Advertisement
E-Paper

চন্দ্রকেতুগড়ে  ইতিহাসদর্শন

শহর থেকে অনতিদূরে বেড়াচাঁপা। আর কয়েক পা এগোলেই চন্দ্রকেতুগড়। তারই ইতিহাস খুঁড়ে দেখলেন  অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য শহর থেকে অনতিদূরে বেড়াচাঁপা। আর কয়েক পা এগোলেই চন্দ্রকেতুগড়। তারই ইতিহাস খুঁড়ে দেখলেন  অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:০২

শ্রাবস্তীতে অবিশ্বাসীদের বুদ্ধ দেখালেন ‘যমক প্রাতিহার্য’। তাঁর কাঁধ থেকে বেরিয়ে এল আগুন। পায়ের পাতা থেকে জল। সারা ভারতে বুদ্ধের সেই মূর্তির হাতে অভয়মুদ্রা। চন্দ্রকেতু গড়ে করুণাঘন তথাগত কিন্তু বজ্রমুষ্টি।

বাকি ভূখণ্ডের সঙ্গে চন্দ্রকেতুগড়ের সম্পর্কটি এমনই ছিল। অঙ্গ, কিন্তু স্বতন্ত্র।

আর এখানেই উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাঁপার কাছের এই প্রাচীন জনপদটির গুরুত্ব। উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে এই বন্দর নগরীর সম্পর্ক ছিল। এমনকী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল এই নগরীর। কিন্তু সে তার স্বতন্ত্র পরিচয়েই পরিচিত ছিল। সম্ভবত সেই পরিচয়ের জন্যই তার কদর ছিল সমুদ্রপাড়েও। যে কারণে এখান থেকে মিলেছে বণিক, নাবিকদের হাতে হাতে ক্ষয়ে যাওয়া রৌপ্যমুদ্রা। এই যে মুদ্রা এত হাত বদল করেছে, তাতে বোঝা যায়, এই নগরী বিশিষ্ট বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। এখান থেকে পাওয়া সিলমোহরে মিলেছে পাল তোলা নৌকো, ঘোড়ার প্রতিকৃতি। অনেকে মনে করেন, ঘোড়া রফতানি হত চন্দ্রকেতুগড় থেকেই। কিন্তু জলপথ ছিল কোথায়?

ভূতত্ত্ববিদেরা স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে চন্দ্রকেতুগড়ের কাছেই নদীর অস্তিত্ব টের পেয়েছেন। সেই নদী বহুকাল হারিয়ে গিয়েছে। তা গঙ্গার আদি খাত ছিল কি না, রয়েছে তর্ক। এক সময় সমুদ্রও তার কাছাকাছি ছিল। এখন সরে গিয়েছে। কিন্তু রয়ে গিয়েছে একটি সমৃদ্ধ নগরীর অজস্র চিহ্ন। পুরাতত্ত্ববিদদের ধারণা, হারিয়ে যাওয়া নদীটি ধরেই চন্দ্রকেতুগড় প্রায় পাঁচশো বছর ধরে ক্রমশ সমৃদ্ধ নগরী হয়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে এখানে আসতেন বিভিন্ন দেশের মানুষ। আসতেন বণিকেরা। শ্রমণেরা। ব্রাহ্মণ্যধর্মেরও প্রতাপ ছিল। নানা পরিচয়ের মানুষের আসার চিহ্ন যে ছড়িয়ে রয়েছে এই এলাকাতে, তা থেকেও বোঝা যায়, তাম্রলিপ্ত যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার কাছাকাছি সম্মান চন্দ্রকেতুগড়েরও প্রাপ্য। তবে তাম্রলিপ্ত আর চন্দ্রকেতুগড়ের নৌ বাণিজ্য পথ ছিল আলাদা। যে কারণে, এই জনপদের ধ্বংসাবশেষ আদি বাঙালির অজানা একটি পরিচয় ধরে রেখেছে। যে জনপদ বাকি দেশের সংস্কৃতির অঙ্গ, কিন্তু তার স্বাতন্ত্র্যও রয়েছে। তাম্রলিপ্ত থেকেও সে আলাদা। শিল্প ইতিহাসবিদ নমন আহুজা দেখিয়েছেন, গান্ধার শিল্পরীতির ভাস্কর্য চন্দ্রকেতুগড়ে মিলেছে। কিন্তু চরিত্রগুলোর পোশাক এই এলাকার মতোই। শিল্পরীতিটুকু নিয়েও যে তা নিজের মতো করে গড়ে নেওয়া যায়, তার প্রমাণ চন্দ্রকেতুগড়ের পোড়ামাটির শিল্পকর্ম থেকে পাওয়া যায়। সে কারণেই, শ্রাবস্তীর বুদ্ধের হাতের মুদ্রা চন্দ্রকেতুগড়ে অন্য রকম।

তবে চন্দ্রকেতুগড় নামটি কোথা থেকে এল, তা নিয়ে তর্ক রয়েছে। ইতিহাসবিদদের ধারণা, মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পরে ছোট ছোট যে নগরগুলোর উত্থান হয়, চন্দ্রকেতুগড় তারই একটি। সে সময় তার নাম কী ছিল, এখন আর জানা যায় না। ফা হিয়েন বা হিউয়েন সাংয়ের লেখায় তার উল্লেখ নেই। তাই পঞ্চম শতাব্দীতেই চন্দ্রকেতুগড় আস্তে আস্তে মলিন হতে শুরু করে বলে অনেকে মনে করেন। তবে মনে রাখতে হবে, সপ্তম শতকে ভারতে এসে হিউয়েন সাং দেশে ফেরার কুড়ি বছর পরে তাঁর ভ্রমণ কাহিনিটি লিখতে শুরু করেছিলেন। তাঁর ভারতে আসার উদ্দেশ্যও ছিল আলাদা। তাই তাঁর স্মৃতি থেকে কিছু হারিয়ে গিয়েছিল কি না, আমরা জানি না। এ কথা বলার কারণ হল, পাল যুগের একটি বৌদ্ধ মন্দিরও চন্দ্রকেতুগড়ে পাওয়া গিয়েছে।

তারও পরবর্তী কালে কাছেই হাড়োয়াতে গোরাচাঁদ নামে এক পির থাকতেন। সেই সময়েই চন্দ্রকেতু নামে এক রাজা বা জমিদার এই অঞ্চলে থাকতেন, এমন অনুমান করা হয়। চন্দ্রকেতুর সঙ্গে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সম্পর্ক রয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু ইতিহাসবিদেরা চন্দ্রকেতুর সঙ্গে তাঁর কোনও সরাসরি সম্পর্ক পাননি। যদি পেতেন, তবে তা বড় কথা হত নিশ্চয়ই। কিন্তু এই এলাকার গৌরব কেবল মৌর্য রাজার নামের সঙ্গে মিলের জন্য নয়। গৌরব তার স্বাতন্ত্র্যে।

ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, মগধ ভেঙে যাওয়ার পরে ছোট ছোট জনপদ বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয়েছিল। চন্দ্রকেতুগড় তেমনই কোনও একটি জনপদ। এই জনপদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ এলাকার কী সম্পর্ক ছিল, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বন্দর নগরী বলেই এই নগরীর পরিচয় বলে যেমন অনেকে মনে করেন। তেমনই কারও কারও মতে, এই এলাকায় কোনও বড় জনপদ ছিল। যার প্রধান নগরীটি ছিল চন্দ্রকেতুগড়। সে ক্ষেত্রে চন্দ্রকেতুগড় অবশ্যই একটি বড় বসতির অঙ্গ।

তবে বন্দর-নগরী হলে, আশপাশে কারিগরদের থাকার জায়গা নিশ্চয়ই ছিল। ইতিহাসবিদদের ধারণা, তাম্রলিপ্ত বন্দরকে ঘিরে যে বাণিজ্যপথ ছিল, চন্দ্রকেতুগড়ের বাণিজ্য সঞ্চার সম্ভবত তার থেকে আলাদা পথে হয়েছিল।

তাই তার স্বাতন্ত্র্য আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা হয়ে ওঠে। তাই, এটাও জানা খুবই দরকার হয়ে পড়ে যে, সেই জনপদের অধিকার কার হাতে ছিল? কে ছিলেন রাজা? কেমন ছিলেন তাঁরা? তার খোঁজ এখনও বাকি।

সেই খোঁজ তো দূরের কথা, পুরাবস্তুগুলির যথাযথ যত্ন নেওয়া হচ্ছে না বলেই আক্ষেপ। সম্প্রতি সংসদে চন্দ্রকেতুগড়ের রক্ষণাবেক্ষণের দাবি, যথাযথ খনন ও পুরাবস্তুগুলোকে নিয়ে উপযুক্ত গবেষণার দাবি জানান বারাসতের সাংসদ। তার পর রাজ্য পর্যটন দফতর ও জেলা প্রশাসনের একটি দল চন্দ্রকেতুগড় ঘুরে দেখে। বেড়াচাঁপাতেই ৫০ বছর ধরে চন্দ্রকেতুগড়ের এমন সব পুরাকীর্তি সংগ্রহ করে নিজের বাড়িতে বাঁচিয়ে রেখেছেন অশীতিপর দিলীপকুমার মৈতে। রাজ্য পর্যটন দফতরের সচিব জানিয়েছেন, চন্দ্রকেতুগড়ে পর্যটন কেন্দ্র ও সংগ্রহশালা গড়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। চন্দ্রকেতুগড় ছাড়াও ওই এলাকা সংলগ্ন ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়ি, টাকির ইছামতী নদীতে ঘুরে বেড়াবার বিশেষ প্যাকেজ ট্যুরও রয়েছে ভাবনায়।

কলকাতা থেকে যশোর রোড ধরে বারাসত হয়ে টাকি রোডে যেতে হয় দেগঙ্গার বেড়াচাঁপা মোড়। সেখান থেকে বাঁ দিকে চলে গিয়েছে পৃথীবা রোড। সেই রাস্তার পাশেই খনা-মিহিরের ঢিপি। বেড়াচাঁপা মোড় থেকে ডান দিকে হাড়োয়া রোড ধরে কিছুটা গেলেই চন্দ্রকেতুগড়। দেখা মিলবে, বিশাল উঁচু মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকা এক সুদীর্ঘ ইতিহাস।

ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়

কীভাবে যাবেন

• এয়ারপোর্ট থেকে বারাসতের চাঁপাডালি মোড় ১১ কিমি। সেখান থেকে টাকি রোড ধরে বসিরহাটের দিকে যেতে বেড়াচাঁপা ২১ কিলোমিটার।

•বেড়াচাঁপা থেকে বাঁ দিকে পৃথীবা রোডের পাশেই খনা-মিহিরের ঢিপি।

• বেড়াচাঁপা মোড় থেকে ডান দিকে হাড়োয়া রোড ধরে কিছুটা গেলেই চন্দ্রকেতুগড়।

• ট্রেনে শিয়ালদহ থেকে হাসনাবাদগামী ট্রেনে হাড়োয়া রোড স্টেশনে নামতে হবে।
• লাগবে ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। তার পর অটো ধরতে হবে।

কোথায় থাকবেন

• এখানে থাকার জায়গা বলতে মাত্র একটিই। নাম ‘পথের সাথী’। সরকারি উদ্যোগে এই ছোট জায়গায় পর্যটকেরা থাকতে পারেন স্বচ্ছন্দে। তবে থাকার জন্য আগে থেকে যোগাযোগ করে যাওয়াই শ্রেয়।

Travel and Tourism Chandraketugarh Berachampa চন্দ্রকেতুগড়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy