এ লড়াই অনন্ত কালের। জোতদার বনাম ভুমিহীন চাষির। এ লড়াই ক্ষমতাবান বনাম দারিদ্র্যের। শোষণের মাত্রায় যখন সীমাহীন লোভ কাজ করে তখনই প্রাণ পায় বিদ্রোহের। ক্ষমতার কেন্দ্র-বিন্দুতে ভোগবান মানুষটি নিজেকে ঈশ্বর ভাবলেও তিনি আদপে শয়তান। লোভী, চরিত্রহীন লম্পট।
যা আশা করা গিয়েছিল তাই হল। চন্দন সেনের ‘ঈপ্সা’ নাটকটি আমাদের লালসার সেই গোপন অভিসারে চপেটাঘাত করল। ধন্যবাদ চন্দন সেনকে, তিনি এমন হাইটেক যুগেও মানুষের রুচি বদলের ঘরানাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারেন। থিয়েটার নিয়ে ৫৪ বছরের বিরতিহীন পথ চলার মাঝেও ইউজীন ও নীল অনুপ্রাণিত নিষিদ্ধ অন্ধকারে এ যেন আলোকিত প্রাণ পিপাসা। যৌনতাকে শেষ স্বীকৃতি দেওয়া যায় আকাঙ্খিত নারীর গর্ভে সন্তান এনে। তা কি লোভের? নাকি ক্ষমতার?
দর্শককে স্তব্ধ করে, উত্তেজনা বাড়িয়ে, কৌতূহলের শেষ পারদে পৌঁছে ‘ঈপ্সা’ নাটকটি বাংলা নাট্য জগতে সেরা নাটকের তকমায় আরও একটি নাম সংযোজিত হল নিঃসন্দেহে। শুধু নাটকে নয়, অভিনয়েও। দেশ-কাল-সময় কথা বললেও ঘটনার কালচক্রে আমাদের ফিরিয়ে দেয় সেই সময়কে, যেখানে মানুষের মর্যাদাকে আঘাত করেছে মানুষেরই দম্ভ এবং ক্ষমতা। বিদ্রোহ নয়, অসহায়তা নিয়েই কত মানুষ তিলে তিলে নিঃশেষ করেছেন নিজেকে। গ্রামবাংলার এ ইতিহাস আজও শিহরিত করে। এ যেন এক নিষ্ঠুর পরিণতি।
দেবশঙ্কর হালদারকে শুধু ওই চরিত্রে মানিয়েছে তাই নয়, অভিনয় দক্ষতায়ও তিনি প্রমাণ করলেন দর্শকদের মনের গভীরে তিনি সত্যিই ‘সেরা’। নাটকে শুরু থেকে শেষ তাঁর পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ পিতার বিরুদ্ধে লড়াই, মান-অভিমান, মায়ের সঙ্গে নীতির সমঝোতা সব কিছুতেই দেবশঙ্কর নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। নাটকের বাইরে গিয়েও নিজের নাট্যব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা মিলিয়ে দিয়েছেন ওই চরিত্রে। যা বিরল ঘটনা। নাটকের শেষে তাই সজল চোখে জনৈক শ্রোতা দেবশঙ্করের উদ্দেশ্যে বলতে পারেন, ‘আপনি কী করে এমন অভিনয় করতে পারেন?’ শিল্পীর প্রতি শ্রোতার শ্রদ্ধা।
নাটকের বিষয়বস্তু খুবই সংবেদনশীল। কারণ এখানে কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন জন্ম দেওয়া অতৃপ্ত এক কর্ষজীবী। জমির পর জমিতে ফসলের জন্ম দেওয়া আর নারীর পর নারীর গর্ভে সন্তানের জন্ম দেওয়ার আদিম বাসনাকে যে অভিন্ন চোখে দেখে থাকে। যৌন-বাসনায় এবং প্রাণ সৃষ্টির কামনায় উন্মত্ত সেই বৃদ্ধ। প্রতিশোধ নিতে চাওয়া সন্তানের চূড়ান্ত সংঘাতের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকে ওই সন্তানের প্রবঞ্চিতা মায়ের স্মৃতি। অন্যদিকে পঁচাত্তর বছরের দাপুটে বৃদ্ধের শেষ ঘরণি হয়ে আসা এক যৌবনবতী নারী আর তার নবজাতক। পাপের বোঝা সেই শিশুর আবাহন ও বিসর্জন। চোখে জল আনে।
চন্দন সেনের নাটকে সেই ঘটনার মধ্য দিয়েই উঠে এসেছে দেশ-কাল-সংস্কৃতি আর চেনা লোকভাষার সীমায়িত ভূখণ্ড। যেখানে পরতে পরতে উন্মোচিত হয়েছে লোভ-লালসা- যৌনতা আর নির্মমতা। অভিনয়ের দক্ষতা নিয়ে অন্যদের প্রসঙ্গ আনার আগে অবশ্যই আনব ঘুগনি চরিত্রে ছোট্ট শিল্পী দেবপ্রিয়া বসুর কথা। এই প্রথম তার অভিনয়। কিন্তু দর্শকরা অভিভূত ওর অসাধারণ সুপ্ত প্রতিভার বিস্ফোরণে। বিস্ময় জাগে, বড় হলে ও নিশ্চয়ই যে কোনও অভিনয়ে নিজেকে আরও বেশি করে মেলে ধরতে পারবে। আশীর্বাদ রইল।
বিন্দিয়া ঘোষ ভাল অভিনয় করেন। এখানেও করেছেন। অন্যদের মধ্যে কৌশিক ঘোষ, সুমন পাল, সুভাষ মৈত্র, স্বপন সিংহ রায়, তপন বিশ্বাস, সঞ্জয় বসু, প্রশান্ত ধর, শ্যামল দে, শঙ্করী মজুমদার, জ্যোতির্ময় সাহা, অদিতি লাহিড়ি নজর কেড়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy