সময় বড় রসিক। যে মেয়ে একদিন লিখেছিল, ‘‘মনের কথা জানাইবার লোক জগতে নাই,’’ আজ দেখা যাচ্ছে তার কথা শুনে শুনে লোকের আর মন ভরছে না।
যাত্রা থেকে গ্রুপ থিয়েটার, সিনেমা থেকে টিভি সিরিয়াল, সমাজবিজ্ঞানীর গেরামভারী গবেষণা থেকে সঙ্গীত-গবেষকের সংকলিত ‘বিনোদিনী রচনাসমগ্র’ উইথ ফ্রি মিউজিক সিডি, সবেতেই ওই একটা মেয়ের কথা। শ্রীমতী বিনোদিনী দাসী। সাম্প্রতিকতম সংকলনটি, যার সম্পাদনা করেছেন দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, ফের বিনোদিনীকে নিয়ে চিন্তা উস্কে দেয়।
তার সময়ের মেয়েরা, এমনকী তার চাইতে অনেক পরের মেয়েরাও সেই কবে সেকেলে হয়ে গেল। তাদের ন্যাপথালিন-নিমপাতা দিয়ে তুলে রাখা যায়।
কিন্তু বিনোদিনী? জ্বলন্ত মশাল আলমারিতে তুলে রাখবে, এত সাহস কার? মেয়েদের মধ্যে কে প্রথম গ্র্যাজুয়েট, প্রথম ডাক্তার, প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন লিডার, প্রথম হ্যানোত্যানো, সব কুইজের বইতে রয়ে গিয়েছে। বিনোদিনী কোনও কিছুতে প্রথম না হয়েও অদ্বিতীয়া। মাত্র বারো বছরের অভিনয় জীবন, স্রেফ দুটি গদ্য লেখা প্রকাশিত। তাতেই অলটাইম সুপারহিট।
বক্স অফিসে, বেস্ট সেলার লিস্টে গত দু’পাঁচ বছর কাদম্বরী বৌঠান একটু কম্পিটিশন দিচ্ছে বটে, তবে সে নিতান্তই রবীন্দ্রনাথের ধোঁয়াটে ‘রোম্যান্টিক ইন্টারেস্ট’-এর সাইড রোলে।
বিনোদিনী কারও স্যাটেলাইট নয়, হয়নি কোনও দিন। বিনোদিনীর কথা উঠলে গিরিশ ঘোষের কথা ওঠে ঠিকই। তা বলে গিরিশকে চিনলে মোটেই চেনা হয় না বিনোদিনীকে। বরং বিনোদিনী গিরিশকে বেশ কিছুটা চিনিয়ে দিতে পারে।
বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনীর জন্য গিরিশকে ভূমিকা লিখতে বলেছিল, কিন্তু সে লেখা তার পছন্দ হয়নি। বিনোদিনীর মনে হয়েছিল, সত্যি কথাগুলো চেপে গিয়েছেন গিরিশ। গিরিশের ভূমিকা স্রেফ বাদ দিয়ে নিজের বই ছাপিয়ে দিয়েছিল বিনোদিনী। পরের বছরই সেই বইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণ বার হয়েছিল।
খ্যাতির চূড়ায় যখন ছিলেন সুচিত্রা সেন, তখন তাঁর এমন দাপট ছিল বটে। স্টার ভ্যালুতেও সুচিত্রার খানিক তুলনা চলে বিনোদিনীর সঙ্গে। কিন্তু মৃত্যুর ছয় দশক পরে সুচিত্রাকে ক’জন মনে রাখবে, নাটক-সিনেমা করবে তাঁকে নিয়ে, কে জানে?
বিনোদিনীর ভূমিকায় কে না অভিনয় করেছেন— নান্দীকারে মঞ্জু ভট্টাচার্য, কেয়া চক্রবর্তী, যাত্রায় বীণা দাশগুপ্ত, দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় সীমা বিশ্বাস। অমল এবং নিসার আল্লানার নাটকে বিনোদিনীর ভূমিকায় পাঁচজন অভিনয় করেছিলেন, চরিত্রের নানা দিক তুলে ধরতে।
‘ছবির মধ্যে ছবি’ ধাঁচে বিনোদিনীর জীবনের ফিল্ম বানানো নিয়ে ‘আবহমান’ করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। সেখানে বিনোদিনী করেছিলেন অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। ষাটের দশকে সুচিত্রার অভিনয় করার কথা হয়েছিল বিনোদিনীর ভূমিকায়। তার মেক আপ টেস্ট-ও হয়েছিল। অসিত সেন শেষ অবধি ছবিটা করেননি। সুচিত্রার ভূমিকায় অভিনয় করতে কারও খোঁজ যত দিন না পড়বে, তত দিন মহানায়িকাও ছাড়াতে পারবেন না বিনোদিনী দাসীকে।