Advertisement
E-Paper

অনু পরিমাণ

ইন্ডাস্ট্রির সবার কাছে তিনি ‘অনু’। অনুপকুমার মোটেও নন। তাঁর সঙ্গে সহকর্মীদের অভিজ্ঞতার খণ্ড মুহূর্তবেঁকে বসে ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। স্টার থিয়েটার। নাটকের নাম ‘শ্যামলী’। পরিচালক-নাট্যকার দেবনারায়ণ গুপ্তর কাছে তাঁর অভিযোগ অনুপকুমারের নামে। রেগেমেগে ভানু বললেন, “দেবুদা, আমি সিনে যামু না।” “কেন, কী হল আবার?” “ফার্স্ট অ্যাক্ট সেকেন্ড সিনে আপনের পাপিষ্ঠ আমারে নিত্য খোঁচাইয়া মারে।” “সে কী! কী করে?” এর পর ভানু যা বলেছিলেন, তা এইরকম— রিকুইজিশন ঘরে গিয়ে একটা ছোট সরু ছিপের মতো লাঠি জোগাড় করে উইংসের ধারে বসতেন অনুপকুমার। পাশে তিনজন শাগরেদ। ভানু যেই সিনে ঢুকতেন, অমনি ছিপ বাড়িয়ে ওঁর পায়ে খোঁচা মারতে থাকতেন তিনি।

স্মরণ ২...

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৪ ১২:১৯
বালিকাবধূ

বালিকাবধূ

বেঁকে বসে ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

স্টার থিয়েটার। নাটকের নাম ‘শ্যামলী’। পরিচালক-নাট্যকার দেবনারায়ণ গুপ্তর কাছে তাঁর অভিযোগ অনুপকুমারের নামে।

রেগেমেগে ভানু বললেন, “দেবুদা, আমি সিনে যামু না।”

“কেন, কী হল আবার?”

“ফার্স্ট অ্যাক্ট সেকেন্ড সিনে আপনের পাপিষ্ঠ আমারে নিত্য খোঁচাইয়া মারে।”

“সে কী! কী করে?”

এর পর ভানু যা বলেছিলেন, তা এইরকম— রিকুইজিশন ঘরে গিয়ে একটা ছোট সরু ছিপের মতো লাঠি জোগাড় করে উইংসের ধারে বসতেন অনুপকুমার। পাশে তিনজন শাগরেদ। ভানু যেই সিনে ঢুকতেন, অমনি ছিপ বাড়িয়ে ওঁর পায়ে খোঁচা মারতে থাকতেন তিনি।

তাতে ভানু যত লাফান, অনুপ তত খোঁচান। আর অডিটোরিয়ামে হাসির বন্যা বয়ে যায়। এ দিকে ভানুর অবস্থা তো কহতব্য নয়! তাঁর অনুকে বারণ করলেও শোনে না। শেষে সামাল দিতে হল দেবনারায়ণবাবুকেই।

সেকেন্ড শো শুরু হতে একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন অনুপকুমার। ছপাং করে এক লাঠির ঘা পিছন থেকে। “এই দেবুদা স্যার, আপনি?” উত্তরে দেবুবাবু বলেন, “তোর আবার স্যার কবে থেকে হলাম পাপিষ্ঠ?”

এতেও কি থামানো যায় তাঁকে! বললেন, “যবে থেকে স্কুলমাস্টারের মতো লাঠি ধরেছেন।”

‘বসন্তবিলাপ’ করতে গিয়ে ঝামেলায় ফেলে ছেড়েছিলেন অপর্ণা সেনকে। এক জায়গায় অপর্ণা নিজেই বলছেন, “অনুপদার সঙ্গে রিহার্সালে কিছুই বোঝা যেত না, শেষ পর্যন্ত কী হবে, শটে এসে এত ইম্প্রোভাইজ করতেন। আমি বেশ মুশকিলে পড়েছিলাম। রেগে কেঁদে একটা বিশ্রী ব্যাপার।”

ছবিতে ছেলে আর মেয়েদের দুটো দলের টক্কর। যাই-ই করা হয়, অনুপ তার পাল্টা জবাব দিয়ে দেন। কিছুতেই জিততে পারে না মেয়েদের দল। শেষে এমন অবস্থা, অপর্ণা বলছেন, “এ ভাবে আমি আর করব না। পারব না।” এ দিকে মেয়েদলের নেত্রী খোদ তিনিই।

তখন রবি ঘোষ অপর্ণাকে বুদ্ধি বাতলালেন, “শোন, ও যা বলবে, তাতেই তুই ভেংচি কেটে দিবি।” শেষমেশ এই বুদ্ধিতেই পার পাওয়া গিয়েছিল।

প্রথম প্রথম অনুপকুমারের সঙ্গে অভিনয়ে বেকায়দায় পড়তেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ও। ওঁর পর্দার জীবন শুরুই হয় অনুপকুমারের হাত ধরে। ‘পাশের বাড়ি’। এক জায়গায় সাবিত্রী বলেছিলেন, “এর আগে অবশ্য স্টেজে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু সিনেমার টেকনিকাল কত কিছু যে ওঁর কাছে শেখা!”

এক দিকে এই শেখানো আছে, অন্য দিকে টেক-এ কিন্তু ‘ছাড়ান’ নেই! “মনিটর দিলেন হয়তো এক রকম, টেক-এর সময় নতুন কিছু জুড়ে দিতেন, তাতে কত বার ঝগড়া পর্যন্ত করেছি ওঁর সঙ্গে!”

অনুপকুমারের এই ‘ইম্প্রোভাইজেশন’-এ দর্শক খুব ফেটে পড়ত ঠিকই। কিন্তু এক-আধবার মহা সমস্যায় পড়ে যেতেন নাটকের কর্তাব্যক্তিরা। নাটক যে ক্রমেই বেড়ে যায়। সময়ে আর শেষ হয় না।

তেমনই অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন নাট্যকার-প্রযোজক গণেশ মুখোপাধ্যায়।


‘ত্রিযামা’য় উত্তমকুমারের সঙ্গে

স্টারেই নাটক। ‘শেষাগ্নি’। পরিচালক আবার সেই দেবনারায়ণ গুপ্ত। কাহিনি শক্তিপদ রাজগুরুর। সেখানে অনুপকুমার ছোটখাটো এক ডাকাত। গীতা দে ডাকাতের প্রণয়িনী। সেই ডাকাত লোকজনের বাগানের বাড়ি থেকে লুঠ করা লাউ, কুমড়ো, পুকুরের মাছ তার প্রেয়সীকে দিয়ে প্রেম জানায়। আর প্রতি শো-এ দর্শক ওঁদের নতুন নতুন সব কর্মকাণ্ড দেখে হাসিতে ফেটে পড়ে। দুর্দান্ত জমে গেল নাটক। শক্তিপদ তো দারুণ খুশি।

কিন্তু পঞ্চাশ রজনী পার হতেই বোঝা গেল, নাটক শেষ হচ্ছে তিন ঘণ্টার জায়গায় সাড়ে তিন ঘণ্টার পর। সৌজন্য অনুপকুমারের ‘ইম্প্রোভাইজেশন’। ফলে ডবল শো-তে প্রচণ্ড অসুবিধে। আর্টিস্টরা চেঞ্জ পর্যন্ত করার সময় পাচ্ছেন না। আরও অসুবিধে লাস্ট শো-এ। ট্রেনে ফেরার দর্শকরা গাড়ি মিস করছেন।

আবার মাঠে নামতে হল দেবুবাবুকে। এক দিন ঠিক করলেন হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন।

সে দিন অনুপ-গীতার সিন। সিনে ঢোকার একটাই দরজা। ও ধারে পাঁচিল। দেবুবাবু একখানা লাঠি নিয়ে সেই দরজার ধারে দাঁড়ালেন। পাশে শক্তিপদ। অনুপকুমার ডায়লগ শুরু করতেই লাঠি দেখিয়ে ইশারায় বললেন, “একটু বাড়াবাড়ি করলে লাঠির বাড়ি দেব।”

কে কার কথা শোনে!

শেষে গীতা দে-কে আকারেইঙ্গিতে দেবুবাবু বললেন, “ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দে।”

গীতা দে বাধ্য হয়ে অনুপকুমারকে তাড়াবার জন্য দরজার দিকে ঠেলা দিতেই দেখলেন, অনুপকুমার পিছলে দরজা ছেড়ে উল্টো দিকে পাঁচিলের রাস্তায় যাচ্ছেন। গীতা বললেন, “আরে ও দিকে কোথায় যাবি, ও ধারে যে পাঁচিল।”

তাতে চটজলদি অনুপবাবুর জবাব, “ওরে ফুলটুসি, আমি যে ডাকাত। পাঁচিল টপকানো আমার পেশা।” তারপর দেবুবাবুদের দিকে আঙুল তুলে বললেন, “দেখছিস না, দরজার ধারে লাঠি হাতে দুটো টিকটিকি দাঁড়িয়ে। আমি পাঁচিল টপকেই পালাব।”

এর পরে আর দর্শককে থামানো যায়!

এত কাণ্ড করতেন। অথচ থিয়েটার হলে যখন পা রাখতেন, তখন কে বলবে, এই মানুষটাই কিছুক্ষণ বাদে পেটে খিল ধরিয়ে দেবেন!

মনোজ মিত্র তেমনই এক অনুভূতির কথা শুনিয়েছিলেন একবার।

“চুয়ান্ন সাল। প্রথম ওঁকে চাক্ষুষ করি। স্টারে। ‘শ্যামলী’ দেখতে গিয়ে। শো আরম্ভের দেরি আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ করছিলাম নটনটীদের আগমন। সবাই যেন কেমন টেনশন নিয়ে ঢুকছেন। যেন যুদ্ধক্ষেত্রে চলেছেন। শেষে তাঁকেও দেখলাম। দোতলা বাস থেকে নামলেন। ধুতির ওপর শার্ট পরা। কোট। কোলাপুরি চটি পায়ে। আগে মুখ দেখা না থাকলে মনে হত বাবুটি বোধহয় হাতিবাগানে বাজার করতে এলেন। বেশ খানিকক্ষণ হলের সামনে দাঁড়িয়ে এর-তার সঙ্গে গল্প করলেন। নিশ্চিন্তে পান চিবোলেন। ছোটখাটো ভিড় জমল ওঁকে ঘিরে। তারপর এক সময় খোশমেজাজে সাজঘরের দিকে পা বাড়ালেন।”

এই ছিলেন অনুপকুমার!

(সংকলিত)
সূত্র: আনন্দবাজার আর্কাইভ,
বেঙ্গলি ফিল্ম লাভার্স সোসাইটি
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: হিমাদ্রী দাস

anup kumar memorial memory
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy