Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ফিরছে তিন পয়সার পালা

অঞ্জন দত্ত প্রোডাকসন্স-এর নতুন নাটক ‘তিন পেনি অপেরা’। মহলা দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়প্রথম পাঁচ বছরে আঠেরোটি ভাষায় অনুবাদ। ইউরোপের মঞ্চে দশ হাজার বারেরও বেশি অভিনয়! সে সব তিরিশের দশকের গল্প। ’৬৯-এ কলকাতায় নান্দীকার যখন এ নাটক করেছে তা’র শোয়ের সংখ্যাও গড়িয়ে যায় ৪০০-র বেশি। বের্টোল্ট ব্রেখটের সেই ‘দ্য থ্রি পেনি অপেরা’ আবার ফিরতে চলেছে বাংলায়। সৌজন্যে ‘অঞ্জন দত্ত প্রোডাকসন্স’ (পরিচালনায় ছন্দা দত্ত)। সেপ্টেম্বরের ১০, ১১, ১২, ১৩। পর পর চারটি শো। জ্ঞান মঞ্চ, সন্ধে সাড়ে ৬টা।

সে দিন মহলায় ‘ম্যাকিথ’

সে দিন মহলায় ‘ম্যাকিথ’

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

প্রথম পাঁচ বছরে আঠেরোটি ভাষায় অনুবাদ। ইউরোপের মঞ্চে দশ হাজার বারেরও বেশি অভিনয়!
সে সব তিরিশের দশকের গল্প। ’৬৯-এ কলকাতায় নান্দীকার যখন এ নাটক করেছে তা’র শোয়ের সংখ্যাও গড়িয়ে যায় ৪০০-র বেশি।
বের্টোল্ট ব্রেখটের সেই ‘দ্য থ্রি পেনি অপেরা’ আবার ফিরতে চলেছে বাংলায়। সৌজন্যে ‘অঞ্জন দত্ত প্রোডাকসন্স’ (পরিচালনায় ছন্দা দত্ত)। সেপ্টেম্বরের ১০, ১১, ১২, ১৩। পর পর চারটি শো। জ্ঞান মঞ্চ, সন্ধে সাড়ে ৬টা।
ষাটের দশকে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় যার রূপান্তর করে নাম দিয়েছিলেন ‘তিন পয়সার পালা’, তার সঙ্গে গোড়াতেই একটা গরমিল অঞ্জন দত্তের এই অনুবাদের।
অজিতেশের গড়নে ছিল দেশজ মিশেল। কথায়, পোশাকে লোকজ টান। প্রেক্ষাপট শহর কলকাতা। চরিত্রের নামেও দেশীয় ছাপ্পা— যতীন্দ্রনাথ, মালতীবালা, বটকৃষ্ণ সরকার, পারুলবালা, মহীন্দ্র…। অজিতেশ নিজে হতেন মহীন্দ্র, পারুলবালা- কেয়া চক্রবর্তী, বটকৃষ্ণ –রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত...।
অঞ্জনের ‘তিন পেনি অপেরা’ ভাবান্তর নয়, বলতে গেলে হুবহু ট্রানস্লেশন। প্রেক্ষিত লন্ডন। পোশাক, সংলাপ, আবহাওয়া কোনওটাতেই দেশ-দেশ গন্ধটা নেই। বরং অনেকটাই পশ্চিমি। ডাকাতের দল এখানে যেমন পাঙ্কদের মতো। গ্যাংস্টার স্টাইলের। কানে দুল। হাতে ট্যাটু।
তবু এ থিয়েটারের শরীরটাই এমন যে আজকের সময়কে ধরতে কোত্থাও কোনও অসুবিধে নেই। যদিও নামধাম একেবারে ব্রেখটীয় ধারায়— ম্যাকিথ (অঞ্জন দত্ত), পিচাম (পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়), টাইগার ব্রাউন (দেবদূত ঘোষ)…।

মূল নাটকটি যদিও ব্রেখটের নয়, জন গে-র। ‘দ্য বেগার্স অপেরা’। তাঁর লেখাটি ১৭২৮ সালে। ব্রেখটের সেক্রেটারি কোত্থেকে সেটি পেয়ে জার্মানিতে অনুবাদ করে ফেলেন।

সে-নাটক ছিল অভিজাত-তন্ত্রের বিরূদ্ধে। ব্রেখট তাকে শানিয়ে নিয়ে কামান দাগেন ‘বুর্জোয়াজি’-কে তাক করে। দুর্নীতি, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, ভিক্ষাবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি, যুদ্ধ যে সমাজের ফসল, ব্রেখটের শব্দের গোলাগুলি ছোটে সে দিকেই।

ব্রেখট তখনও জার্মানিতে। ক্ষমতায় নাৎসিরা। ব্রেখট আর কুর্ট ওয়াইল বার্লিনে প্রথম নাটকটি নামান ১৯২৮-এ। দ্রুত নাটকটি এত জনপ্রিয়তা পায় যে ‘জার্মানির মানুষের মূল্যবোধের ওপর আক্রমণ’— এই তকমা দিয়ে হিটলার নাটকটি বন্ধ করে দেন।

থিয়েটারে ম্যাকিথ এক জন ডাকাত। গুন্ডাবাজি করাটাই তার পেশা। সে বিয়ে করে পিচামের মেয়ে পলিকে। বিয়ে মানে, একেবারে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে।

পিচহাম এক জন ব্যবসাদার। ভিখারিদের নিয়ে সে ব্যবসা চালায়।

ম্যাকিথ চায় তার লুঠের টাকাটা আইনি করতে। ব্যাঙ্কে ট্রান্সফার করে ‘সাদা’ বানাতে। তার জন্য পলিকে তার চাই।

আর পিচহাম চায় পলিকে ফিরে পেতে। ম্যাকিথকে জেলে ভরতে। তার ব্যবসার দায়ভার মেয়েকে বুঝিয়ে দিতে।

শুরু হয় লড়াই।

ম্যাকিথের বন্ধু টাইগার ব্রাউন। পুলিশ কমিশনার। ম্যাকিথ আর সে একসঙ্গে যুদ্ধে ছিল। আলাপ তখন থেকেই।

টাইগারের সঙ্গে ম্যাকিথের বোঝাপড়া হয়— ম্যাকিথ যা চুরিচামারি করবে, তার ‘কাটমানি’ দেবে টাইগারকে। টাইগার ওকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে যাবে।

এ দিকে পিচাম ম্যাকিথকে ধরিয়ে দিতে, টাইগারকে ‘ব্ল্যাকমেল’ করতে ফন্দি আঁটে। যার জন্য গণিকাদের কাজে লাগায়। ফাঁদে ফেলে টাইগারকে হুমকি দেয়— ম্যাকিথকে সে যদি ধরিয়ে না দেয়, রানির অভিষেকের দিনে সে তার ব্যবসার ভিখারিদের দলে দলে রাস্তায় ছেড়ে দেবে। চাপে পড়ে ম্যাকিথকে ধরিয়ে দেয় টাইগার।

এ বার কি পিচামের আশা পূরণ হবে? সত্যিই কি ম্যাকিথের ফাঁসি হবে?

চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সের দিকে যেতে যেতে ‘তিন পেনি অপেরা’ সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-বাঁচা-মরা নিয়ে একের পর এক ঠাট্টা, বিদ্রুপ করে যায়।

আগাগোড়া মিউজিক্যাল ড্রামা। এক্কেবারে ব্রেখটীয় মডেলের। চোরা গোপ্তা ব্যঙ্গ-কথায় ভরা। সময়কে নিয়ে তামাশায় ঠাসা। গান আসে বারবার— ‘‘আপনারা যারা আমাদের সৎ পথে নিয়ে যেতে চান/আগে পেট পুরে খেতে দিন তারপর বোঝাবেন আত্মসম্মান।’’

সে গান কখনও যুদ্ধের বিরুদ্ধেও— ‘‘জন আর জিম ছিল সাধারণ সৈনিক/ জর্জ ছিল ক্যাপটেন তাদের/ যুদ্ধের সময়ে সব এক হয়ে যায়/ মানে না কেউ কোনও আদেশ/ সৈন্যদের জীবন কামানেরই মতন/ কেপ থেকে কুচবিহার/ হয় তারা যদি মুখোমুখি/ হয়ে যায় যদি চোখাচুখি/ শত্রু-মিত্র কেউ মানে না/ কার কোন দল কেউ জানে না/ যার গায়ে জোর কম/ সে হয়ে যায় গরুর কাবাব।’’

একের পর এক গান। কোনও এক জনের গলায় নয়, অনেকের। থিয়েটার পুরো অপেরার আকার পায়। রিদম, রিদম, রিদম। জ্যাজ, পাব মিউ। অর্কেস্ট্রেশন (মিউজিক অমিত দত্ত, নীল দত্ত ও অন্যরা)।

চড়া ধাঁচের অভিনয়। উচ্চগ্রামে সংলাপ। চিৎকার করে কান্না। কখনও উল্লাসে ফেটে পড়া। প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কি। ব্রেখট ঘরানার নিরুত্তাপ, আবেগশূন্য, ঠান্ডা ধারার এক্কেবারে উল্টো মেরুতে দাঁড়িয়ে।

প্রপস বলতে স্টেজের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা একাধিক মেনিক্যুইন। বাঁ ধারের কোণে একটা খাঁচা। সেই খাঁচা কখনও হয়ে যায় জেল-গারদ। কখনও জানলা, তো কখনও করিডর। পিছন দিকে উঁচু রস্ট্রামে বসে মিউজিশিয়ানরা।

দৃশ্য অনুযায়ী মেনিক্যুইনের সাজ বদলায়। জেলের সময় কয়েদির পোশাক। ভিখারি-বৃত্তি দেখাতে ভিক্ষুকের। গণিকাদের মধ্যে গণিকার মতো। পোশাকের রং বলতে তিনটি। সাদা, কালো আর লাল। ভাল, মন্দ আর রক্তের!

আলোতেও তিনটি শেড। নীল, সাদা, লাল। অনেকটা যেন ক্ষমতাবাজ দেশের জাতীয় পতাকা থেকে ধার নিয়ে!

’৭৮ সালে জঁ পল সার্ত্রের ‘স্বীকারোক্তি’ দিয়ে যাঁর থিয়েটারের শুরু, নাটকে তার প্রথম ইনিংস শেষ হয়েছিল ১৯৯৩-এ। সেই অঞ্জন দত্ত আবার থিয়েটারে ফিরেছেন ২০১৩ থেকে। ‘গ্যালিলিও’ করলেন। ‘অবনি অপেরা’ হল। এ বার ব্রেখট। আগেও বহু বার করেছেন। এ বার নতুন করে।

থিয়েটারের প্রথম ইনিংসের সময়ই মৃণাল সেন-বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর সঙ্গে তাঁর সংযোগ! তার পরে অঞ্জন দত্তর সঙ্গে মৃণাল-বুদ্ধদেব কেমিস্ট্রি তো বাংলা প্যারালাল সিনেমায় একটা মিথ।

প্যারালাল থিয়েটারের মধ্যেও আরও এক ধরনের প্যারালাল ঘরানার ভাঙচুরের ঝোঁক দেখা যায় অঞ্জনের প্রোডাকশনে। এ বারও কি তারই ঝলক দেখবে শহর?

লন্ডনের নাটক, আপেক্ষায় কলকাতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE