Advertisement
০৪ মে ২০২৪

চেনের প্রাচীরে ফাটল

সিনেমাপাড়ার রাধা-পূর্ণ-প্রাচী কী উত্তরা-পূরবী-উজ্জ্বলার মতো বহু ‘চেন’ আর নেই। মাল্টিপ্লেক্সই ভবিষ্যত্‌? উত্তর খুঁজলেন শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়।বিদেশে গিয়ে প্রথম বার মাল্টিপ্লেক্স দেখে মহা উত্‌সাহিত হয়ে কলকাতার বাড়িতে চিঠি দিয়েছিল এক তরুণ দম্পতি। শহরে এবং মফস্‌সলে মেয়েটির পরিবারের কয়েকটি সিনেমা হল ছিল। সবই সিঙ্গল স্ক্রিন, বড় থেকে মাঝারি মাপের হল। তখনও কলকাতায় কোনও মাল্টিপ্লেক্স নেই। নয়াদিল্লির সাকেতে সেই বছরই দেশের প্রথম মাল্টিপ্লেক্সটি তৈরি হয়েছে।

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

বিদেশে গিয়ে প্রথম বার মাল্টিপ্লেক্স দেখে মহা উত্‌সাহিত হয়ে কলকাতার বাড়িতে চিঠি দিয়েছিল এক তরুণ দম্পতি।

শহরে এবং মফস্‌সলে মেয়েটির পরিবারের কয়েকটি সিনেমা হল ছিল। সবই সিঙ্গল স্ক্রিন, বড় থেকে মাঝারি মাপের হল। তখনও কলকাতায় কোনও মাল্টিপ্লেক্স নেই। নয়াদিল্লির সাকেতে সেই বছরই দেশের প্রথম মাল্টিপ্লেক্সটি তৈরি হয়েছে।

ওরা চিঠিতে লিখেছিল, একটা বড় সিনেমা হল নয়, বরং একসঙ্গে একাধিক ছোট হলই সম্ভবত বিনোদনের ভবিষ্যত্‌।

আমেরিকায় প্রাইসওয়াটার হাউস কুপার্সে কাজ করত ওদের এক বন্ধু, সে রীতিমতো ছক কষে বুঝিয়েছিল, কী ভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফুড চেন এবং ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো নিজেদের ঘর থেকে লগ্নি নিয়ে এসে যোগ দেয় এ ধরনের প্রকল্পে, ফলে বিনিয়োগের ঝুঁকিও অনেক কমে যায়।

ধারণাটা ভাল লাগলেও সিনেমা হলের চিরাচরিত ধারা ছেড়ে হঠাত্‌ এ রকম নতুন কিছু করতে ভরসা পাননি মেয়েটির পরিবার।

ওই চিঠি যিনি পেয়েছিলেন, ‘বসুশ্রী’ সিনেমা হলের সেই মন্টু বোস মারা গেলেন সম্প্রতি। বসুশ্রী এখনও সিঙ্গল স্ক্রিন। নিয়মিত শো হয়, এই পর্যন্ত।

কিন্তু বসুশ্রীর এ পাশে ‘উজ্জ্বলা’ অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। সিনেমা হল ভেঙে বাড়ি উঠেছে, এখন চলছে কেবল হাতে গরম ‘উজ্জ্বলার চানাচুর’! হাজরা মোড়ের ওপাশে ‘বিজলী’, ‘ইন্দিরা’ চালু আছে, কিন্তু বন্ধ ‘ভারতী’, ‘পূর্ণ’।

চৌরঙ্গি পাড়ার দুরবস্থা চোখে দেখা যায় না। ‘টাইগার’ সেই কবেই ঝাঁপ ফেলেছে, ‘গ্লোব’ও বন্ধ। ‘লাইটহাউস’ এখন জামাকাপড়ের মস্ত বাজার, ‘যমুনা’ ব্যঙ্কোয়েট হল। শিবরাত্তিরের সলতে একা ‘নিউ এম্পায়ার’, সেখানেও অমন একটা রাজসিক লবির বারো আনা খেয়ে নিয়েছে ফুড কোর্ট।

প্লাস পয়েন্ট

• বসার জায়গাটা বেশ ভাল, পরিবেশও

• একেবারে অত্যাধুনিক শব্দযন্ত্র, প্রযুক্তি। তাই সিনেমা দেখাটা অনেক আরামের

• এক ছাতার তলায় ফুড কোর্ট, শপিং মল মিলিয়ে হাজারটা ব্যাপারস্যাপার। ফলে সিনেমা দেখার আগে পরে ভালই সময় কাটে

• যে কোনও পরিবারের পক্ষে, বিশেষ করে মহিলা বা ছোটদের জন্য তুলনায় নিরাপদ জায়গা। অসুবিধেয় পড়লে সিকিউরিটি গার্ড-এর সাহায্য মেলে

• ‘মালটিপ্লেক্স যাচ্ছি’ বলাটাই তো কেতার

নেগেটিভ পয়েন্ট

• পরিবেশ ভাল, কিন্তু তার জন্য কড়িও ফেলতে লাগে অনেকটাই বেশি

• পপ কর্ন, কোল্ড ড্রিংকের মতো জাঙ্ক ফুডের দাম কমপক্ষে ৬-৭ গুণ বেশি

• বাইরের খাবার ভেতরে নিতে মানা, এমনকী জলের বোতলও না

• উঠতি ছেলেছোকরাদের ফুর্তি করার জায়গা, ফলে বুঝেশুনে না চললে ‘চাপ’ আছে

• সব সময় আছে শপিং মল আর ফুড কোর্টের লোভনীয় হাতছানি। ফলে সতর্ক না হলেই পকেট সাফা কী ক্রেডিট কার্ডের লম্বা বিল পাক্কা

মিসিং লিঙ্ক

• সিঙ্গল স্ক্রিনের প্রত্যেকটা হলের আলাদা, আলাদা পরিবেশ। প্রত্যেকটির অঙ্গসজ্জা বা আকার অন্যটির থেকে ভিন্ন

• খরচপাতি অনেক অনেক কম

• এখানে সিনেমা দেখাটাই একমাত্র বিনোদন, অন্য কিছুর লোভনীয় ডাক নেই

• সিঙ্গল স্ক্রিনের সিনেমা হলটা শুধু নয়, তার আশেপাশে চিলতে বুকস্টল, আইসক্রিম কী ঝালমুড়িওয়ালা, সার দেওয়া জামাকাপড় বা ব্যাগের দোকান, ট্রামের ঘণ্টি, বাসের হর্ন সব মিলিয়ে যে ‘কলকাত্তাইয়া আমেজ’, সেটা মাল্টিপ্লেক্সে পাওয়া সম্ভব নয়

• পুরোপুরি মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির সঙ্গে যায়

এই ক’দিন আগের খবর, ‘মেট্রো’ ভেঙে নাকি মাল্টিপ্লেক্সের চেন হওয়ার কথা চলছে। বাইরের ফটকটা আধখোলা থাকে, টিমটিমে আলোয় নজরে আসে দু’ধারে তেঠেঙে কাঠের ফ্রেমে সিনেমার পোস্টার, আধঘুমন্ত দ্বাররক্ষী।

সেই মেট্রো, যার ভেতরে গেলে পা ডুবে যেত নরম কার্পেটে। এমন কী ফ্রন্ট স্টল থেকে সিটি পড়লেও গম্ভীর গলার ‘আশার’ এসে ধমক দিত।

চৌরঙ্গি বা ভবানীপুরের মতোই করুণ অবস্থা হাতিবাগানের সিনেমা পাড়ায়। ‘রূপবাণী’ ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে। সামনের অংশটা হেরিটেজ, তাই ভাঙা যায়নি। রুপোর কড়াই থেকে রুপোর কর্নিক দিয়ে সিমেন্ট তুলে প্রথম ইটটি গেঁথেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ‘রূপবাণী’ নামটিও তাঁর দেওয়া। নামকরণের জন্য সে আমলে নাকি এক হাজার টাকা সাম্মানিক দেওয়া হয়েছিল কবিকে। ফ্ল্যাটবাড়ির প্রমোটার সেই ঐতিহ্যের আলাদা দাম ধরেছিল কি?

হাতিবাগানের মোড়ে ‘রাধা’ সিনেমা এখন কাপড়ের বাজার। আর একটু এগিয়ে ‘শ্রী’-ও তাই। ‘উত্তরা’য় ফুড কোর্ট হয়েছে। টিকে আছে কেবল ডান হাতে ‘মিত্রা’ আর দর্পণা’, ফড়িয়াপুকুরে ‘টকি শো হাউস’, আর বাঁ হাতে ‘মিনার’।

এখনও একসঙ্গে বলা হয় ‘মিনার-বিজলি-ছবিঘর’। স্বর্গত হরিপ্রিয় পাল মশাই নিজের তিন কন্যার নামে পরিবারের তিনটি সিনেমা হলের নাম রেখেছিলেন। একই ডিস্ট্রিবিউশনের আওতায় থাকা সিনেমাহলেরাও একদা জুটি বাঁধত। ‘উত্তরা-পূরবী-উজ্জ্বলা’। তিনটি হলের মধ্যে কেবল ‘পূরবী’ টিকে আছে। অথবা ‘রাধা-পূর্ণ-প্রাচী’।

এখনও লড়ে চলা ‘প্রাচী’ এক দীর্ঘ সময় জুড়ে ছিল বাংলা ছবির, বাঙালিয়ানার শেষ দুর্গ। চলতি প্রথা মেনে ‘ব্যলকনি’ নয়, প্রাচীতে বিক্রি হত ‘অলিন্দ’র টিকিট। সিটের নম্বরও লেখা থাকত বাংলায় ‘গ-১৫, ঙ-২৬’। এবং বহু বছর প্রাচীতে বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষার ছবি দেখানো হত না।

বস্তুত প্রতিটা সিনেমা হলেরই একটা নিজস্ব চরিত্র ছিল। যেমন চৌরঙ্গির হারিয়ে যাওয়া টাইগার বা মেট্রো-র রবিবারের মর্নিং শোয়ের মতোই ছিল ফড়িয়াপুকুরের টকি শো হাউসের সকাল এগারোটার শো, যা বরাদ্দ থাকত একমাত্র হলিউডি ক্লাসিকের জন্য।

একটা সময়, উত্তরে এবং দক্ষিণেও সিনেমা হলগুলোর সামনে দিনভর আড্ডা চলত। দুপুরে বখাটে ছোঁড়াদের ঠেক থেকে বিকেলে পাড়ার বুড়োদের নস্টালজিয়া-চর্চা হয়ে আপিসফেরত বাবুদের সান্ধ্য গুলতানিতে শেষ। পাশেই ফুটপাথে ঢেলে বিক্রি হত চলতি সিনেমার গানের চটি বই, সহজ হারমোনিয়াম শিক্ষা, বাড়ির ছাদে বেগুন চাষ।

বন্ধ হলের কোলাপসিবল গেটে এখন ট্যারাব্যাঁকা হ্যাঙার থেকে পাশাপাশি ঝুলে থাকে ‘বাহা শাড়ি’ আর ‘সাসবহু’ সিরিয়ালের লেহেঙ্গা চোলি।

শেষ কবে কোন সিনেমার চুলের ছাঁট আর পোশাকের কাট ফ্যাশন হয়েছিল বলা শক্ত। যদিও সিনেমা হলকেন্দ্রিক আড্ডা কিছুটা হলেও যেন ফিরে এসেছিল নতুন করে তৈরি হওয়া স্টার থিয়েটারে। সামনের লবি থেকে স্টেজের একেবারে পিছনের দেওয়াল পর্যন্ত পুড়ে ঝামা হয়ে যাওয়া সেই স্টার থিয়েটার। আঠেরো থেকে আটষট্টি ফের আড্ডা দিতে শুরু করেছিল নতুন স্টারের খোলামেলা চত্বরে। রেস্তোরাঁগুলো গমগম করত। কিন্তু এখন সেখানেও ভাটার টান। হঠাত্‌ কী হল?

“পুরোনো কথা আলোচনা করে লাভ নেই”, বললেন নতুন স্টারের প্রথম পাঁচ বছরের দায়িত্বে থাকা, প্রিয়া সিনেমার অরিজিত্‌ দত্ত। “তার থেকে আসুন নতুন কথা বলি। প্রিয়া ভাল চলছে। অ্যাক্সিস মল বা রাজারহাটের মাল্টিপ্লেক্স গত বছর থেকে লাভ করছে। দুর্গাপুর সিটি সেন্টারের মাল্টিপ্লেক্সও মন্দ চলছে না। হলদিয়ায় নতুন মাল্টিপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে।”

যদিও বাস্তবটা খুব সহজ নয়। সমস্যা আছে বিস্তর। সিনেমা রিলিজ করার পর হলে না গিয়ে লোকে বসে থাকে, দু’দিন পরেই তো টিভিতে দেখিয়ে দেবে। অথবা ফুটপাথের ডালার পাইরেটেড ডিভিডি, ইন্টারনেটে ফ্রি ডাউনলোড। অনেক সময় তো সিনেমাহলে রিলিজের আগেই ডালায় বা নেটে চলে আসে। তা হলে? অরিজিত্‌ হাসেন। প্রিয়ার নীচে পাশাপাশি কয়েকটা খাবারের দোকান হয়েছে। মোমো থেকে মেক্সিকান র্যাপ। একটা রেস্তোরাঁ হয়েছে, আরও একটা বার তৈরি হবে বেসমেন্টে, আরও বেশি দর্শক টেনে আনতেই সব আয়োজন।

প্রিয়া সিনেমা শুধু কলকাতা নয়, গোটা ভারতে সিঙ্গল স্ক্রিনের সেরা ‘সাকসেস স্টোরি’। কিন্তু সব হলের সাফল্যের ভাগ এক নয়। “লোকে কেন হলে এসে সিনেমা দেখবে বলুন তো? আপনি নিজে শেষ কবে একটা সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছেন?” জানতে চাইলেন মিনার-বিজলি-ছবিঘরের সোমনাথ পাল। তাঁদের তিনটে হলই এখনও চলছে। এখনও নিয়ম করে রোজ হলে এসে বসেন সোমনাথবাবু। কিন্তু ব্যবসা কোথায়!

সোমনাথবাবুর বক্তব্য, “একটা সময় অঞ্জন চৌধুরী, স্বপন সাহাদের চটজলদি বাজিমাত করার কারণে, শর্ট-টার্ম লাভ হলেও বাংলা সিনেমায় একটা লং-টার্ম ধাক্কা এসেছে। ভদ্রলোক বাঙালি সেই যে সিনেমা হল থেকে মুখ ফেরালেন, আর তাঁদের ফেরানো গেল না। অথচ তপন সিংহ, তরুণ মজুমদাররা কী সব ছবি বানিয়েছেন! বাঙালি দর্শক সারা বছর বসে থাকত ওঁদের নতুন ছবির জন্য। তার পরেও তরুণ মজুমদার নিজের ছবির রিলিজের সময় বিজলি সিনেমার বুকিং কাউন্টারে এসে বসে থাকতেন। শো শেষ হওয়ার পর হলের গেটে দাঁড়িয়ে দর্শকের প্রতিক্রিয়া খেয়াল করতেন।”

“আর এখন সবাই সত্যজিত্‌ রায়! একটাও ‘পথের পাঁচালি’ তৈরি হচ্ছে না, সেটা অন্য কথা। কিন্তু গল্প থেকে আরম্ভ করে চিত্রনাট্য, নির্দেশনা, আবহ সঙ্গীত সবই এঁরা নিজেরা করতে চান। কিন্তু সে সব ছবি ব্যারাকপুরের গঙ্গা পার হয় না!” বললেন বহু বছর সিনেমার ডিস্ট্রিবিউশনের সঙ্গে যুক্ত সুভাষ দত্ত।

যদিও সত্যজিতের সিনেমাও যে সব সময় গ্রামে দর্শক পেত, তা নয়। বরং ‘বাবা তারকনাথ’, বা ‘সতী বেহুলা’ই বাম্পার হিট। কিন্তু তপন সিংহের ‘পলাতক’ বা তরুণ মজুমদারের ‘বালিকা বধূ’ এক দিকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছে, আবার গ্রামে-গঞ্জে চুটিয়ে ব্যবসাও করেছে। সুভাষ দত্তের আক্ষেপ, তেমন ছবি আর তৈরি হয় না। কিন্তু গ্রাম-শহরের পছন্দের ফারাকটা এখনও আছে। যে কারণে এ সব ছবি শহরে মোটামুটি ভাল ব্যবসা করেছে, ধরা যাক ‘ইচ্ছে’ বা ‘বেডরুম’, সেগুলো গ্রামে নিয়ে গিয়ে হিট করাতে পারেননি সুভাষবাবুরা। ফলে ওঁদের সংশয় বেড়েছে, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে দর্শক কী চান, সেটা হয়তো আজকের পরিচালকেরা তেমন বুঝতে পারেন না।

অবশ্য এটাও ঠিক যে আগে, এক দীর্ঘ সময়, সিনেমাই একমাত্র বিনোদন ছিল। এখনকার মতো টিভির প্রতিটা মুভি চ্যানেলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নাগাড়ে, গড়ে ৪০টা সিনেমা দেখা যেত না। তার মধ্যে বেশ কিছু আবার নতুন সিনেমা, হয়তো মাসখানেক আগেই রিলিজ হওয়া। ফলে লোকে এখন বসে থাকে। ভাবে, ধুর, পয়সা খরচ করে কী হবে! বাড়ি বসে নিখরচাতেই তো দেখতে পাব। এই স্যাটেলাইট-নির্ভর সিনেমা বিপণনই যে আসলে সিনেমা হলের সর্বনাশ করেছে, সে ব্যাপারে হল মালিক এবং ডিস্ট্রিবিউটররা সবাই একমত।

সেই পরিস্থিতিতে সিনেমার টিকিটের দাম হঠাত্‌ বাড়িয়ে দেওয়াটাও একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে করেন সিনেমার ডিস্ট্রিবিউশনে চুল পাকিয়ে ফেলা অরবিন্দ রায়। একটা সময় উত্‌পলেন্দু চক্রবর্তীর ‘চোখ’ বা গৌতম ঘোষের ‘পদ্মানদীর মাঝি’র মতো ‘ভাল সিনেমা’ লোককে দেখাবেন বলে ত্রিপুরা থেকে কেরল ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, সিনেমার টিকিটের দাম যে ৩৫ টাকার বেশি হবে না, সেই সিদ্ধান্ত বদলে সব থেকে কম দামের টিকিট যেদিন ৭০ টাকা হল, সেদিন থেকেই মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। অথচ ওঁরাই বাঁচিয়ে রাখতেন ছোট-বড় সিনেমাহলকে।

এখনও কিন্তু ওঁরাই ব্যবসা দেন। জিত্‌ বা দেবের ভক্তরা। রিলিজের দিন ব্যান্ডপার্টি এনে, নাচন-কোঁদন করে সে এক কাণ্ড বাঁধায় সবাই। মিনারের ছিমছাম, সাহেবি অফিস ঘরে বসে হাসতে হাসতে বলছিলেন সোমনাথ পাল। রিলিজের পর প্রথম দু’এক সপ্তাহ ওঁরাই কিন্তু পয়সা তুলে দেন। কিন্তু বছরের বাকি সময়টা ঢিমে তেতালায় চলে। তবু ডলবি সাউন্ড করতে হয়েছে, সিটগুলো আরেকটু আরামের করতে হয়েছে। কোনও শো-তে লোক কম হলেও এসি চালাতে হয়। কিন্তু হিট তামিল-তেলুগু ছবির ‘কার্বন কপি’ দিয়ে আর কত লোক টানা যাবে! ‘‘আপনি দেখছেন ‘সিংহম’ ছবিটা? একেবারে সিন টু সিন, দাঁড়ি, কমা, ফুলস্টপ সমেত কপি!” টিপ্পনী সোমনাথবাবুর।

“এদিকে মাল্টিপ্লেক্স সংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দিতে কত অভিনব উপায় বার করেছেন শহরতলির ছোট হলের মালিকরা, শুনলে অবাক হবেন,” বললেন সুভাষ দত্ত। মাল্টিপ্লেক্সের গোল্ড ক্লাসের ‘টুইন সিট’, অরবিন্দ রায়ের মতো পুরনো দিনের মানুষের কাছে যেটা ‘বিছানা-বালিশ-কম্বল’ দেওয়া সিট, তার নকলে চালু হয়েছে দু’পাশে প্লাইউডের পার্টিশান দেওয়া দু’জনের বক্স সিট। রীতিমতো বিরক্তি সুভাষ দত্তের গলায়। বললেন, “নাম করে বলে দিতে পারি। বারাসত, বসিরহাটের বা বাগনানের সে সব হলের কথা বাকি হল ফাঁকা থাকলেও বক্স সিট কিন্তু দেখবেন সব শো-তেই হাউস ফুল। বুঝতেই পারছেন, কী হয় সেখানে!”

মধ্যবিত্ত গেরস্থ বাঙালি কি এই সব কারণেও সিনেমা হলের থেকে দূরে সরে গেল? “আসলে সিনেমা দেখার চলটাই এখন আর নেই। আগে দুর্গাপুজোর চার দিন সিনেমা দেখার জন্য সকাল থেকে হলের বাইরে লাইন পড়ত। বাড়িতে বিয়ে বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান থাকলে সবাই দল বেঁধে সিনেমা দেখতে যেত। এখন আর দেখেন সে রকম কিছু?” প্রশ্ন করলেন অরবিন্দ রায়। “ঠিকই। আগে বাড়ির বিয়েতে মেয়েরা ‘বাসরজাগানি’, ‘শয্যাতুলুনি’র পয়সায় সিনেমা দেখতে যেতেন। এখন সবাই রেস্তোরাঁয় খেতে যান।” মন্তব্য সুভাষ রায়ের।

“আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু আলাদা।” বললেন অরিজিত্‌ দত্ত। তাঁর প্রিয়াতে এখনও নানা বয়সের মহিলা একা অথবা দল বেঁধে সিনেমা দেখতে আসেন। কলেজের ছেলেমেয়েদের ঝাঁক আসে, মাল্টিপ্লেক্স ছেড়ে। অরিজিত্‌কে খুব আত্মবিশ্বাসী শোনাল, “আসলে এটা স্রেফ আরেকটা ব্যবসা নয় যে সপ্তাহের শেষে কালেকশনের টাকাটা বাড়ি নিয়ে যাব। এটার মধ্যে থাকতে হবে সাত দিন, ২৪ ঘণ্টা। ছবি বানানোয় যেমন একটা প্যশন থাকে, লোককে ছবি দেখানোটাও তো তাই-ই।” সেই প্যাশনই বোধ হয় ঝিকিয়ে উঠল ৮২ বছর পার করে দেওয়া অরবিন্দ রায়ের চোখে। বললেন, “ভাবছি এই ‘চাঁদের পাহাড়’ সিনেমাটাকে নিয়ে বাইরের রাজ্যগুলোতে যাই। দেখি না, লোকে দেখে কিনা।”

ছায়া ছায়া ছবি

তার নিমাই তখন পাশের হলে

সমরেশ মজুমদার

একগাদা নারীর মধ্যে একটাই মাত্র পুরুষ নাম মিনার। বাকিরা রাধা, শ্রী, উত্তরা, দর্পণা। ওরা সব মিনারেরই আশে পাশে ছড়িয়ে।

শিয়ালদায় প্রাচী, পূরবী, অরুণা। সব মেয়েদের নামে। বাদ শুধু ছবিঘর। আর ফড়িয়াপুকুরের টকি শো হাউস। এ দুটো নাম না কোনও ছেলের, না মেয়ের।

দক্ষিণেও মেয়েদের ভিড়। কালিকা, বসুশ্রী, ইন্দিরা। ভবানীও তো মেয়ের নাম হয়। উত্তরের মিনারের মতো দক্ষিণে পূর্ণ একা ছেলের নামে।

কেন? সিনেমা হলের নামে এত মহিলা-আধিক্য কীসের জন্য? মহিলাদর্শককে আকর্ষণ করতে? জানি না। কিন্তু বহু কাল থেকে এমনটা লক্ষ করছি। উত্তর পাইনি।

একমাত্র ধর্মতলা চত্বরে এর চল নেই। মেট্রো, গ্লোব, টাইগার, লাইটহাউস, নিউ এম্পায়ার, এলিট, নিউ সিনেমা... সব ক’টাতেই সাহেব-সাহেব গন্ধ। একমাত্র জ্যোতি হংস মধ্যে বক যথা! আর একটু ভেতরে ঢুকলে যমুনা।

কলকাতায় এসে সিনেমা হলে আমার যাওয়ার শুরু ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময়। তখন অত পয়সা কই! যা থাকত, তাতে কালেভদ্রে বড়জোর সওয়া পাঁচ আনায় সামনের সারির টিকিট কাটা যেত। বত্রিশ পয়সা। থার্ড ক্লাস। কিন্তু মেট্রো-তে তাতে দিব্যি আরামই লাগত। পর্দা থেকে দূরত্বটা অন্য যে কোনও হলের চেয়ে বেশি। তবে ওই পয়সায় রাধা, শ্রী-র মতো হলে গেলে বসার চেয়ে দাঁড়াতে হত বেশি। এত ছারপোকা!

নাইট শো-য় সিনেমা দেখা মানেই প্রচুর পয়সা পাওয়া। একটা নাচের সিন এলেই খুচরো পয়সার হরির লুঠ। পিছনের সারি থেকে। সে-পয়সা বেশির ভাগই পর্দার নায়িকা পর্যন্ত পৌঁছত না। পড়ত আমাদের কোলে। নিচু হয়ে কোনও দিন কুড়োয়নি বটে, কিন্তু কোলে পড়লেও কি পকেটস্থ করিনি!

তবে থার্ড ক্লাসে সিনেমা দেখলে পরদিন কলেজে বলতাম না। প্রেস্টিজ!

এই সওয়া পাঁচ আনা কথাটা যে কে আমদানি করেছিলেন, কে জানে! দোকানদারকে এই দামে কোনও দিন কিছু বিক্রি করতে দেখিনি। তবে শীতলা মন্দির বা শিব ঠাকুরের কাছে মানত করে সওয়া পাঁচ আনার পুজো চড়াতেন কেউ কেউ। আর এ ছাড়া ওই থার্ড ক্লাসের টিকিট কাটতে দিতে হত সওয়া পাঁচ আনা। এই এক জায়গায় সিনেমা হল আর ভগবানের কী আশ্চর্য মিল!

থার্ড ক্লাসের আগে ছিল সেকেন্ড ক্লাস দশ আনা, মানে বাষট্টি পয়সা। ফার্স্ট ক্লাস পাঁচ সিকে। ১টাকা ২৫। এর পরের দাম ২টাকা ১০। ড্রেস সার্কেল। কলেজ-বেলায় ডিসি-তে সিনেমা দেখার প্রশ্নই ছিল না, পাঁচ সিকেতে সিনেমা দেখা মানেই বিশাল ব্যাপার।

তখন তো আর বান্ধবীকে নিয়ে সিনেমা দেখার সুযোগ ছিল না। কলেজ হস্টেলে এক-আধ ক্লাসের সিনিয়র মেয়ে যারা, তারা যে সব জুনিয়রকে অনায়াসে তুইতোকারি করত, তাদের কাউকে নিয়ে অনেক সময় সিনেমা দেখত। তখন ওই পাঁচ সিকে।

ও ভাবে আমিও কয়েকবার গিয়েছি। কিন্তু প্রতিবারই ভেবেছি, ওই ‘তুই’টা কখন ‘তুমি’-তে উঠবে। ভাবাটাই সার। সম্পর্কের ওঠা-নামা কিছুই হয়নি।

চল ছিল বেশি উত্তম-সুচিত্রা দেখার। ভবানীপুরের জলি সেলুনে উত্তম-ছাঁট দিয়ে মিনার-বিজলী-ছবিঘরের সামনে দাঁড়ানোটার মধ্যে একটা রোমাঞ্চ ছিল।

মনে আছে উত্তরা আর শ্রী ছিল পাশাপাশি। মাঝখানে একটা দরজা। উত্তর কলকাতার মেয়েরা তখন একা বা বান্ধবীর সঙ্গে সিনেমা দেখার স্বাধীনতা পায়নি। যেত মাসি বা মায়ের সঙ্গে, ম্যাটিনিতে। অথবা দজ্জাল কাজের মহিলাকে ‘এসকর্ট’ নিয়ে। সিনেমা দেখতে দেখতে একমাত্র বাথরুম যাওয়ার দরকার পড়লেই অভিভাবকদের কাছছাড়া হত তারা।

মেয়েটি যদি শ্রী-তে যেত, তার প্রেমিক তখন উত্তরা-র সিনেমা ত্যাগ করে বাইরে অপেক্ষমাণ। মাঝের দরজা পেরিয়ে মেয়েটি অভিসারে খুঁজে নিত তার প্রেমিককে। সে আর কতক্ষণ, তবু! ছবি শেষ হওয়ার আগেই ফিরে যেতে হত অভিভাবকের পাশের চেয়ারে।

এ সব ক্ষেত্রে অভিভাবকের সঙ্গে ‘নদের নিমাই’ ছবি দেখতেও আপত্তি করত না কেউ। কারণ তার নিমাই যে তখন পাশের হলেই আছে।

তামিল-অ্যাডাল্ট ছিল না বলে বেশি মার খাইনি

ব্রাত্য বসু

কোন হলে কবে প্রথম ঢুকেছি আজও মনে করতে পারি।

রাধা-য় যাই বাবার সঙ্গে। তখন আমি মাধ্যমিক দেব। ‘গোল্ডরাশ’ দেখেছিলাম। পূর্ণ-তে যাই স্কটিশ কলেজে ইলেভন-টুয়েলভ পড়ার সময়। নুন শো-য় বিধুবিনোদ চোপড়ার ‘খামোশ’। পরের শো-য় আবার। ‘কর্মা’। সুভাষ ঘাইয়ের। জ্যাকি শ্রফ-অনিল কপূর-নাসিরুদ্দিন। সে বার একাই। বা সঙ্গে কেউ থাকলেও মনে নেই। মিনারে প্রথম যাই যখন, তখন আমি প্রেসিডেন্সিতে পড়ছি। ‘ইজাজত’ দেখেছিলাম বন্ধুরা মিলে। বিজলি-তে প্রথম গেছি যখন আমার প্রথম ছবি ‘রাস্তা’র স্ক্রিনিং হচ্ছে। প্রাচীতে আজ অবধি যাওয়াই হয়নি।

কলেজে পড়তে হাতিবাগান পাড়ায় কমই গেছি। কলেজ স্ট্রিটের গ্রেসে ‘উত্‌সব’ দেখেছি। ‘বীণা’য় ‘সত্তে পে সত্তে’।

ফার্স্ট ইয়ার থেকে সিনে ক্লাবের মেম্বার। তখন দেখতাম সরলা মেমোরিয়াল ছাড়া গ্লোব, চ্যাপলিনে (নাকি তখনও মিনার্ভা)। বুন্যয়েলের রেট্রো দেখি ওই সময়ই। গোর্কি সদনে।

মিত্রা-য় মাঝে মধ্যে মর্নিং শো হত। সিনে ক্লাবের তেমনই একটা শো-এ বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘ফেরা’ দেখেছিলাম।

পপুলার বাংলা বা হিন্দি দেখার জন্য আমার বড় ঠেক ছিল শেলী, জয়া, চেতনা, অরো, মৃণালিনী, নরেন্দ্র। যেহেতু আমি কালিন্দীর বাসিন্দা।

যখন ক্লাস টেনে পড়ি, তখন ‘প্যানিক ইন ব্যাঙ্কক’ এল, এ-মার্কা। দেখেই কয়েকজন বন্ধু ঠিক করলাম নুন শো-য় দেখে, টিফিনের পর স্কুলে চলে আসব। করেও ছিলাম তাই। ক্লাসের একটা ছেলে দেখে ফেলেছিল। ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। তামিল-অ্যাডাল্ট ছিল না বলে বেশি মার খাইনি। প্রায় হাতে পায়ে পড়ে হেডস্যারকে ম্যানেজ করতে হয়েছিল, যাতে বাড়ি পর্যন্ত খবরটা না যায়।

তখন সিনেমার আগে অবধারিত একটা নিউজ রিল হজম করতে হত। ভারী গলার এক ভদ্রলোক টানা বলে যেতেন। এক এক সময় এক এক রকমের সব ডকুমেন্টারি। বিরক্ত লাগত। তবে একটা জিনিস খেয়াল করতাম, জয়া-শেলীতে সিনেমা দেখানোর আগে যে সব বিজ্ঞাপন দেখানো হত, গ্লোব-নিউ এম্পায়ার-এ কিন্তু তা নয়। একটু যেন এলিট গোছের।

তখন নিজেকেও কি এলিট মনে হত!

সিনেমা শেষ হলেই কবিরাজি

শতরূপা সান্যাল

প্রথম সিনেমা দেখাটা খুব মনে পড়ে। তখন আমরা বেলেঘাটায় থাকি। জলের বোতল, টিফিনবক্স নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে ছবিঘর। ‘গুপী গাইন বাঘা বায়েন’। খুব মজা পেয়েছিলাম। বিশেষ করে যখন সাদা-কালো থেকে ছবিটা হঠাত্‌ রঙিন হয়ে গেল।

তখন হলটা কী বড় লেগেছিল! ইয়া পেল্লাই। বিশাল স্ক্রিন। অথচ আমার প্রথম ছবি যখন ‘অণু’ রিলিজ করল, আবার যেতে হয়েছিল, তখন গিয়ে দেখি, ওমা! তত তো বড় নয়!

পুজোর সময় বন্ধুরা দল বেঁধে ঠাকুর দেখতে বেরোত। আমি কোনও দিনই ওই দলে থাকতাম না। কিছু না হোক, চলো একটা সিনেমা দেখে আসি। একবার মনে আছে, কলকাতা সেদিন ভাসছে। হাতিবাগানের ফুটপাথ টলটল করছে। আমি আর মা গিয়েছিলাম উত্তমকুমারের কী যেন একটা ছবি দেখতে। মিনারে।

তখন ইন্টারভ্যালে ট্রে-তে করে খাবার নিয়ে হলের ভেতর বিক্রি করতে আসত। পটেটো চিপস্‌, পপ কর্ন। কী যে স্বাদ ছিল সে সবের!

আমি যেহেতু বরাবর উত্তরের, আমার সিনেমা দেখার বড় ঘাঁটি ছিল হাতিবাগান। রাধা, রূপবাণী, মিত্রা, দর্পণা, শ্রী, উত্তরা।

তখন টকি শো হাউস-এ ইংরিজি ছবি খুব দেখানো হত। একটার কথা তো বেশ মনে আছে। ‘বেনহার’। আমরা বলতাম, ‘বেনহুর’। তখন কী একটা কারণে মা-বাবাকে ছেড়ে থাকতে হয়েছিল, পিসি তাই সান্ত্বনা পুরস্কার দিতে টকি শো হাউস নিয়ে গিয়েছিল। বোধহয় দেরিতে টিকিট কাটা হয়েছিল বলে পিছনের দিকের ভাল সিটগুলো পাওয়া যায়নি। বসেছিলাম বেশ খানিকটা সামনে। পর্দায় এক একটা চাবুক এসে পড়ছে যখন, মনে হচ্ছে গায়ের ওপর সপাং সপাং করে শব্দ হচ্ছে। রথের চাকা যাচ্ছে, যেন বুকের ওপর দিয়ে।

হাতিবাগানে সিনেমা দেখার আরেকটা বড় পর্ব হল, জমিয়ে খাওয়াদাওয়া। কাঁটা-চামচ দিয়ে শুরু করে, শেষে কব্জি না হোক পাঁচ আঙুল মাখামাখি করে ভুরিভোজ। পুর্বাণী, সুপ্তি, মিতালি, মালঞ্চর মতো কয়েকটা রেস্তোরাঁয়। কবিরাজি, মোগলাই পরোটা, কষা মাংস। মাংসর রেস্ত না থাকলে আলুর যে তরকারিটা দিত, তাতেই সাপটেসুপটে কী সুখ! কী সুখ!

হাতিবাগান পেরিয়ে যে সিনেমা দেখিনি তা নয়। বীণা-য় যেমন ‘বাবা তারকনাথ’ দেখেছিলাম। লাইটহাউস-এ হরর ফিল্ম ‘এক্সরসিস্ট’ দেখাটা আজও ভুলিনি। আমি আর আমার বন্ধু শর্মিলা। ছবি দেখব কী, ভয়ে প্রায় অর্ধেকটা সময় এ-ওকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম।

তখন সিনেমা দেখার আমার আরেকটা জায়গা ছিল গোর্কি সদন। ওখানেই আমার প্রথম ‘মৃগয়া’ দেখা। কুরোসয়া থেকে সত্যজিত্‌ রায়েরও বেশ কিছু ছবিও তাই।

এখনও যখন হাতিবাগান দিয়ে কোথাও যাই, ধাঁ করে কেমন যেন পুরনো ছবিটা ঘাই মেরে যায়।... একটা হাউস ফুল বোর্ড ঝুলছে। দেদার টিকিট ব্ল্যাক হচ্ছে। ফুটপাথ ছাপিয়ে ঝকঝকে ধোপদুরস্ত পোশাক, ধবধবে সাজগোজ করা লোকজনের ঢল। চকচকে চোখমুখ। একটু বাদেই একটা ‘সব পেয়েছির আসরে’ ঢুকবেন বলে ভিতরে ভিতরে উত্তেজনায় ফুটছেন তাঁরা।

এখন সেই হলগুলোর অনেক ক’টাই খসে গিয়েছে। যে গুলো বেঁচে আছে, তার সামনে ভিড়টা দেখি, কিন্তু সেই সব সাদামাঠা, তকতকে মুখগুলো কোথাও আর চোখে পড়ে না তো! ভিড়ের মধ্যে সেই মুখগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল!

অনুলিখন: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE