Advertisement
E-Paper

জিনাতের নাম শুনলেই পরভিন আড়ষ্ট হয়ে যেত

বললেন পরভিন ববির একদা প্রেমিক মহেশ ভট্ট। সারা জীবন জিনাতকে এড়িয়ে চললেও পড়ন্তবেলায় তাঁকে নিয়ে ফিল্ম করার কথা ভাবছেন তিনি। শুনলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্তএক জনকে আমি ভালবেসেছিলাম। অন্য জন আমার ভালবাসার অনুপ্রেরণা। মিডিয়ার ভাষায় অবশ্য ওরা ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী! প্রথম জন পারভিন ববি। দ্বিতীয় মানুষটি জিনাত আমন। ওরা একসঙ্গে কাজ করেছে চারটে ছবিতে। ‘আমির আদমি গরিব আদমি’, ‘মহান’, ‘অশান্তি’, ‘আবদুল্লা’। তবু সে-সময়কার মিডিয়াতে পরভিন আর জিনাতকে নিয়ে কত কী না লেখা হত! তাই জিনাতের কথা বলতে বসে পরভিন-জিনাত সম্পর্ক নিয়ে একটুআধটু না বললেই নয়।

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
সত্যম শিবম সুন্দরম

সত্যম শিবম সুন্দরম

এক জনকে আমি ভালবেসেছিলাম।

অন্য জন আমার ভালবাসার অনুপ্রেরণা।

মিডিয়ার ভাষায় অবশ্য ওরা ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী!

প্রথম জন পারভিন ববি। দ্বিতীয় মানুষটি জিনাত আমন। ওরা একসঙ্গে কাজ করেছে চারটে ছবিতে। ‘আমির আদমি গরিব আদমি’, ‘মহান’, ‘অশান্তি’, ‘আবদুল্লা’। তবু সে-সময়কার মিডিয়াতে পরভিন আর জিনাতকে নিয়ে কত কী না লেখা হত!

তাই জিনাতের কথা বলতে বসে পরভিন-জিনাত সম্পর্ক নিয়ে একটুআধটু না বললেই নয়।

পরভিন নাকি জিনাতের মতো দেখতে। অ্যাটিটিউডেও দু’জনের মিল। কত বার পড়েছি, ‘পরভিন ইজ্ পুওর ম্যানস্ জিনাত আমন।’ ও নাকি গরিবের জিনাত আমন!

পরভিন আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল। তাই ওর মনের গভীরে যে অনুভূতিগুলো দানা বাঁধত, আমি তার হদিশ পেতাম। অন্যের কাছে লুকোতে পারলেও ও আমার কাছে কিছুই লুকোত না। এমনকী আমি আগেভাগেও টের পেয়ে যেতাম ও জিনাতকে নিয়ে ঠিক কী ভাবছে।

একবার মনে আছে, পরভিন আর জিনাতের একটা হোটেলে দেখা। এরকম সময়ে ওপর-ওপর দেখে ওদের মনে হত দু’জনের কী ভাব, কী ভাব! জিনাতের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলেই চলেছে পরভিন। সে দিনও কিন্তু আমি দেখেই বুঝেছিলাম কতটা চেষ্টা করে পরভিন অমন ব্যবহারটা করছে।

পরে আমি পরভিনকে ডেকে সে কথা বলেওছিলাম, “তুমি কিন্তু আমার কাছে ধরা পড়ে গেছ। কত কষ্ট করে যে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলে, দেখেই বুঝেছি।”

শুনে প্রথমে ও থতমত খেয়ে গিয়েছিল। আসলে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এরকম ভাবে ওকে কেউ কিছু বলার হিম্মত দেখাত না। একটু সামলে পরভিন বলেছিল, আমি নাকি পাক্কা শয়তানের মতো কথা বলছি। তবে কিছুক্ষণ স্বীকার করেছিল, আমি সত্যিটা ধরে ফেলেছিলাম।

আসলে পরভিন সবসময় জিনাত হতে চেয়েছিল। আর ও মনে মনে জানত যে সেটা হয়ে ওঠা কতটা কঠিন কাজ।

গুজরাটের জুনাগড়ের বাসিন্দা ছিল পরভিন। একমাথা তেল লাগিয়ে রাখত। ও জানত যে বলিউডে ‘দিভা’ ব্যাপারটা অনেকটাই একটা তৈরি করা ইমেজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।

কেরিয়ারের প্রথম দিকে পরভিন তেমন কোনও দারুণ চরিত্রে কাজ করেনি, যা দেখে ওকে নিয়ে হইহই করা যেত! তখনকার সময় ওর একমাত্র বড় অ্যাচিভমেন্ট ছিল টাইম ম্যাগাজিনের কভারে থাকা।

এ দিকে তত দিনে মিডিয়ার চোখের মণি হয়ে গেছে জিনাত। ‘কুরবানি’, ‘সত্যম শিবম্ সুন্দরম’-এর মতো ছবি তৈরি হচ্ছে জিনাতকে মাথায় রেখে। পরিচালকরা ওকে নিয়ে চরিত্র লেখার কথা ভাবছেন। কিন্তু সে তুলনায় পরভিন কোথায়! চোখে পড়ার মতো কাজ বলতে, ‘দিওয়ার’-এর ক্যামিও রোলটা।

মনে আছে, পরভিনের সামনে জিনাতের নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করলে ও জড়োসড়ো হয়ে যেত। ওর এই আড়ষ্টতা দেখে আমি বুঝতে পারতাম কতটা ইনসিকিওরিটিতে ভুগছে।

তবে আমার কিন্তু মনে হয়, কেরিয়ারের শেষ দিকে পরভিন জিনাতকে টপকে গিয়েছিল। ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’, ‘শান’-এর মতো ছবিগুলোর কথা ভাবুন। পরভিন তখন একদম শীর্ষে।

ভাগ্যের এমনই পরিহাস, যে পরভিন যখন কেরিয়ারের একেবারে চূড়ায়, তখনই কঠিন রোগে আক্রান্ত হল। এর পরই ভেতর থেকে ভাঙতে শুরু করে পরভিন। শুরু হয় ওর জীবনের ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডি। এমন এক ট্র্যাজেডি, যার কারণেও আবার হিন্দি ফিল্মের ইতিহাসের পাতাতে পরভিনের নাম থেকে যাবে।

ব্যক্তিগত জীবনে অবশ্য জিনাতকে নিয়ে পরভিনের কোনও সমস্যা ছিল না। যখন অসুস্থ ছিল তখন কত মানুষকে নিয়ে ও কত কী কথা বলত। যার অনেকটাই ছিল ওর কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু কোনও দিন জিনাতের নাম নিয়ে কোনও কথা বলতে শুনিনি।

আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল ওর মধ্যে। কেরিয়ার নিয়ে যে মানুষ চিরকাল আশঙ্কায় ভুগেছে, জিনাতের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে গেছে, সেই একই মানুষ কিন্তু ব্যক্তি-জিনাতকে ভয় পেত না।

পরভিন ববি ও জিনাত আমন

এমনকী সেটা আমার বেলাতেও না। আমাদের মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও, জিনাতের সঙ্গে আমার মেলামেশাতে ওর কোনও ভ্রুক্ষেপ দেখতাম না। জিনাতের বেলায় অন্তত বয়ফ্রেন্ড হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার মতো কোনও ভয়ভাবনা ওর ছিল না। যে কোনও প্রেমিকার মতো পরভিন সাঙ্ঘাতিক পজেসিভ ছিল, তা সত্ত্বেও। ওর যত ইনসিকিওরিটি বা ঈর্ষা ছিল, আমার প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে। আমি তখন বিবাহিত।

মনে আছে একবার পরভিন বলেছিল, “জানো মহেশ, আই লুক আপ টু জিনাত। সত্যি কথা হল, আই অ্যাম স্ট্রাগলিং টু গেট টু দ্য টপ।” নায়িকারা কিন্তু সচরাচর এ ভাবে কথা বলে না। পরভিন বলত। কারণ ও যে বরাবরই অন্য রকম।

অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন আমি কেন জিনাতকে নিয়ে কাজ করিনি কোনও দিন।

সেটা করব কেন? কোনও দিন আমি জিনাত আমনের ফ্যান ছিলাম না। ও যে ধরনের ছবি করত, সে ধরনের ছবি সেসময় বানাতাম না। তখন আমার লক্ষ্য একেবারে আলাদা। ‘অর্থ’, ‘সারাংশ’-এর মতো সিনেমা তৈরি করছি। সেখানে জিনাতের মতো নায়িকাকে কাস্ট করব কী করে?

আরও একটা ব্যাপার ছিল। স্বীকার করতে বাধা নেই যে জিনাত যখন সাফল্যের চূড়ায়, আমি তখন যাকে বলে স্ট্রাগলিং পরিচালক। আমার নাম লোকে জানত ঠিকই, কিন্তু আমার পরিচয়টা ছিল পরভিন ববির ‘বয়ফ্রেন্ড’। ‘গ্যারান্টিড অ্যামেচার’ বলেই আমাকে সবাই তখন চিনত।

একবার পুণেতে গিয়েছিলাম। রজনীশ-এর আশ্রমে যাব। পরভিনের সঙ্গে তখনও আমার সম্পর্ক রয়েছে। হোটেল ব্লু ডায়মন্ড-এর লিফ্টে জিনাতের সঙ্গে দেখা। আমি তো জিনাতকে চিনতাম। জিনাতও আমার নামটা জানত। কিন্তু আমি তখনও গুরুত্বপূর্ণ তেমন কোনও কাজ করিনি। অথচ জিনাত আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। ওর সঙ্গে সেটাই আমার প্রথম দেখা। অসম্ভব ভদ্র লেগেছিল ওকে। কিন্তু ওকে নিয়ে ছবি করা? না, সত্যিই ভাবিনি।

জিনাত তখন রাজকপূরের সঙ্গে কাজ করছে। আমি কী এমন ওকে অফার করব আমার ছবিতে? পরে জিনাত যখন মজহর খানের সঙ্গে প্রেম করছে, তখনও ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে। আবার কংগ্রেসের জন্য বেনারসে প্রচার করতে গিয়েও কথা হয় ওর সঙ্গে।

সব সময় ওকে দেখে আমার একটাই কথা মনে হত— খুব আন্তরিক একজন মানুষ।

মনে আছে, বিপাশা বসুকে নিয়ে যখন ‘জিসম’-এ কাজ করছি, তখন অনেকেই বলেছিলেন, এই তো ইন্ডাস্ট্রিতে আরেকটা জিনাত আমন এসেছে। তবে আমি ব্যাপারটা ও ভাবে ব্যাখ্যা করতে চাই না। একটা সময় ছিল, যখন হিন্দি ছবির নায়িকাদের মধ্যে দু’ধরনের মডেল দেখতে পাওয়া যেত। একটা পাশ্চাত্য মডেল। সেখানে অনায়াসে রাখা যেত পরভিন, জিনাত, বিপাশাদের। আর একটা ভারতীয় মডেল। যেখানে রাখা যেত হেমামালিনীর মতো অভিনেত্রীদের।

এখনকার দিনের নায়িকাদের মধ্যে কিন্তু এই বিভাজনটা আর দেখা যায় না। আমার মেয়ে আলিয়া কি কোনও দিন জিনাতকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে এগিয়েছে? মনে হয় না। ওদের চিন্তাধারাটাই আলাদা। আলাদা-আলাদা ভাগ করে দেওয়া মডেলের ভাবনাটাই ওদের মধ্যে নেই। তবে শুনেছি, আলিয়ার কাজ জিনাতের ভাল লাগে।

টপ ফর্মের জিনাতকে কাস্ট করতে হলে আমি ‘জিসম্’-এর জন্য করতাম। আর আজ যদি এখনকার বয়েসের জিনাতকে নিয়ে কাজ করার কথা ওঠে, তখন কী ছবি করতে চাইতাম? এমনিতে বলিউডে চল্লিশোর্ধ্ব নায়িকাদের নিয়ে কাজ করতে গেলেই জ্বর আসে। লোকজনের এমন হাবভাব যে দেখে মনে হয় যে বয়েস বাড়া মানেই বুঝি একটা রোগ ধরা পড়েছে। চারদিকে দেখেন না, বোটক্স-এর কী রমরমা! গোটা ব্যাপারটাই ওই কারণে। সব্বাই নিজেদের যৌবন ধরে রাখতে চান।

জিনাত যে ধরনের নায়িকা ছিল তাতে ওকে টিপিক্যাল অভিনেত্রীর ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না। জিনাত হল স্টার। তারকা। ও শাবানা আজমির মতো নয় যে বয়েস হলেও অভিনয় করে মাতিয়ে দেবে।

এখন তো সেই ‘দম মারো দম’-মার্কা হিরোইনের চরিত্রে ভাবা যাবে না ওকে। আর সত্যি বলতে কী, এখন বেশির ভাগ মানুষের ইতিহাসের সেন্সটা খুব কাঁচা। গতকালকের খবরের কাগজের হেড লাইনটাই মনে রাখতে পারে না। পুরনো দিনের জৌলুস বা সৌন্দর্যসর্বস্ব নায়িকাদের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হতে দেখি না। তাই এখন জিনাতকে মুখ্য চরিত্রে কাস্ট করে হিন্দি ছবি করার স্বপ্ন দেখাটাও প্রায় নেই বললেই চলে।

তবে কেউ যদি এমন একটা চরিত্র ভাবতে পারে যেখানে জিনাতের ব্যক্তিত্বটা মানিয়ে যায়, তা হলে অবশ্য অন্য কথা।

এ বার দুর্গাপুজোর সময় কলকাতাতে গিয়ে আমার একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল। মেয়েটি আমাকে একটা কনসেপ্ট পাঠিয়েছে। আপাতত সেটা আমরা ডেভলপ্ করছি। এক অল্পবয়েসি ছেলের সঙ্গে পুরনো দিনের এক নায়িকার সম্পর্কের গল্প।

ছেলেটি কলকাতা থেকে মুম্বইতে আসে। ওর একজন গার্লফ্রেন্ড আছে। মুম্বইতে এসে ওর দেখা হয় ওই নায়িকার সঙ্গে। যিনি এখন প্রায় অন্তরালেই চলে গিয়েছেন। অথচ একসময়ের দাপুটে অভিনেত্রী। গল্পের মধ্যে পঞ্চাশের দশকে বিলি ওয়াইল্ডারের তৈরি ‘সানসেট বুলেভার্ড’-এর ছোঁওয়া খুঁজে পাওয়া যেতেই পারে। তবে তার সঙ্গে কনটেম্পরারি ট্যুইস্টও থাকবে।

চিত্রনাট্য যদি জমিয়ে লেখা যায়, আর নায়িকার চরিত্রটা যদি ভালভাবে দাঁড়িয়ে যায়, তা হলে আমি এই রোলটা জিনাতকে অফার করতে চাইব।

জিনাত তো নিজের অভিনেত্রী সত্তাটাকে সে ভাবে কোনও দিন চ্যালেঞ্জ করেনি। একমাত্র ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ছাড়া। দেখি, যদি এই কাজটা হয় তা হলে জিনাতকে বলব, চলো একবার কাজ করেই দেখা যাক।

patrika anandabazar parveen babi mahesh bhatt zeenat aman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy