Advertisement
E-Paper

দগ্ধ জীবনের আশ্চর্য আখ্যান

গিরিশচন্দ্র ঘোষকে নিয়ে ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্য দলের নতুন নাটক ‘এক মঞ্চ এক জীবন’। মহলা দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় করেছেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও! কিন্তু কেন? নিজের লেখা ‘ভ্রান্তি’ নাটকে ওঁর তৈরি চরিত্র রঙ্গলাল বোধ হয় তারই উত্তর দিয়ে দেয়, ‘‘সংসার যে সাগর বলে, এ কথা ঠিক, কূল-কিনারা নাই। তাতে একটি ধ্রুবতারা আছে— দয়া। দয়া যে পথ দেখায়, সে পথে গেলে নবাবও হয় না, বাদশাও হয় না, তবে মনটা কিছু ঠান্ডা থাকে।’’

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
নাটকে দেবশঙ্কর হালদার ও ঝুলন ভট্টচার্য। ছবি: প্রণব বসু

নাটকে দেবশঙ্কর হালদার ও ঝুলন ভট্টচার্য। ছবি: প্রণব বসু

করেছেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও!

কিন্তু কেন?

নিজের লেখা ‘ভ্রান্তি’ নাটকে ওঁর তৈরি চরিত্র রঙ্গলাল বোধ হয় তারই উত্তর দিয়ে দেয়, ‘‘সংসার যে সাগর বলে, এ কথা ঠিক, কূল-কিনারা নাই। তাতে একটি ধ্রুবতারা আছে— দয়া। দয়া যে পথ দেখায়, সে পথে গেলে নবাবও হয় না, বাদশাও হয় না, তবে মনটা কিছু ঠান্ডা থাকে।’’

দয়াহীণ জীবন যে কতটা নির্মম তা তাঁর মতো বুঝেছে ক’জনে!

দাই-মা’র বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছেন, এগারো বছরে মাকে হারিয়েছেন, চোদ্দোতে বাবা।

তার পর একে একে বড় ভাই, প্রথম স্ত্রী প্রমোদিনী। দু-দুটি পুত্র সন্তান চলে গেছে।

শহরের অলিগলি, শ্মশান, গঙ্গার ধারে ঘুরে বেড়াতেন। সারাটা জীবনই যেন প্রিয়জন-হারা মৃত্যু মিছিলে হাঁটলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী সুরতও চলে গেলেন। এর পর দুই কন্যা, শেষে এক পুত্রও।

চূড়ান্ত অর্থাভাবের মধ্যে পড়বেন জেনেও গ্রাসাচ্ছাদনের তোয়াক্কা করেননি। নামী কোম্পনির মোটা মাইনের চাকরি ছেড়েছেন। শুধু বাংলা থিয়েটারের বর্ণপরিচয় গড়তে খামতি দেবেন না বলে! সে পথও যে আবার মসৃণ, তা’ও নয়। তাতে কী...!

তিনি যে গিরিশচন্দ্র ঘোষ!

‘চতুরঙ্গ’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, থেকে ‘রক্তকরবী’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’-র মতো ‘ক্লাসিক’ থিয়েটার করাতে সিদ্ধহস্ত ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্যদলের নতুন নাটক ‘এক মঞ্চ এক জীবন’ গিরিশচন্দ্রের মহাকাব্যিক জীবনকে নিয়েই। পরিচালনা সৌমিত্র মিত্র। নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। নামকরণ কবি শ্রীজাতর।

প্রথম শো ২০ জুলাই, সন্ধে সাড়ে ছ’টা। একাডেমি।

•••

গিরিশ বলতেন, ‘‘সংসার এক বৃহৎ থিয়েটার, রঙ্গালয় তার ক্ষুদ্র অনুকৃতি মাত্র।’’

তারই নির্যাস নিয়ে এ নাটকেও যেন থিয়েটার আর জীবনের অদ্ভুত মেলামেলি। দৃশ্য জুড়ে ঘোরে ফেরে তাঁর নাটক ‘বলিদান’, ‘রাবণবধ’, ‘চৈতন্যলীলা’, ‘সিরাজদ্দৌলা, ‘বিল্বমঙ্গল’।

তারই অনুষঙ্গে গায়ে গায়ে ফেরেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব (প্রদীপ হাইত), বিনোদিনী (ঝুলন ভট্টাচার্য), অমৃতলাল বসু (মলয় সাহা), সুরত (স্বর্ণালী ঘোষ), তারাসুন্দরী (আম্রপালী মিত্র)।

গিরিশের জীবননির্ভর কাহিনি, কিন্তু এ নাটক যে হুবহু তারই পরম্পরা নিয়ে বেড়ে উঠেছে, এমনটা নয়। বরং সময়ের বেড়াজাল ভেঙে কোথাও কোথাও যেন স্বপ্নচারী দুটি চরিত্র একে অপরকে কল্পনায় খুঁজে পাচ্ছে। তাদের চলাচলে গড়ে উঠছে এক পরাবাস্তবতার জগৎ। সে-জগতে সংলাপ কখনও কাটাকুটি খেলছে, কখনও আবার বয়ে যাচ্ছে সমান্তরাল হয়ে।

ধরতাই থেকেই সময়ভাঙা আগুপিছুর খেলা। সেই খেলার শুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষের শোকসভা দিয়ে।

তার পরে নাটকের জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় কথায় কথায় এলোমেলো আড় ভাঙে কাহিনির গদ্য।

জেগে ওঠে গিরিশের সংসার যাপন, তাঁর মরমিয়া স্ত্রী সুরতের নাট্যসাধক স্বামীর জন্য কাতরতা, গিরিশের মদিরা-প্রীতি, তাঁর অস্থিরতার, অসহায়তার আর্তনাদ, বারাঙ্গনাদের দিয়ে ‘থেটার’ করানো, তাঁর ইংরেজ-বিদ্বেষ, শাসকের নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন, তাঁর এমারেল্ড থিয়েটার, গ্রেট ন্যাশনাল হল, পরমহংসের সঙ্গে সংঘাত, এমনকী সমর্পণও, থিয়েটারের বেনিয়া গুর্মুখ রায়, হল মালিক ভুবনমোহন নিয়োগী, স্টার থিয়েটার...।

এ-নাটক বুননে নাট্যকার উজ্জ্বলের বা পরিচালক সৌমিত্রর সম্পাদনার মস্ত গুণ বোধ হয় এই যে, এখানে গিরিশচন্দ্রকে কখনওই মনুষ্য-উচ্চতা ছাড়ানো ‘দেবতুল্য’ ঋষি বানিয়ে পূজার আসনে বসানো হয়নি। অনেকটা যেমন তাঁর জীবনীকার অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘...গিরিশচন্দ্র মানুষ ছিলেন। মানুষী দুর্বলতা তাঁকেও অস্পৃষ্ট রাখেনি।।’’ ঠিক তেমনই।

গিরিশের খড়ের কাঠামোয় প্রাণ প্রতিষ্ঠার ভার দেবশঙ্কর হালদারের।

মহলায় তাঁর অভিনয় দেখতে বসে কোথায় যেন তাঁরই অভিনীত ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’-এর শিশির ভাদুড়ির সুর বসাতে শোনা গেল।

পরক্ষণেই মনে হল, এ নির্ঘাত ইচ্ছাকৃতই। শিশির ভাদুড়ি তো আজীবন একলব্যর মতো তাঁর ‘দ্রোণাচার্য’ মেনেছেন গিরিশচন্দ্রকেই। তাঁর জীবনের ছায়াপথও তো কোথাও কোথাও আশ্চর্যভাবে সমাপতিত হয় গুরুর সরণিতে। তাই ওই একই সুরের ‘ধুয়া’ তো অবশ্যম্ভাবী।

কিন্তু গিরিশের যাপন যে আরও আঘাতপ্রাপ্ত, আরও দগদগে। তাঁর বাচনেও যে অধ্যাপকসুলভ পরিশীলনের বদলে আটপৌরে মেঠো সুর! আর সেখানেই চিনিয়ে দিল ‘দেবশঙ্করীয় শৈলী’। ‘শিশিরসুলভ’ গড়ন থেকে বেরিয়ে এখানেই পুরোদস্তুর ‘গিরিশচন্দ্র’ হয়ে ওঠার দিকে গেলেন দেবশঙ্কর।

এ থিয়েটারের মস্ত পাওয়া হতে চলেছে ঝুলন ভট্টাচার্যর ‘বিনোদিনী’। বহরমপুরের ঝুলন যে এ শহরে একেবারে নতুন, তা নয়। ‘যোগাযোগ’, ‘নীল রঙের ঘোড়া’, ‘মায়ের মতো’ বা ‘ছায়াপথ’-এ কলকাতা তাঁকে দেখেছে।

কিন্তু এই নাটকের মহলায় ঝুলনের শরীরী অভিনয়, অসম্ভব সুরেলা গলায় ধরা অনায়াস গানের চলন যেন ওঁকে আগের চেয়ে ঢের বেশি ধারালো করে তোলার বার্তা দিল। তা যদি হয়, তবে তার অনেকটাই সাধুবাদ পাওনা নির্দেশকের।

সত্তরের মাঝামাঝি নট্ট কোম্পানির যাত্রাপালা ‘নটী বিনোদিনী’ যখন বাংলা মাত করছে, তখন রবিবারের দুপুরগুলোয় বিবিধ ভারতী থেকে বারবার ভেসে আসত বীণা দাশগুপ্তর ‘আমি ভবে একা দাও হে দেখা’, ‘হরি মন মজায়ে লুকালে কোথা’-র মতো গানগুলো। সে-কণ্ঠ একবার যার কানে গিয়েছে, মোহিত হয়েছে। ঝুলনের গানও ততটাই মুগ্ধ করার সম্ভাবনা নিয়ে তৈরির পথে।

দশটি গান। তার ছ’টিতে নতুন করে সুর লাগিয়েছেন প্রবীণ সুরকার মুরারি রায়চৌধুরী।

গানে-বাজনায় পুরোপুরি মুরারি-ঘরানায় টুকরো টুকরো করে লেগে আছে অসংখ্য রাগ। শঙ্করা, চন্দ্রকোষ, খাম্বাজ, হংসধ্বনি, টোডি, সারং, বাগেশ্রী...। আর যন্ত্র? ক্যারিওনেট, বেহালা, এসরাজ, বাঁশি, তালবাদ্য....। একেবারে শেষে এসে জুড়ে যাচ্ছে তারসানাই।

থিয়েট্রিকাল অর্কেস্ট্রার স্টাইলে এই সব সুরের বিন্যাস এমনই আবেশ ঘনিয়ে তুলছে যেন সংলাপ, কী গানের পাশে চলা স্বরেও ভেসে বেড়াচ্ছে না-বলা কথার রেশ।

অসম্ভব নিরাভরণ, অথচ একই সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত ও স্পর্শকাতর একটি মঞ্চ বানিয়েছেন সৌমিক-পিয়ালী। খয়েরি-কালো রং-ধরা অল্প উঁচু পাঁচকোনা-তেকোনা-চৌকোনা কয়েকটা পাটাতন। মঞ্চের আড়াআড়ি অনেকটা জুড়ে। কোথাও কোথাও একটি পাটাতন চাপানো অন্যটির ওপর। কোথাও আবার তা’ নয়।

মঞ্চের বাঁ দিকে শুধু পুরনো ধাঁচের একটি চেয়ার, একটি টেবিল। একেবারে পিছনের পর্দায় সাইক্লোরামায় গায়ে ঝোলে আঁকা-বাঁকা চার হাতওলা তিনটে কাঠের ফ্রেম। যার ওপর আলো (সুদীপ সান্যাল) পড়লে অদ্ভুত এক স্বপ্নালু ঘোর লাগে! ওই তিন ফ্রেমের বন্ধনীকে কখনও মনে হয় সর্বধর্ম মিলনের চিহ্ন, কখনও আগল ভাঙা জীবনের চৌকাঠ, কখনও শুধুই অন্ধকার থেকে উৎসারিত আলোর প্রতীক!

গোটা থিয়েটার জুড়ে অসংখ্য রঙের খেলা। তা যেমন আলোয়, তেমন পোশাকেও (মালবিকা মিত্র)।

‘পূর্বপশ্চিম’-এর ঠিক আগের নাটক ‘হাঁসুলী...’ যেখানে ছিল আগাগোড়া সাদা-কালোয় মোড়া বোশেখি ঝ়ড়ের উড়ান, সেখানে এ নাটক ঠিক তার বিপরীত। প্যালেট উপচে পড়া রঙে বসন্তের গুলবাগিচা যেমন হয়, অনেকটা তেমন। জ্বলজ্বলে, মনোমুগ্ধকর, প্রাণচঞ্চল।

গিরিশচন্দ্র ঘোষের বহুরঙা, বহুমাত্রিক জীবন ধরতে এই ক্যানভাসটি বড় জরুরি ছিল।

Purba-pashchim Theatre
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy