বচ্ছরকার দিনে থুকপা খেতে হয়। নতুন বছর বা বর্ষবরণে এত শত খানাপিনার সমারোহ চেখে আসছি, এ কথা তো শুনি নাই। ডোমা ওয়াং তথা কলকাতার নামজাদা শেফ ডোমা বোঝালেন, পুরনো বছরের ভূত তাড়াতে থুকপার বিকল্প নেই। ভূত মানে নেগেটিভিটি। পুরনো বছরের বর্জ্য, অপচয়ের ভার। ভাবতে ভাবতে মাংসের কিমা ও তন্বী নুডলস ভরপুর টলটলে স্ফটিক স্বচ্ছ তরলের বাটিটা হাজির। এ বার তিব্বতিদের নববর্ষ লোসার ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে পড়েছে। লোসারের দু’রাত আগে থুকপা খেতেই হয়। আর্মেনিয়ান, পার্সি, চাইনিজ় নিউ ইয়ার, পোঙ্গল, বৈশাখী, বিহুর মতো তিব্বতি নববর্ষও একটু একটু বঙ্গজীবনে ছাপ ফেলছে।
ভূত বনাম থুকপা
কালিম্পংয়ে ডোমাদের শৈশবে সুপেয় থুকপার বাটিতে চুমুক মেরে গাবদা জ্যাকেট চাপানোর আরাম হত! আর এই থুকপার তলানি ঘাঁটলে মিলত একখান ময়দার গুল্লি। থুকপায় চোবানো গুল্লিতে সে কালে এক টুকরো কয়লা, তুলো, একটু নুন, লঙ্কা লুকোনো থাকত। কার ভাগ্যে কী পড়েছে, তাতে নিহিত গূঢ় তত্ত্ব। নুন পেলে সে হদ্দ কুঁড়ে। লঙ্কা মানে খিটখিটে বদমেজাজি। তুলো পেলে তার সাদা মনে কাদা নেই, কয়লা জুটলে মনের ভিতরে জমা অন্ধকার! বছর শেষের প্রাক্কালে এক বাটি থুকপা যেন চোখের সামনে আয়না মেলে ধরে। এ কালে প্রতীকী নুন, তুলো, কয়লা, লঙ্কার বদলে অনেকে ময়দার পেটের ভিতর ভাঁজ করা চিলতে কাগজ গুঁজে দেন। তাতেই মজাদার ভঙ্গিতে লেখা থাকে নানা কিসিমের ভাগ্যলিখন। এই বিশেষ দিনের থুকপাকে বলা হয় গুঠুক। ডোমার মেয়ে সাচিকো শেঠ ওরফে পুচুর রেস্তরাঁ পোপোজ়ে ঢুকলেই মালুম হবে লোসার উপলক্ষে তিব্বতি ভাগ্য পরীক্ষার আয়োজন।

থুকপা।
বছর শেষের এই থুকপা ভোজের রাতে সুদৃশ্য থালায় চোখ, মুখ আঁকা ময়দার ডেলার গোটা দুই ভূতও তৈরি রাখেন তিব্বতিরা। থুকপার ভুক্তাবশেষ, কিছু পয়সা, পরনের পোশাকের ছেঁড়া সুতো একে একে জমা হয় ময়দার ভূতেদের কাছে। জ্বালানো হয় প্রদীপ। তারপরে ঝাঁটা হাতে সমবেত চিৎকারে ভূতের থালা, জ্বলন্ত প্রদীপ হাতে মিছিল বেরোয় বাইরে। সবার মুখে ভূত তাড়ানোর মন্তর, ঠংশোমা, ঠংশোমা! বিদেয় হও, বিদেয় হও! বাড়ি থেকে দূরে তিন বা চার রাস্তার মোড়ে ভূতের থালা রেখে এসে কেউ আর ফিরে তাকাবে না! এই ‘অলক্ষ্মী বিদায়’ পর্ব মিটলে নতুন বছর পড়া পর্যন্ত তিব্বতিরা একদা বাড়ি থেকে বেরোতেনই না।
চিন ও তিব্বত
এ দেশের তিব্বতিদের ঘরে ঘরে চিনের সঙ্গে সংঘাতের পুরনো ক্ষত। কিন্তু কলকাতা বা কালিম্পংয়ে বিপদে-আপদে চিনা, তিব্বতি, লেপচা, ভুটিয়া, নেপালি, উত্তর-পুবের নানা জনজাতির জীবন এক সূত্রে গাঁথাও। চিনা ও তিব্বতি বছরগুলোও লুনার বা চান্দ্র বর্ষ। এ বছর দু’জনেরই ‘ইয়ার অব দ্য স্নেক’।
ডোমার বাবা তোরজে ওয়াং ১৯৬০-এর গোড়ায় তিব্বতের চিন সংলগ্ন আমদো প্রদেশ থেকে কালিম্পংয়ে আসেন। ডোমার জন্ম কালিম্পংয়েই। বৃত্তি পেয়ে তাইওয়ানে কলেজে যাবেন ভেবে ডোমা কলকাতায় এসেছিলেন। গেলেনও। কিন্তু বঙ্গযুবাকে বিয়ে করে এখানেই ফিরলেন। বিয়েটা থাকেনি। তবু ডোমা অনেক বাঙালির চেয়ে বেশি বাঙালি।
মোমো আর সাদা লুচি, দুটোই ডোমার প্রাণভোমরা। আবার তিব্বতি, ম্যান্ডারিন, বাংলা সবই তাঁর ঠোঁটের ডগায়। ডোমার বাড়ির ঠাকুরের তাকেও বুদ্ধ, গুরু রিনপোচের পাশে তারাপীঠের মা তারা এবং ডোমা। অনেকেই জানেন না, তারা মা এবং তিব্বতি তন্ত্র সাধনার দেবী ডোমা আসলে এক।

বাটার টি, খাপসে।
পুচু ও পোপো
সল্টলেকে এক চিলতে টেক অ্যাওয়ে থেকে শেফ ডোমার জয়যাত্রা। ডোমার কন্যা সাচিকো ওরফে পুচু নিখাদ মায়ের মেয়ে। পুচু এবং তাঁর বন্ধু মনীষা সাংমা মিলে এ বার তাঁদের নতুন রেস্তরাঁ খুলেছেন। মোমো, শা-ফালের বাইরে তিব্বতিয়ানার নানা রং তাতে। আবার ১০০ বছর আগে চিন, তিব্বতের নানা ইতিহাসের সাক্ষী দেশান্তরী এক তিব্বতি যুবাকে কুর্নিশের স্মারকও রেস্তরাঁর পরতে পরতে। তিনি পুচুর পোপো বা দাদামশায় (ডোমার বাবা) তোরজে ওয়াং। তাঁর নামেই পোপোজ়। পুচুর দেখা সেরা রন্ধনশিল্পী তাঁর পোপো। পারিবারিক ঐতিহ্য এবং জাতিগত গরিমার মিশেল এই স্বাদ উদ্ধারে।
ডোমার ছোটবেলার কালিম্পংয়ে লোসারে থালা, বাটি চালাচালি চলত পড়শিদের মধ্যে। তিব্বতি, ভুটিয়া, নেপালি, সিকিমি সংস্কৃতি একাকার সেই তিব্বতিয়ানার আধারে। পোপোজ়ে তাই পুচুর দাদামশায়ের কালো চিকেনের সঙ্গে শ্যামদেশের মাখন-নরম কিন্তু মুচমুচে থ্রাইস কুকড পর্কের সহাবস্থান। অরুণাচলের বমডিলায় মনীষার ভাইয়ের বাড়িতে ইয়াকের দুধের চিজ় ছুরপির তরকারি চেখে ভুটিয়া রান্না এমা দাৎসির রূপান্তর ঘটান পুচু। তাঁর এমা দাৎসি চিজ ভরপুর, কিন্তু নির্ভার।
লোসারের মধ্যরাতে বালিকা ডোমাকে ঘুম থেকে ডেকে দিতেন বাবা। নতুন পোশাকে সেজে দেবদেবী ও বড়দের প্রণাম করে শুকনো মাখনগন্ধী তিব্বতি পায়েস বা মিষ্টি ভাত ড্রেসিল এবং রাইস ওয়াইন খাওয়া হত। কলকাতার পর্কঅ্যাডিক্টদের দলবলকে নিয়েও সল্টলেকের বাড়ি এবং পোপোজ়ে লোসার পার্টি উদ্যাপন করেছেন ডোমা ও পুচু। তিব্বতের ধ্রুপদী নোনতা বাটার টি, মিষ্টি নিমকি গোছের বিস্কুট খাপসে থেকে রোস্ট, নুডলসে পোপোজ়ে এখন লোসারের চিরন্তন আমেজ। তিব্বতি গাউন ছুবা, ব্লাউজ় হোনজু এবং অ্যাপ্রন পাংদেনে সেজে ডোমা অনড়, যে কোনও মূল্যে নিজের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ জারি থাকবে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)