Advertisement
E-Paper

ও মন চলি, কাঁহা চলি

লীনা চন্দ্রভারকরকে নকল করে নাচতে নাচতে গেয়ে উঠেছিলেন কিশোরকুমার। দু’জনের সঙ্গে এক দুপুরের আড্ডায় অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথায় ভার্জিনিয়া ভাচা বি আর চোপড়াকে এক বার বলেছিলেন, কুকুরের মতো ডাকতে পারবেন? কিংবা মুরগি? তবে আপনার ছবিতে কাজ করব!

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
কিশোর-লীনা ছবি: ইন্দ্রজিৎ ঔরঙ্গাবাদকর

কিশোর-লীনা ছবি: ইন্দ্রজিৎ ঔরঙ্গাবাদকর

বি আর চোপড়াকে এক বার বলেছিলেন, কুকুরের মতো ডাকতে পারবেন? কিংবা মুরগি? তবে আপনার ছবিতে কাজ করব!

আরেক বিখ্যাত প্রযোজক বাড়িতে আসবেন শুনে টেলিফোনে বলেছিলেন, আপনাকে একটা নৌকো আনতে হবে, নইলে বাড়িতেই ঢুকতে পারবেন না!

মানে, কেন?

তাতে যা উত্তর দিয়েছিলেন, তা শুধু ওঁর পক্ষেই সম্ভব!

তিনি কিশোরকুমার যে!

ছবি: সদানন্দ

কাকে কী বলবেন, কখন কী করবেন কেউ জানে না!

এমন মানুষের সঙ্গে বছর বছর কাটিয়ে দেওয়া যে কী বিষম বস্তু!

রুমা গুহ ঠাকুরতার সঙ্গে বছর সাতেক।

মধুবালার সঙ্গে ন’বছর।

যোগিতা বালির সঙ্গে মাত্র দু’বছর।

কিন্তু লীনা চন্দ্রভারকরের সঙ্গে সম্পর্ক যে কী করে শেষ দিন অবধি থেকে গিয়েছিল কিশোরকুমারের, সে এক রহস্য!

সেই রহস্য-মোড়কের ভেতরটা ঠিক কেমন, তার যেন এক ঝলক দেখা হয়ে গিয়েছিল সে দিন।

বহু দিন আগের এক দুপুর।লীনার সাক্ষাৎকার নিতে সে দিন ওঁর বাংলোতেই দেখা করার কথা। যথাসময়ে পৌঁছেছি।

বাংলোটা ছিমছাম। বসার ঘরে অপেক্ষা করছি। একটু বাদে ঘাড় তুলতেই দেখি, লীনা।

মুখে ঝকঝকে একটা হাসি নিয়ে সিঁড়ির ওপরের ধাপে দেখা দিলেন।

হাতের ইশারায় ডেকে নিয়ে বললেন, ‘‘চলে আসুন। ঘরে বসেই কথা বলি।’’

সোজা ওপর তলার শোওয়ার ঘরে নিয়ে গেলেন। বসতে বলে নিজেই ভাজাভুজি, চা এগিয়ে দিলেন।

শুরু হল কথাবার্তা। ধীরে ধীরে সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন আর প্রতিটি মুহূর্তে যেন চিনিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর ভিতরে লুকিয়ে থাকা এক অতি নম্র মানুষীকে।

ঠিক তখনই কিশোরকুমারের প্রবেশ। মুহূর্তে পাল্টে গেল ঘরের আবহাওয়া। হঠাৎ দমকা ঝড়ে যেমন সব কিছু লন্ডভন্ড হয়, তেমন!

প্রায় হইহই হাসি দিয়ে শুরু করলেন কিশোর-সুলভ ঠাট্টা— ‘‘আপনি ওর ইন্টারভিউ নেবেন? ও কী বলবে?’’

লীনা মুচকি হাসলেন।

বললেন, ‘‘অভিনেত্রী হিসেবে আমাকে ও কোনও কালেই সিরিয়াসলি নেয়নি। আমি কী কী সিনেমা করেছি সেটাও ওকে বলে বলে মনে করাতে হয়।’’

চোখটা কুঁচকে ঠোঁটে হাসি নিয়ে কিশোরকুমার বলে উঠলেন, ‘‘আমি অবশ্য ওই সিনেমার কথাটা দিব্যি মনে করতে পারি...কী ছিল যেন... কী যেন ছিল...ও হ্যাঁ হ্যাঁ..‘ও মন চলি’। সঞ্জীবকুমারের সঙ্গে।’’

বলেই ছবির টাইটেল সং-টা বিকট সুর করে গাইতে শুরু করলেন, ‘‘ও মন চলি, কঁহা চলি... দেখ দেখ দেখ দেখ... মুঝসে না সরমা...।’’

শুধু গাওয়া নয়, গানের সঙ্গে পর্দায় যে ভাবে লীনা নেচেছিলেন, সেটাও কপি করতে লাগলেন।

স্পষ্টতই লীনা অস্বস্তিতে। কিন্তু অদ্ভুত সরল একটা চাউনি দিয়ে শুধু বললেন, ‘‘তুমি যদি এই সব করো, আমি কী ভাবে ইন্টারভিউটা শেষ করব, বলো তো?’’

একগাল হেসে কিশোরকুমারের জবাব, ‘‘ও! তা’হলে আমি এখানেই বসছি, দেখি তুমি কী ভাবে উত্তর দাও!’’

আশ্চর্য, যা বলা তাই কাজ!

টানা বসে রইলেন ইন্টারভিউয়ের সময়। মাঝে মাঝে লীনা যখন নিজের কেরিয়ার নিয়ে উত্তর দিচ্ছিলেন, কেবল মুচকি মুচকি হাসছিলেন।

লীনা বলছিলেন, ‘‘কিশোরদার সঙ্গে মেলামেশা করাটা কিন্তু বেশ ধৈর্যর ব্যাপার। তবে এটাও বলব, স্বামী হিসেবে ও কিন্তু একেবারে ঠিকঠাক। বাইরে ওর যা-ই ইমেজ থাক, ঘরে কিন্তু একদম তা নয়। ও আমাকে একটু সংসারী দেখতে চেয়েছে। হয়তো চেয়েছে, আমি মাঝেমধ্যে ঘরের খাবার-টাবারও তৈরি করে দিই। ব্যস, এইটুকুই।’’

কিশোরকুমারের দিকে চোখ পড়ল। দেখি, উনি আলতো একটা হাসি নিয়ে ঘাড় নাড়ছেন।

মন চলি-তে সঞ্জীবকুমার-লীনা চন্দ্রভারকর

এই প্রথম দেখলাম, একটু যেন সিরিয়াসও হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘‘লীনা খুব ভাল জানে, আমি কী চাই। কী ভাবে আমার দেখভাল করতে লাগে। আরেকটা ব্যাপার, ছেলের (অমিতকুমার) সঙ্গে কোনও ভুল বোঝাবুঝি হোক, আমি চাই না। লীনা আর অমিত দু’জনে দু’জনের খুব ভাল বন্ধু। কিন্তু একটা ব্যাপার আছে।’’

বলেই আবার দুষ্টু-দুষ্টু হাসি। বললাম, কী সেটা?

হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘ওরা আবার মাঝে মাঝে দেখি, আমার বিরুদ্ধে একজোটও হয়ে যায়। তখন একটু মুশকিল হয় বইকী!’’

হাসি চওড়া হল ঠোঁটে।

লীনা সারাক্ষণ ধরেই যেমন শান্ত-শান্ত উত্তর দিচ্ছিলেন, তেমন ভাবেই বললেন, ‘‘দেখুন, আমি তো কোনও দিন অমিতের মায়ের জায়গা নিতে পারব না, কিন্তু ও যাতে স্বস্তিতে থাকে, সেই কাজটা তো আমি করতে পারি। আমি শুধু অমিতকে প্রাণ খুলে ভালবেসেছি, ওর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে নজর দিয়েছি। ওকে বারবার বলেছি, ও যেন যতটা সম্ভব নিয়মিত মায়ের সঙ্গে দেখা করে। ওঁর খবরাখবর নেয়। এই ভাবে থাকতে থাকতে এক সময় দেখলাম, আমরা একে-অপরের বন্ধু হয়ে গিয়েছি।’’

অমিত বাড়িতেই ছিলেন। কিশোরকুমার ওঁকে ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

কথায় কথায় অমিতও স্বীকার করলেন, লীনাই ওঁর সবচেয়ে ভাল বন্ধু। ওঁর সঙ্গে সব রকম কথা ‘শেয়ার’ করা যায়। এমন কিছু ব্যাপার-স্যাপার আছে, যেগুলো বাবাকেও বলা যায় না, সেটাও নাকি অনায়াসে লীনাকে তিনি বলতে পারেন।

ইন্টারভিউ চলছিল। তার মাঝেই লীনা কিশোরকুমারকে নিয়ে নিজের থেকেই অনেক কথা বলছিলেন।

এক বার বললেন, ‘‘কিশোরদা অসম্ভব প্রাইভেট মানুষ। ও চায় না, ওর ব্যক্তিগত জায়গা, ওর ঘর, ওর পরিবার নিয়ে বাইরের কেউ মাথা ঘামাক।’’

ঠিক এইখানে এসে বলে ফেললাম, ‘‘আচ্ছা, প্রোডিউসার-ডিরেক্টররা তো ওঁকে নিয়ে নানা রকম পাগলামির কথা বলেন, সেগুলো তা’হলে...?’’

মনে হচ্ছিল, এ বার বোধ হয় চড়া উত্তর দেবেন কিশোরকুমার। কোথায় কী!

বরং এক গাল হেসে বললেন, ‘‘ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কিছু লোকের সমস্যা হল, তাঁদের কোনও রসবোধ নেই। আর আমি তো ঠিক তার উল্টো। তাই ওঁরা মাঝে মাঝে অনেক কথা-টথা বলেন। আমি ও সব পাত্তা দিই না। হেসে উড়িয়ে দিই।’’

তখনই মনে পড়ছিল, বিখ্যাত প্রোডিউসার-ডিরেক্টর বিআর চোপড়ার সঙ্গে ওঁর একপ্রস্ত ঝামেলার কথা। এমনিতে চোপড়ার ফিল্মে কাজ করার তেমন উৎসাহ ছিল না কিশোরকুমারের। কিন্তু এড়াবেন কী করে? ফন্দি আঁটলেন।

প্রস্তাব পেতেই হঠাৎ চোপড়াজিকে বলে বসলেন, ‘‘করতে পারি। কিন্তু প্লে-ব্যাক করার জন্য আমার একটা শর্ত আছে।’’

যোগিতা বালির সঙ্গে বিয়ের পর ছবি: সদানন্দ

কী শর্ত?

সেন্টার টেবিলের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে চোপড়াজিকে প্রথমে কুকুরের ডাক ডাকতে হবে। তার পর মুরগির...

রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে চোপড়াজি বাংলো ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

আরেক বারের ঘটনাও মনে পড়ছিল। এক বিখ্যাত প্রোডিউসার ফোন করে কিশোরকুমারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলেন।

তাতে কিশোরকুমার তাঁকে বলেছিলেন, তিনি যেন সঙ্গে করে একটা নৌকো নিয়ে আসেন।

মানে? হঠাৎ নৌকো কী হবে?

কিশোরকুমার উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘দেখুন, আমি আমার বাগানটাকে খাল বানিয়ে ফেলেছি। ঠিক যেমন ভেনিস শহরটা। তো, নৌকো না আনলে ঘরে ঢুকবেন কী করে?’’

স্রেফ মজা। কিশোর-সুলভ। কিন্তু যাঁরা শুনতেন এ সব, সবার পক্ষে তো মেনে নেওয়া সম্ভব হত না।

লীনা বলছিলেন, কখনও কখনও সত্যিই ওঁর এই সব কাণ্ড বেশ অস্বস্তিকর হয়ে যায়। তখন নাকি লীনাই ওঁর হয়ে ক্ষমা চেয়ে নেন।

এই কথার মাঝেই কিশোরকুমার হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার পর তারস্বরে গাইতে লাগলেন, ‘‘ও মন চলি, কাঁহা চলি...।’’

সঙ্গে চূড়ান্ত বিরক্ত করতে লাগলেন লীনাকে। লীনার কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই। নির্বিকার। একটুও না থেমে হাসি-হাসি মুখে কথা চালিয়ে গেলেন।

এক বার শুধু বললেন, ‘‘ওঁর অদ্ভুত-অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপারগুলো কিন্তু আমাকেই সইতে হয়েছে সবচেয়ে বেশি।’’

কী রকম?

উত্তরে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া গেল বইকী!

বলছিলেন, ওঁকে নাকি ভয় দেখাতে খুব ভালবাসেন কিশোরকুমার।

তার পরে বললেন, ‘‘একবারের কথা বলি। ট্যুরে যাবে ও। আমি থাকব বাড়ি। চলে যাওয়ার ঠিক আগে আমায় বলল, ‘দেখো, রান্নাঘরে যেন বেশি রাত করে নামতে যেয়ো না। খাবার জল-টল যা দরকার আগেভাগে ঘরে রেখে দিয়ো। রাত্তিরে আর বেরোতে যেয়ো না।’ বললাম, কেন? কী হবে তাতে? উত্তরে বলল, ‘আরে, রোজ রাতে মধুবালার ভূত এসে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে, জানো তো?’ শুনে আমার সে কী ভয়! ও তো বলে চলে গেল। এত ঘাবড়ে গেলাম, রাতে শোওয়ার সময় সেই-যে ঘরের দরজাটা দিয়ে দিতাম, হাজার দরকার পড়লেও সকালের আগে কিছুতেই খুলতাম না।’’

শুনে সশব্দ হেসে উঠলেন কিশোরকুমার। বললেন, ‘‘আসলে কী, ওকে ভয় দেখালে খুব শিগগির ভয় পেয়ে যায়। তাই...!’’ তার পর লীনার দিকে তাকিয়ে মুখটা একটু বাঁকিয়ে শিশুর মতো বলে উঠলেন, ‘‘মধুবালার ভূত...।’’

বেরিয়ে যাচ্ছিলেন ঘর ছেড়ে।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন।

সেই চিরাচরিত হাসি-হাসি মুখটা নিয়ে বললেন, ‘‘মনে হয় ইন্টারভিউটা খারাপ হল না, তাই না!’’

উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেলেন। মুখে আবার সেই গানের কলি...‘ও মন চলি... কাঁহা চলি... দেখ দেখ দেখ....’।

লীনার মুখে আবার একটা সরল হাসি খেলে গেল।

এই সরলতাটাই বোধ হয়...!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy