন যা সন্ন্যাসিনীকেই মিরাকল হিসেবে তুলে ধরে।

গৃহত্যাগের পর, ১৯২৮

একটি যেমন: মাদার এক কুষ্ঠরোগীর পুঁজ, রক্ত ও গলা মাংসের ক্ষত ধুয়ে ব্যান্ডেজ পরাচ্ছিলেন। পাশে দাঁড়ানো এক অতিথি বললেন, ‘‘এক মিলিয়ন ডলার দিলেও এ কাজ আমি করব না।’’

মাদার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘‘আমিও না।’’ তার পর একটু থেমে বললেন, ‘‘আমি করি আমার যিশুর জন্যে।’’

সুনীতা লিখছেন যে এহেন বেদনার ও মন-খারাপ করা পরিবেশে— আমার, আপনার মতো মানুষের কাছে— মাদার কিন্তু সারাক্ষণ হাসি আর আনন্দে টগবগ করতেন। যে-হাসি আর মেজাজটা ক্রমশ ছোঁয়াচে হয়ে গেল। একটা সময় মিশনারিজ অফ চ্যারিটির বাইরে থেকে সুনীতার মতো আরও যাঁরা মায়ের কাজে হাত লাগাতে আসতেন তাঁদেরও ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে গেল। চারিদিকের কষ্টদুঃখের মধ্যেও ওঁদের মুখের হাসিটা মুছে গেল না।

সুনীতার আরেকটি বৃত্তান্ত এ রকম— আশ্রমের কাজের জন্য টাকা জোগাড় করতে মাদারকে প্রায়ই বিদেশ পাড়ি দিতে হত। জেট ল্যাগের বালাই নেই। কোথাও একটা নেমে পড়ে ওঁর টো-টো করে ঘোরা শুরু হয়ে যেত। তো এরকম এক সফরে ওঁর সঙ্গী হয়ে দু’দিনেই সুনীতার দম ছুটে গেল। রাত দুটো অবধি কাজ করে ফের সকাল থেকে দৌড়। হাঁফাতে হাঁফাতে কবুল করতেই হল, ‘‘মাদার, আর তো পারিনে। আপনি চালাচ্ছেন কী ভাবে?’’

মাদার হেসে উত্তর করেছিলেন, ‘‘আমি আমার ট্যাঙ্ক ভরে নিই প্রার্থনা দিয়ে।’’

পড়তে পড়তে মনে হল সুনীতা মা’কে সে দিন জিজ্ঞেস করলে পারতেন, ট্যাঙ্কটা শরীরে, না মনে?

কারণ শরীরের ট্যাঙ্কে মাদার কী ভরতেন তা সারা দুনিয়ার জানা। একখানা রুটি, একটু ট্যালটেলে ডাল আর খানিকটা সবজি— এই ছিল মাদারের আহার। উদ্বিগ্ন হয়ে পটনার মিশনারিজে ডাক্তার মাদার ডেঙ্গল ওঁকে বলেছিলেন, ‘‘এ ভাবে চললে আপনার দরিদ্রসেবার কী হবে?’’

মাদার কথা শুনলেন; তাতে ফল হল। উনি প্রাতরাশে একখানা রুটি, একটু সবজি নিংড়ানো তেল, একটা কলা আর এক কাপ চা খাওয়া ধরলেন। মধ্যাহ্নভোজে একটু ভাত আর মশলাবিহীন এক জলো তরকারি খাওয়া শুরু করলেন (কারণ গরিবরা এর বেশি খেতে পায় না); আর রাতের বেলায় শুধু এক-দেড় হাতা খিচুড়ি!

এর সঙ্গে একটু ফল খাওয়াও মেনে নিয়েছিলেন ডাক্তারের পরামর্শে। কী ফল? না, শশা আর পেঁয়াজ!

মাদারের দেখাদেখি আশ্রমের অন্য সন্ন্যাসিনীদের দিনের আহার্যও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল এটাই। শুধু সন্ন্যাসিনীই নন, সুনীতার মতো বহিরাগত সহায়িকাদেরও তিনি বলতেন, ‘‘গরিব মানুষের জন্য কাজ করার সময় আমি চাইব তোমরা খাওয়াদাওয়া কোরো না।’’

সেই মতো বাইরে থেকে আসা সেবাকর্মীরা লম্বা-লম্বা কাজের সময় কাটিয়ে দিয়েছেন শুধু জল খেয়ে, কখনও-সখনও হয়তো একটা কফি।

এই খাওয়ার পরেও মাদার ছুটি-বিশ্রামের ধারপাশ দিয়ে যাবেন না। কেন বিশ্রাম নেন না, এই অনুযোগ করাতে শুনতে হয়েছিল, ‘‘আমাদের বিশ্রাম স্বর্গে তোলা আছে।’’

সুনীতার শোনানো মাদারের আরেক মজার উক্তি শুনিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যাব।...

ভারতে আসার সময়, ১৯২৮

এক দিন কথায় কথায় মাদার বলেছিলেন, ‘‘দ্যাখো, কত বছর ধরে ইস্কুলে ভূগোল পড়িয়েছি। তখন কি ছাই জানতাম যে যত জায়গাটায়গা নিয়ে পড়াচ্ছি তার চেয়েও বেশি জায়গা ঘুরে ফেলব!’’

তবে যত দেশ-দুনিয়াই ঘুরুন, খুব শিগগির যিনি সেন্ট টেরিজা অফ কলকাতা হবেন তাঁর পা সরেনি এই কান্নাহাসির দোলদোলানির শহর থেকে। সুনীতাকে এক বার গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘আমি স্বনির্বাচনে ভারতীয়, তুমি তো দৈবক্রমে।’’

মাদারের মিরাকলের হদিশ নিতে যে-ছেলেরা এসেছিল, তাদের দ্বিতীয় মিরাকলের ব্যাপারটা একেবারে সাল-তারিখ দিয়ে বলেছিলাম।

বললাম, ‘‘দ্বিতীয় মিরাকলটা ঘটল ১৯৪৮-এর ১৮ অগস্ট। মাদার টেরিজা যে দিন ওঁর বিশ বছরের আশ্রয়স্থল লোরেটো কনভেন্ট ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলেন একটা নীল পাড় সাদা শাড়ি পরে, কোঁচড়ে পাঁচটা টাকা।

‘‘কোঁচড়ে পাঁচটা টাকা আর মহিলা স্বপ্ন দেখছেন মিশনারিজ অব চ্যারিটি স্থাপনের। যাঁরা দুঃস্থ আর্ত অভাগাদের জন্য সেবায় মাতবেন।

‘‘আজ যখন বিশ্বের ১৩৩টি দেশে ৪৭১০ জন সন্ন্যাসিনীর ৪৭০টি সেবাস্থলে কাজ করার কথা শুনি, তখন মনে হয় এই আরেক মিরাকল।’’

ছেলের দল জিজ্ঞেস করল, ‘‘মাদার নিজে কী চোখে দে‌খতেন, তাঁর এই কাজকে?’’

বলতেই হল, ‘‘কক্ষনোই মিরাকলের ধারপাশের কিছু না। প্রেম, প্রেম, শুধু প্রেম। প্রভু যিশুর প্রতি তাঁর প্রেমিকার প্রেম।’’

যখন এ সব কথা হচ্ছে তখনও কিন্তু মাদারের ‘কাম বি মাই লাইট: দ্য প্রাইভেট রাইটিংজ’ বইটি প্রকাশিত হয়নি। যেখানে কনভেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসা নিয়ে মাদার লি‌খছেন, ‘‘নিজের পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে আসতেও এত কষ্ট হয়নি, যতটা লোরেটো ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হচ্ছে।’’

কলকাতার আর্চবিশপ পেরিয়ারকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘বস্তির দিকে আমার প্রথম পদক্ষেপটা নিয়ে ফেলেছি।... দয়া করে, ফাদার, আমার জন্য প্রার্থনা করুন যাতে আমি আনন্দের সঙ্গে প্রভুর দিকে চোখ মেলে থাকতে পারি।’’

লোরেটো ছাড়ার কষ্টের পাশাপাশি ওঁর ডায়েরিতে একটা ছোট্ট প্রার্থনা লিখেছিলেন মাদার যেটা চিরকাল তাঁর সঙ্গে ছিল। লিখেছিলেন—

‘‘হে যিশু, আমার হৃদয়ের একমাত্র প্রেম, আমি যে-কষ্ট পাচ্ছি তা আমি পেতেই চাই। আর তুমি যত-যা কষ্ট আমায় দিতে চাও তা-ও। সে-জন্য তোমার প্রতিশ্রুত কোনও পুরস্কারও কামনা করি না, প্রভু। তোমার প্রেমে যত-যা দুঃখ সই সে শুধু তোমার প্রীতিতে, প্রশংসায়, বন্দনায়।’’

দার্জিলিং-এ, ১৯৩৭

‘কাম বি মাই লাইট’-কে কেন ‘প্রাইভেট রাইটিংজ’ বলা হল সেই কৌতূহল বইটা পড়ার আগে অবধি ছিল। চোখ মুছতে মুছতে পড়া শেষ করে মনে হল এমন ব্যক্তিগত অনুভূতির রচনাকে ‘কাম বি মাই লাভ’ বললেও ত্রুটি হত না। কারণ কনভেন্ট থেকে ছাড়া পেয়ে রাস্তায় নেমে কাজ করার জন্য দু’বছর ধরে মাদার যে-অনুমতি ভিক্ষা করেছেন চিঠিতে-চিঠিতে মাদার সুপিরিয়র এবং আর্চবিশপের কাছে, সে-সবই বড় অংশ জুড়ে এ বইয়ের। ‘আলো কোথায়? কোথায় আলো?’ এই হাহাকারই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে। যাকে তুলনাও করা হয়েছে ক্রাইস্টের ‘ডার্ক সেইংজ’-এর সঙ্গে। অথচ সব হাহাকার তলিয়ে যায় শুধু একটি শব্দের ভারে, ব্যবহারে— লভ। প্রেম।

মিরাকলের খোঁজে আসা ছেলেদের হাতে এই বইটাই তুলে দিয়ে বলতে পারতাম, ‘‘এই নিন মায়ের মিরাকল।’’ বলতে পারতাম, ‘‘মিরাকলের চেয়েও বড় মিরাকল নয় কি লভ?’’ কিন্তু তখনও তো বইটা হয়নি।

বইটা হতেও যে পেরেছিল সেটাও একটা মিরাকল। কারণ মঠ ছাড়ার পর থেকেই মাদার দিনের পর দিন ধরে আর্চবিশপের কাছে অনুনয়-বিনয় করেছেন ওঁর চিঠিপত্র, যাবতীয় দলিল পুড়িয়ে ফেলার জন্য।

আর্চবিশপ পেরিয়ের এবং তাঁর গির্জার পাদ্রিরা যে শেষ অবধি তা করেননি সে-জন্য উত্তরকাল চিরকৃতজ্ঞ থাকবে তাঁদের কাছে। মৃত্যুশয্যায় মহাকবি ভার্জিল তাঁর ‘ইনিড’ মহাকাব্যের পাণ্ডুলিপি শিষ্যদের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন সে-সব পুড়িয়ে ফেলতে। ‘দ্য ট্রায়াল’, ‘দ্য ক্যাসেল’ এবং যাবতীয় অপ্রকাশিত রচনা বন্ধু ম্যাক্স ব্রড-কে দিয়ে ফ্রানৎজ কাফকার অনুরোধ ছিল সেগুলো যেন ধ্বংস করা হয়। সভ্যতার সৌভাগ্য ভার্জিলের শিষ্যরা ও ম্যাক্স ব্রড তাঁদের কথা রাখেননি। ফার্ডিনান্ড পেরিয়েরও ইতিহাসে থেকে যাবেন মাদারের প্রতি আনুগত্যের এই অভাবটুকুর জন্য।

‘কাম বি মাই লাইট’ প্রকাশ পেয়ে একটা ছোট্ট মিরাকল ঘটিয়ে তুলেছিল আমার জীবনে। বইয়ের ভেতরকার গল্পে যাবার আগে সেই গল্পটুকু শোনালে দোষের হবে না। একটু শোনাই—

মাদারকে আমার দেখা খুব হালফিল নয়।

তাঁর মিশনারিজ অব চ্যারিটির প্রথম অপিস আমাদেরই পিছনের রাস্তায় ১৪নং ক্রিক লেনে।

যাঁদের বাড়িতে অপিস সে-বাড়িরই ছেলে নিকোলাস (আমরা ডাকতাম নিকু) গোমস আমার বন্ধু। ওর পিসি পলা-ও মঠের আদ্যিকালের সন্ন্যাসিনী। কলেজে পড়ার সময় থেকেই গরিব ছেলেমেয়েদের ক্রিশ্চান মিশনারি ইস্কুলে বিনি পয়সায় পড়ার সুযোগ করাতে নিকুর সঙ্গে মাদারের কাছে গেছি। একটি বারও ফিরিয়ে দেননি মা।

তার পর এক বার এক বন্ধুর ছোট ভাইকে বাসন্তীর সেন্ট জেভিয়ার্সে ফ্রি বোর্ডিং ও পড়ার ব্যবস্থা করাতে গেলে মাদার তৎক্ষণাৎ একটা সুন্দর চিঠি লিখে দিলেন সেখানকার বড় কর্তা ফাদার বেকার্সকে।

এই ফাদার বেকার্সের সঙ্গে তার বহুকাল আগের থেকে আমার পরিচয়। তিনি চিঠিটা পড়েই বললেন, ‘‘হায় হায়, ফের মাদারের চিঠি! ওঁর পাঠানো ছেলেতেই তো স্কুল ভরে যাবে।’’

তার পর একটু থেমে, হেসে বললেন, ‘‘ঠিক আছে। মাদারের অনুরোধ তো! নিয়ে নিলাম।’’

মাদার, ১৯৬২

এ রকমই একদিন কী একটা কারণে, কেন জানি না একটা আলোচনা শুরু হয়েছিল মাদার শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পাবেন কিনা। সে-সময় কোথাও কোনও সাড়াশব্দ ওঠেনি ওঁর পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে। ১৯৭৯-তে ওঁর নোবেল-প্রাপ্তির ঝাড়া দশ বছর আগে।

ফের যে মাদারের কাছে যাওয়া শুরু হল, সেটা ১৯৯১-এর শীতকালে। আনন্দবাজার-এর পরিকল্পনা ছিল মাদারের বাংলায় বলা আত্মজীবনী রেকর্ড করে যেন বই লিখি। মঠের ঘনিষ্ঠ গোমস পরিবারেরও খুব উৎসাহ ছিল এ ব্যাপারে। বলা হচ্ছিল, কলকাতার মায়ের স্মৃতিচারণা তো বাংলাতেই হওয়া উচিত। অত সরল, সুন্দর বাংলা বলেন।

সেই মতো শীতের ভোরে—ছ’টার আগেই— হাজির হতাম মিশনারিজ অব চ্যারিটির ওপরতলার বারান্দায়। দেখতাম কত বিদেশি তরুণ-তরুণী চাল ডাল গমের বস্তা নিয়ে লাইন করে দাঁড়িয়ে। দূর দূর দেশ থেকে এসেছে মায়ের দর্শন নিতে এবং সাধ্যমতো ওঁর কাজের উপকারে আসতে। মাদার নিজের হাতে সেই উপহার নিতেন। জনে জনে আশীর্বাদ করে যিশুর ছবি দেওয়া মালা, ট্রিঙ্কেট চার্মজ উপহার করতেন। আমার সঙ্গীনীকে বারবার বলতেন, ‘‘তুমি রান্না করো তো? সে-সময় রোজ এক মুঠো চাল সরিয়ে রাখবে আমার সন্তানদের জন্য। তারপর মাস শেষে আমায় দিয়ে যাবে।’’

আর আমি ওঁর বাংলা কথা রেকর্ড করে বই করব বললে আমার মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে বাংলাতেই বলতেন, ‘‘বাবু, তুমি আমাদের কাজগুলো ঘুরে দেখো। আমি কেউ না, সত্যিই কেউ না। সবই প্রভু যিশুর ইচ্ছায় হচ্ছে। তিনিই করান। তাঁর সন্তানদের তিনিই বাঁচান। তুমি সেই কাহিনিগুলোই লেখো।’’ বলে আমারও হাতে হার, ছবি তুলে দিতেন।

এক দিন একটা টুলে বসিয়ে বললেন, ‘‘বাবু, আমি তো একটা অজ্ঞ, মূর্খ, গাঁয়ের মানুষ। আমার জীবন শুনিয়ে কী হবে? কিচ্ছু নেই ওতে। তুমি যিশুর কাজের কথা লেখো।’’

তর্ক করার জন্য বললাম, ‘‘সেন্ট টেরিজা অব আভিলার কথা তো আমরা পড়ি। পড়ি না কি?’’

মাদার প্রায় জিভ কেটে বললেন, ‘‘ওরে বাবা, কত বড় সেন্ট উনি! দেবী না কী যেন বলো তোমরা, ওঁর সঙ্গে আমার তুলনা হয়?’’

এই সব রেকর্ড করব বলে যেই টেপ রেকর্ডার বার করেছি, অমনি নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। ঠোঁটে এক পবিত্র হাসি।

এ ভাবে গিয়ে গিয়ে শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। মাদার রাজি হলেন না বলে ভেতরে একটা বেদনাও তৈরি হয়েছিল। বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নয়, তবে একটা কষ্ট। মাদারের নিজের বাংলায় তাঁর নিজের কথা— আহা!

‘কাম বি মাই লাইট: দ্য প্রাইভেট রাইটিংজ’ পড়তে পড়তে চোখের জলে আমার সব কষ্ট ধুয়ে সাফ হয়ে গেল। লজ্জায় বই থেকে মাথা তোলা মুশকিল হল। যে-মহীয়সী ভিখারির জীবন বরণ করেছেন ভিখারির সেবায়, নিজের অতীত মুছে দিতে চেয়েছেন অবিরত, তাঁর স্মৃতিকথা যাঞ্চা করে কী আদিখ্যেতাই না করেছি!

আমাকে শিক্ষা দেবার জন্যই যেন বই শুরু হচ্ছে আঠারো বছরের গন্শা আগ্নেস বোয়াকশিউর গৃহত্যাগ দিয়ে। ১৯২৮-এর ২৬ সেপ্টেম্বর লোরেটো সিস্টার্স-এ যোগ দেবার জন্য ভবিয্যতের মাদার টেরিজা যখন স্কোপিয়ে-র বাড়ির বাইরে পা রাখছেন, ওঁর মা ওঁকে বিদায় দিয়ে বলছেন—

‘‘হাত রাখো তাঁর (যিশুর) হাতে, আর তাঁর সঙ্গে নিঃসঙ্গে হাঁটো। হেঁটে যাও সামনে, কারণ যদি পিছন ফিরে চাও, তুমি পিছিয়েই পড়বে।’’

মঠে যোগদানের সময়ই গন্শা আগ্নেস আবেদন করেছিলেন তাঁকে যেন বাংলার মিশনে পাঠানো হয়!

সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে

যে-মিরাকলের বশে ট্রাঙ্কের পর ট্রাঙ্ক ভর্তি চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ ধ্বংস করা হল না (সবই গচ্ছিত ছিল লোরেটো কনভেন্টে) তাতে ওঁর বেয়াটিফিকেশনের পর ওঁর জীবন ও কাজ সম্পর্কে প্রায় পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাঠানো গিয়েছিল ভ্যাটিকানে। আর তারই কিছু কিছু সংগ্রহ করা গেল ‘দ্য প্রাইভেট রাইটিংজ’-এ। আর আমরা পড়তে পেলাম এমন সব মণিমুক্তো...

লোরেটোর মাদার সুপিরিয়রকে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণের আবেদনে গন্শা বোয়াকশিউ স্কোপিয়ে থেকে ২৮ জুন, ১৯২৮ তারিখে লিখছেন—

‘‘আমি হাই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছি। ভাষার মধ্যে আমি জানি আমার মাতৃভাষা আলবেনীয় এবং সার্বিয়। কিছুটা ফরাসি জানি। কিন্তু ইংরেজি একদমই না। কিন্তু আশা রাখি দয়াময় প্রভু আমার ভাষা শিক্ষায় সাহায্য করবেন, তাই এক্ষুনি নেমে পড়ছি ওই ভাষাটা শেখার কাজে।’’

অবাক করা ব্যাপার হল অল্পকালের মধ্যেই মাদার যে-ইংরেজি রপ্ত করলেন তা স্বাদে-বর্ণে অতি চমৎকার এবং নিজস্ব। এবং ওঁর কর্মময় জীবনেও যে অজস্র, অগণিত পৃষ্ঠা তিনি লিখে গেছেন অধিকাংশই ইংরেজিতে।

তবে ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে জাহাজে করে আসছেন যখন এই বাংলায় তখন আনন্দবেদনার একটা কবিতাও লিখে ফেলছেন সার্বো-ক্রোয়েশীয় ভাষায়। ‘বিদায়’ শিরোনামে সেই কবিতার একটু অংশ তুলে দিচ্ছি—

‘‘ছেড়ে যাচ্ছি প্রিয় ঘর

প্রিয় দেশ

চলেছি সুদূর বাংলার

তপ্ত প্রদেশ।

ছেড়ে যাচ্ছি পুরনো মিত্র,

পরিবার, বাড়ি

প্রাণ চায় ডুবে যাই

সেবাকর্মে তাঁরই।

ধীরে বয় তরী

কেটে সাগরের জল

চোখ দেখে শেষ বার

ইউরোপ স্থল।

বীর বুকে দাঁড়িয়ে ডেকে

স্ফূর্তি ও শান্তিতে ভরা

খ্রিষ্টের মিষ্টি সুখী ক্ষুদে

সদ্য স্বয়ম্বরা।’’

সমবেত প্রার্থনায়

পাঁচ সপ্তাহ জলযাত্রা করে জাহাজ এসে ঠেকল কলকাতার বন্দরে ১৯২৯-এর ৬ জানুয়ারি। সে দিনের সেই অভিজ্ঞতার এক চিত্রময় বর্ণনা করেছেন সে দিনের সিস্টার টেরিজা পরিবারের মানুষকে লেখা এক চিঠিতে।...

‘‘৬ জানুয়ারি সকালে আমরা সাগর পেরিয়ে ঢুকলাম গঙ্গায়, যাকে বলা হয় পূত নদীও। এই পথ আসতে আসতে চোখ ভরে দেখা হল আমার নতুন দেশ বাংলাকেও। এর প্রকৃতি অপূর্ব। কোথাও কোথাও ছোট ছোট সুন্দর বাড়ি। আর বাকি জায়গা জুড়ে গাছতলে মাটির বাড়ি।

সে-সব দেখতে দেখতে তর সইছিল না এদের কোনও একটায় সেঁধিয়ে যাওয়ার জন্য। জানতে পারলাম এখানে ক্যাথলিকের সংখ্যা খুবই কম। জাহাজ যখন নোঙর করল আমরা প্রভুর বন্দনায় ভেতরে ভেতরে গেয়ে উঠলাম ‘তে দেউম’।

আমাদের ভারতীয় ভগিনীরা ডকে অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে মিলে অবর্ণনীয় সুখানুভূতি নিয়ে প্রথম পা রাখলাম বাংলার মাটিতে।’’

এর সতেরো বছর পর, সিস্টার টেরিজা তখন মাদার টেরিজা, বয়স ছত্রিশ, অ্যানুয়াল রিট্রিট বা বাৎসরিক নির্জন প্রার্থনার জন্য ফের একক সফরে। রেলে করে দার্জিলিং-এর লোরেটো কনভেন্টে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬।

যেতে যেতে ভেতর থেকে এক ডাক শুনলেন টেরিজা।— ‘‘তুমি কি আমাকে প্রত্যাখ্যান করবে?’’

টেরিজা পরে লিখেছেন: ‘‘আমার গৃহীত বৃত্তিরই একটা ডাক ছিল সেটা। একটা দ্বিতীয় ডাক। যে-লোরেটোর সেবিকা জীবনে আমি খুবই সুখী ছিলাম, সেই জীবন ছেড়ে রাস্তায় নেমে দরিদ্রতমদের মধ্যে কাজ করার ডাক।

‘‘ওই ট্রেনে বসেই আমি তাঁর ডাক শুনলাম সব কিছু ছেড়ে ওঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে দরিদ্রের বস্তিতে ঢুকে যেতে— এবং সেখানেই দুঃস্থদের মধ্যে তাঁর সেবায় নিযুক্ত হতে।... সে-ডাক শুনেই বুঝেছি এ তাঁরই ইচ্ছা যে তাঁকে আমি অনুসরণ করি। কোনও সন্দেহই রইল না, সেই কাজই হবে তাঁর কাজ, তাঁর সেবা।’’

মাদার টেরিজার কোনও সন্দেহই ছিল না যে এই ‘ডাকের অন্তরের ডাক’ (the call within a call) আসলে যিশুরই কণ্ঠধ্বনি। কিন্তু সেই ডাককে তিনি উল্লেখ করতেন কেবলই ‘কণ্ঠস্বর’ বলে।

এবং সেই থেকে ভক্তের সঙ্গে ভগবানের এক মধুরতম সম্পর্ক সৃষ্টি হল। অতি আদরের সঙ্গে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনায় যিশুর উল্লেখ করতে লাগলেন ‘আমার বর’, ‘আমার ছোট্টো সোনা’, ‘আমার যিশু’, ‘আমার একান্ত যিশু’ বলে। যিশুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ, পবিত্র সংলাপ জারি হল।

এই সংলাপেই যিশু তাঁর হৃদয় মেলে ধরেছেন তাঁর প্রেমিকার কাছে। তাঁর ব্যথা, বেদনা, দয়া। বেদনার্ত মানুষের সঙ্গলাভের জন্য তাঁর আকুল আর্তি। সেই আর্তজনের সেবায় তাঁর প্রেমিকাকে নিযুক্ত করার বাসনা।

সারাক্ষণ সেই ‘কণ্ঠস্বর’ টেরিজার কাছে আবেদন করেছেন, ‘‘এসো, এসো, নিয়ে চলো আমাকে ভিখারীর গুহায়। হও আমার আলোক-বর্তিকা।’’

যিশুর স্বরের মধ্যে বিশ্বাস ছিল তাঁর ডাক বিফলে যাবে না।

যায়ওনি। দার্জিলিং থেকে ফিরে মাদার টেরিজা সমানে কনভেন্ট এবং চার্চের কাছে আবেদন করে গেছেন তাঁকে স্বাধীন হয়ে রাস্তায়, কাদায়, নর্দমায় নেমে যিশুর সেবার সুযোগ দিতে।

যিশুর ‘স্বর’ প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠায় কম খোয়ার হয়নি টেরিজার। তবু কালে কালে পেরেছেন। এবং অবশেষে ঘটেছে সেই মিরাকল। ১৮ অগস্ট, ১৯৪৮-এ লোরেটো সন্ন্যাসিনীর সাদা-কালো গাউন ছেড়ে মাদার টেরিজা নীল-সাদা শাড়িতে নেমে এলেন কলকাতার রাস্তায়।

চোখে অশেষ স্বপ্ন। বুকে যিশু। কোঁচড়ে পাঁচটা টাকা।

পোপ জন পল ও মাদারের সঙ্গে নরেশ-সুনীতা

আর্তের সেবায় নেমে প্রথম পর্বে যে-যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন মাদার টেরিজা তার একটি হল কালীঘাট মায়ের মন্দিরের ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে মরণপথযাত্রীদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল— নির্মল হৃদয়। হোম ফর দ্য ডাইং।

এমনই নিয়তি, ওই পাড়ারই নতুন সঙ্ঘ ক্লাবের সভাপতি হিসেবে বছর দশেক আগে কালীপুজোর প্যান্ডেলের গায়ে মাদার টেরিজার ছবি, স্মৃতিধন্য দ্রব্য, এমনকী তাঁর রক্তমাখা তুলো-ব্যান্ডেজ (শেষ দিকে একবার খাট থেকে পড়ে তাঁর হাঁটু রক্তারক্তি হয়) দ্রষ্টব্য করে প্রদর্শনী আয়োজনে হাত লাগাই। মায়ের মূর্তি দর্শনের পর আরেক মা’কে নিয়ে প্রদর্শনী দেখায় মানুষের ভিড় দেখে আমরা অবাক হয়েছিলাম।

যিনি নিজের সমস্ত লেখাপত্তর পোড়ানোর জন্য এত ব্যাকুল ছিলেন তিনি তাঁকে নিয়ে প্রদর্শনী করা কী ভাবে নিতেন জানি না। তবে তাঁর রসবোধে আমার ভয়ানক আস্থা আছে। কথার মধ্যেই সেটা ফুটে বেরোত।

সুনীতা কুমারকে যেমন এক দিন বলেছিলেন: ‘‘বলো তো টেম্পলটন পুরস্কার নিতে যাবার সময় ওরা যে কালো কোটটা আমায় দিয়েছিল সেটা তো পড়েই আছে। ও দিয়ে আমি আর কী করব? তুমিই ওটা নিয়ে নাও।’’

তার পর একটু থেমে, দুষ্টু ভাবে তাকিয়ে বললেন, ‘‘জানো তো, কোটটা বেশ ফ্যাশনেবল।’’

এই রসিকতা ঘোর অসুখের মধ্যেও ওঁকে ছেড়ে যায়নি। বলতেন, ‘‘আমারই তো একমাত্র ব্যবসা যা সরকার কোনও দিনই জাতীয়করণ করবে না।’’

কালীঘাট বা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কত ঘনিষ্ঠ মাদার টেরিজার গড়া গরিবখানা, তার প্রমাণ দেবার দরকার বোধহয় আর নেই। কালীর কলকাতার সঙ্গে চিরকালের মতো জুড়ে গেছে টেরিজা নামটি।

এই ভাবনাটাই আরও অপূর্ব প্রসঙ্গ পেল সদ্য প্রকাশিত শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন নিয়ে এক ইংরেজ লেখিকার লেখা আশ্চর্য উপন্যাস ‘দ্য কলিফ্লাওয়ার’-এ।

ভাগ্নে হৃদয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনকাহিনির শেষে লেখিকা নিকোলা বার্কার টেরিজাকে তুলে এনেছেন ঠাকুরের পরবর্তী কলি ও কলিকাতার অবতার হিসেবে। লিখেছেন—

‘‘ফের এক অবতার আসবেন (হায়! হায়!) তাঁর পায়ে পায়ে। এই বিস্তীর্ণ, বিক্ষিপ্ত, নৈরাজ্যের মহানগরীতে...

‘‘তিনিও খুবই রীতিবিরুদ্ধ হবেন... তিনি জাপটে ধরবেন না আধুনিকতা বলে যা চলে, তাকে। তাঁর আঁকড়ে ধরার জন্য আছে শ্রমের সম্মান, হাতা গুটিয়ে কাজে নামা, সৎ স্বেদ আর আন্তরিক আত্মদান।

‘‘শ্রীরামকৃষ্ণের মতোই তিনি পরিহার তরবেন বিরূপতা.... যা শুভ সৌভাগ্য। কারণ তিনি তো এখানেই, গলাপচা, ঢেঁকুর-তোলা, জনারণ্য শহরে। তিনি ভালবাসবেন তাদের যাদের কেউ ভালবাসে না, বাসতে পারে না। এই তাঁর মন্ত্র...’’

শ্রীরামকৃষ্ণের পর কলকাতা পেয়েছে সারদাদেবীকে। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর পেতে চলেছে মা টেরিজা দেবী।

ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ,

সৌজন্যে নরেশ কুমার ও সুনীতা কুমার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mother Saint Teresa Mother Teresa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE