Advertisement
০২ মে ২০২৪

আমার স্বামী

নীহাররঞ্জন গুপ্তর কথা বলছেন সহধর্মিণী কনক গুপ্তআমাদের যখন বিয়ে হয়, আমি তখন সতেরো। ও সাতাশ। মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করে। সবে দুটো বই, ‘রাজকুমার’ আর ‘কালোভ্রমর’ বেরিয়েছে। কোনও এক আত্মীয় সম্বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সে ১৯৩৯ সালের কথা। একই দিনে আমার মেজ বোন আর আমার বিয়ে হয়। আমরা চার বোন। এক ভাই। আমার ছেলেবেলা কেটেছে বেনারসে। পড়াশোনায় খুব খারাপ ছিলাম না। সবে ম্যাট্রিকুলেশনে অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছি, রেজাল্টও বেরোয়নি, তার আগেই বিয়ে।

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

আমাদের যখন বিয়ে হয়, আমি তখন সতেরো। ও সাতাশ। মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করে। সবে দুটো বই, ‘রাজকুমার’ আর ‘কালোভ্রমর’ বেরিয়েছে।

কোনও এক আত্মীয় সম্বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সে ১৯৩৯ সালের কথা। একই দিনে আমার মেজ বোন আর আমার বিয়ে হয়।

আমরা চার বোন। এক ভাই। আমার ছেলেবেলা কেটেছে বেনারসে। পড়াশোনায় খুব খারাপ ছিলাম না। সবে ম্যাট্রিকুলেশনে অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছি, রেজাল্টও বেরোয়নি, তার আগেই বিয়ে। পরে জেনেছিলাম পরীক্ষায় পাস করেছি। তবু পড়া আর হল না।

শ্বশুরমশাই-স্বামী দু’জনেই খুব চেয়েছিলেন পড়াতে। কিন্তু আমার চোখে গ্লকোমার সমস্যা ছিল বলে পড়া ছেড়ে দিতে হল।

আমার শ্বশুরমশাইয়ের নাম ছিল সত্যরঞ্জন। শাশুড়ি লবঙ্গলতা। ওঁদের দেশের বাড়ি বাংলাদেশে। ইতলা গ্রামে। নড়াল মহকুমায়। মধুমতী নদীর ধারে। সেখানে আমার যাওয়া হয়নি। ওঁর লেখা ‘মধুমতী থেকে ভাগীরথী’ বইতে ওই গ্রামের কথা পড়েছি। ওঁর জন্ম অবশ্য কলকাতায়। মনোহরপুকুর রোডে। ১৯১১-র ৬ জুন।

ওঁদের দেশের বাড়িতে খুব গানবাজনার চল ছিল। যাত্রা-থিয়েটার হত। উনিও তাতে অভিনয় করতেন। খুব ভাল বাঁশি বাজাতেন। বুকে চাপ লাগত বলে বাঁশি ছেড়ে দিতে হয়।

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতেন। প্রায় তিনটে-চারটে নাগাদ। কুকুর নিয়ে লেকের ধারে বেড়াতে যেতেন। পাঁচটার সময় ফিরে দোতলার ঘরে চলে যেতেন লিখতে। সকাল সাতটা পর্যন্ত লিখতেন। ওঁর লেখার যেমন নির্দিষ্ট ঘর ছিল, তেমন চেয়ার টেবিলও ছিল নির্দিষ্ট।

লেখা শেষ হলে কুলদেবতার পুজোয় বসতেন। আমার কুলদেবতা গোপাল। পুজো সেরে মায়ের পায়ের আঙুল ধোয়া জল খেতেন নিয়ম করে। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে চলে যেতেন নীলরতন হাসপাতাল।

খুব খেতে ভালবাসতেন। খাওয়াতেও। বাড়িতে এসে কেউ না খেয়েদেয়ে চলে গেছে শুনলে খুব রাগ করতেন। খেতে ভালবাসলেও খুব যে বেশি খেতেন, তা নয়। সকালে একটা রুটি। একটু ছানা। দুপুরে ভাত, মাছ, সামান্য মিষ্টি। রাতে একটা রুটি আর স্টু। ‘চেন স্মোকার’ ছিলেন। গল স্টোন হওয়ার পর সিগারেট ছেড়ে দেন।

সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন। রাতেও গা ধোওয়া চাই। সে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা যাই-ই হোক। স্নান সেরে বাড়িতে থাকলে পরতেন মাদ্রাজি জরিওলা গেঞ্জি। আর পাঞ্জাবি। পা়ঞ্জাবিতে বুকের বোতাম লাগাতে আমি কোনও দিন দেখিনি।

এমনিতে খুব দয়ার মন ছিল। কেউ যদি অসুখের কারণে পড়াশোনা করতে না পারত, বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন তার। ছিলেন খুব রসিকও। আর অসম্ভব ভুলো। ডাক্তারি ক্লাসে পড়াতে পড়াতে এত মগ্ন হয়ে প়ড়তেন, ছাত্ররা দুষ্টুমি করে পকেট থেকে সিগারেট তুলে নিলেও টের পেতেন না।

ওঁর গল্প ‘লালুভুলু’ নিয়ে সিনেমা হল হিন্দিতে। ‘দোস্তি’। বড় পুরস্কার পেলেন। খুব আনন্দ পেয়েছিলেন তাতে। আমার ইচ্ছে ছিল ‘কিরীটি রায়’ নিয়েও সিনেমা হোক, কিন্তু নানা কারণে সে আর হয়ে ওঠেনি। উনি অবশ্য শেষ দিকে ওঁর গল্প নিয়ে সিনেমা করার ব্যাপারটায় তেমন উৎসাহী ছিলেন না। বলতেন, ‘‘গল্পগুলো এত পাল্টে যায়, দেখতে ইচ্ছে করে না।’’

ওঁর জীবনে একটা ঘটনা অলৌকিকের মতো বারে বারে ঘটত। কালীপুজোর সময় কুমোরপাড়া থেকে ঠাকুর আসত। প্রতিমা আনতে গিয়ে যেবারই মূর্তির হাত-পা-আঙুল ভাঙত, আমার স্বামীরও সেবার সেই জায়গাতেই চোট লাগত।

নানা ধরনের বই পড়তেন। বিশেষ করে চিকিৎসার বই। মনীষীদের জীবনী। যা পড়তেন আমায় বলতেন। লেখালেখি নিয়েও আমার সঙ্গে অনেক কথা হত। আমার কিছু অপছন্দ হলে উনি তা বদলে দিয়েছেন, এমনও হয়েছে।

১৯৮৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ কী যে হয়ে গেল! ঘুম থেকে উঠলেন। বললেন, ‘‘কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। বাথরুমে গেলেন। ফিরে বড় চেয়ারটায় বসলেন। আমায় ডাকলেন, ‘‘জুঁই।’’ আর কোনও কথা নয়।

ডাক্তার মুখার্জিকে ডাকা হল। এসেই উনি ইঞ্জেকশন দিলেন। দেখতে দেখতে চেয়ারেই মাথাটা ঝুলে পড়ল। সব শেষ...

(সংকলিত)

সৌজন্য: ‘আমার স্বামী’ (অরুণ মুখোপাধ্যায়)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kanak gupta patrika anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE