Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
শনিবারের নিবন্ধ ১

তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে...

মৃত্যুশোক আমার-আপনার জীবনে আছে। তাতে নিথর না হয়ে ঘুরে দাঁড়াবেন কী করে? উত্তর খুঁজলেন শ্রীজাত।মৃত্যুশোক আমার-আপনার জীবনে আছে। তাতে নিথর না হয়ে ঘুরে দাঁড়াবেন কী করে? উত্তর খুঁজলেন শ্রীজাত।

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৪ ১৩:৩৭
Share: Save:

‘লাজিম থা কে দেখো মেরা রস্তা কোই দিন অওর
তনহা গয়ে কিঁউ? অব রহো তনহা কোই দিন অওর।’

হয়তো এক সন্ধেবেলা, নিজের ছোট হাভেলির দাওয়ায় বসে কুপি জ্বেলে এই গজলের প্রথম শেরটি লিখছেন তিনি।

বাইরে পুরানি দিল্লির চেনা শোরগোল আর বাজারের টিমটিমে রোশনাই, বাইরে আস্ত একটা পৃথিবী। ভেতরে একটা নিভে-আসা-দুনিয়া গুছিয়ে বসেছেন বৃদ্ধ শায়র।

লিখছেন, ‘তোমার উচিত ছিল আরও কিছু দিন আমার জন্য অপেক্ষা করা/একা চলে গেলে কেন?এখন থাকো আরও কিছু দিন একা।’

দুপুরেই যেতে হয়েছিল কবরখানায়। সে আর নতুন কী। কিন্তু এবারের যাওয়ার সঙ্গে আগের বারের যাওয়াগুলোর বেশ বড় একটা তফাত রয়েছে।

এর আগে প্রতিবারই কবরখানা থেকে ফেরার পথে ভেঙে যাওয়া মনের কোণে একটু হলেও উম্মিদ-এর রওশনি ছিল। এবার সেটুকুও নেই। কিন্তু সেই অন্ধকারে নিজের সবটুকু ঢেলে দিয়ে ফুরিয়ে যাচ্ছেন না কবি।

মৃত্যুর ধারাবাহিক আক্রমণের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে লিখছেন, হ্যাঁ, আরও একটি গজল। যা তাঁর সারা জীবনের একমাত্র কাজ, কিন্তু কেন লিখছেন এ শের? সে কথায় পরে আসব। আপাতত জেনে নিই বৃদ্ধ এই শায়রের পরিচয়। তিনি আর কেউ নন, খোদ অসদউল্লা খান বেগ। আমরা যাঁকে চিনি মির্জা গালিব নামে।

এমন অনেককেই কিন্তু আমরা চিনি, যাঁরা নিকটজনের মৃত্যুর সঙ্গে, মৃত্যুশোকের সঙ্গে প্রাণপণ লড়ে গিয়েছেন সারা জীবন। হার মানেননি কিছুতেই। কাছের মানুষকে হারানোর যন্ত্রণা শামিল করে নিয়েছেন এগিয়ে যাওয়ার রাস্তায়।

শুধু তাই নয়, এক বা একের বেশি মৃত্যু পার করেও মেতে থেকেছেন কাজে। আবার এমন অনেককেই নিশ্চয়ই চিনি না, যাঁরা মির্জার মতোই এই লড়াইয়ে সফল।

চিনি না, কারণ তাঁরা পরিচিত হয়ে ওঠার মতো কোনও কাজের সঙ্গে জড়িয়ে নেই। কিন্তু মৃত্যুর সামনে কেই বা বিখ্যাত। শোকের ঘরে কোনও সেলেব্রিটি কোটা নেই।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে জীবন আর মৃত্যুর ঠিক মাঝামাঝি, বয়ে চলেছে শোকের শান্ত নদী। তাকে এড়িয়ে এগোনোর পথ আজও মানুষ খুঁজে পায়নি।

ধরা যাক সেই মেয়েটির কথাই, ছোটবেলা থেকে গান গাওয়াই যার স্বপ্ন ছিল আর যার সব চাইতে ভাল বন্ধু ছিলেন তার মা। সে ভাবত, মা যদ্দিন আছেন, তদ্দিনই। তারপর সংসারে তার আর কোনও বন্ধন থাকবে না।

সেই মা যখন চলে গেলেন, শোক নিশ্চয়ই এসেছে, কিন্তু ভেঙে পড়েনি মেয়েটি। কারণ মায়ের শারীরিক উপস্থিতির বাইরেও মাকে অনুভব করার মতো পরিণতি সে অর্জন করেছে তত দিনে, আর তা অর্জন করেছে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দিয়েই। কিন্তু শোক আরও বড় একটা ধাক্কা নিয়ে অপেক্ষা করছিল তার জন্য।

একদিন চরম হতাশাগ্রস্ত বাবা বেছে নিলেন আত্মহত্যার পথ। আর সে যাওয়াও, মেয়েটির ভাষায়, ছিল ‘বীভৎস’।

এই ঘটনার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে মেয়েটিকে লড়তে হয়েছে অনেক দিন। হয়তো আজও ভেতরে ভেতরে সে যুদ্ধটা চালিয়ে যাচ্ছে, শোকের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে। যুদ্ধটায় সে হারেনি, কারণ তার অস্ত্র গান। নিজের গান। আর মেয়েটিকে এখন আমরা চিনি। তার নাম লোপা। লোপামুদ্রা মিত্র।

অভিভাবককে হারানোর প্রস্তুতি মনে মনে থাকে মানুষের। কিন্তু তারও একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। সেই সময়ের আগেই শোক এসে দরজায় কড়া নাড়লে নিজেকে সামলানো কঠিন বইকী।

‘ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে তার তীব্রতা ততটা টের পাওয়া যায় না। আজ যখন সেই দিনগুলোর দিকে তাকাই, অবাক লাগে। ভাবি, কী করে পেরিয়ে এলাম অত কষ্টের একটা সময়?’ বাবা সতীনাথ চট্টোপাধ্যায়ের অকাল মৃত্যু প্রসঙ্গে বলছেন পরমব্রত।

‘বাবা চলে যাওয়ার পর, খুব ছোট বয়সেই কাজ করতে শুরু করেছিলাম আমি। সৌভাগ্যবশত, কাজ পেয়েওছি প্রচুর। ব্যস্ততায় নিজেকে ভরিয়ে রেখেছি। আজও তাই। তবে এখনও যখন বাবার বন্ধু বা সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা হয়, কথায় কথায় বাবার প্রসঙ্গ ওঠে, তখন একটাই আপশোস হয়। আমার এখনকার কাজগুলো বাবাকে দেখাতে পারলাম না।’ আক্ষেপের সুরেই বললেন পরম। কিন্তু সেইসঙ্গে একটু আত্মবিশ্বাসও কি ছিল না? শোককে রুমালের মতো লুকিয়ে রেখে একের পর এক সিঁড়ি ভাঙার আত্মবিশ্বাস? হয়তো ছিল। আর সেই আত্মবিশ্বাসটাই চাবিকাঠি, অন্তত এই খেলায়।

১৪ বছর একসঙ্গে থাকার পর বিবাহ-বিচ্ছেদকেই বেছে নিয়েছিলেন সেবন্তী। সে সিদ্ধান্ত মেনেও নিয়েছিলেন স্পর্ধা আর সাহসের কবি জয়দেব বসু। কিন্তু মাঝে সাঁকো হয়ে থেকে গিয়েছিল ছোট্ট ছেলে জুরা। তাই মাসে বার দু’য়েক দেখাসাক্ষাৎ বা কখনও বেড়াতে যাওয়া, এ সব ছিলই।

সম্পর্কটা হয়তো আগের মতো ছিল না আর। তবু সকলকে চমকে দিয়ে এক ভোরবেলায় যখন মৃত্যু হল জয়দেব বসুর, ভেঙে পড়েছিলেন সেবন্তী।

আজ যখন মনে পড়ে, ভাল থাকার স্মৃতিগুলোই বেশি উজ্জ্বল হয়ে ফিরে ফিরে আসে। তবু আজও জয়দেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মুখোমুখি হতে অস্বস্তি হয় তাঁর। অনেকগুলো অসম্পূর্ণতা জুড়ে জুড়ে জুরার জন্য একটা অদৃশ্য সোয়েটার আজ বুনতে হচ্ছে তাকে। তবু তিনি হাল ছাড়েননি। কেন? ‘প্রত্যেক মানুষেরই নিজেকে প্রমাণ করার একটা তাগিদ থাকে। আমার ক্ষেত্রে সেটা কবিতা লেখা। তাই বেঁচে আছি। আর জুরাও অবশ্যই বড় একটা কারণ।’ জোর গলায় জানালেন সেবন্তী।

মনে পড়ে ১৮ বছরের তরতাজা ছেলে বিবেকের আকস্মিক মৃত্যুর পর গান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন চিত্রা। আর সেই গানেই আরও বেশি করে ডুব দিয়েছিলেন জগজিৎ সিংহ। ঠিক যেভাবে এই এত বয়সেও, মেয়ে বর্ষার আত্মহত্যা পার করে গান নিয়েই বেঁচে রয়েছেন কিংবদন্তি আশা ভোঁসলে।

আত্মবিশ্বাসের অনেকগুলো চেহারা। যে যেমন ভাবে আঁকে। ধরা যাক একটি ছেলের কথা, কয়েক বছরের ছোট বোনই ছিল যার আদরের রাজধানী। তাকে আমি খুব কাছ থেকে চিনতাম। সেই আদরের বোন বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে শ্বশুরবাড়িতেই ঝুলে পড়ল সিলিং থেকে।

কোনও কারণ জানা গেল না, উত্তর মিলল না। ছেলেটির প্রয়োন্মাদ অবস্থা। কাজকর্ম তো দূর, নাওয়াখাওয়ারও তাল নেই। কিন্তু তাকেও তো বাঁচতে হত। বাবার জন্য, স্ত্রীর জন্য, নিজের ছোট্ট একটা মেয়ের জন্য।

আমি দেখতাম, ঝিলের ধারে একতলা বাড়ির জানলাগুলো খুলে দিয়ে সারা দিন সে বাজিয়ে চলেছে সেতার। এক রাগ থেকে আরেক রাগে পাল্টে যাচ্ছে তার কষ্টের রং। দাগ তো যাবার নয়, কিন্তু জখমটা সে সারিয়ে তুলতে পেরেছিল একটা সেতারকে আঁকড়ে ধরে।

আমি নিজেও কি কখনও এই যুদ্ধে নামিনি? অনেকগুলোর মধ্যে একটা লড়াইয়ের কথাই বলি কেবল। সে ছিল আমার ছোটবেলার বন্ধু।

স্কুল থেকে বাড়ি হয়ে কলেজ জীবন, আমরা হাত ছাড়িনি। থিয়েটার ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। নাটকের নির্দেশনা দেওয়া আর অভিনয় করার স্বপ্নে তার টানা চোখদু’টো সারাক্ষণ মশগুল থাকত। প্রায় রোজ সন্ধের আড্ডাতেই থিয়েটার পাড়ার অন্দরমহলের গালগল্পে মেতে উঠত, আমরা নির্ভেজাল শ্রোতা।

আমাকে রোজ তাগাদা দিত নাটক লেখার, কোনও দিন গা করিনি। খুব যে বিশেষ বড় মঞ্চে কাজ করার সুযোগ করে উঠতে পারছিল সে, এমনটা নয়, কিন্তু নিজেকে নিয়ে তার প্রত্যাশা ছিল বহু দূর।

একদিন মাঝরাতে তার জ্ঞানহীন রক্তাক্ত শরীর পড়ে রইল রেল লাইনের ধারে, কী হয়েছে, জানা গেল না। পর দিন সকাল থেকে টানা দশ দিন চলল চিকিৎসা। হাসপাতালের করিডরেই রি-ইউনিয়ন হল স্কুলের। রক্ত, ওষুধ, টাকা জোগাড়েই কেটে গেল কয়েকটা দিন। কিন্তু ও আর ফিরল না। তখন আমাদের বয়সটাও কাঁচা। আঘাত সামলাতে অনেকগুলো দিন গেল। কিন্তু যেটা হল, আমি আর থিয়েটার দেখতে যেতে পারতাম না। ওর স্বপ্নে ভিজে থাকা চোখদু’টো মনে পড়ে যেত বড্ড। ভেবেই নিয়েছিলাম, এমনকী দর্শক হিসেবেও থিয়েটারের সঙ্গে কোনও সংস্রব রাখব না। পালাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন বুঝি, না পালিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোটাই একমাত্র উপায়।

অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে তারপর। এই সেদিন, আমারই লেখা নাটকের অভিনয় যখন হয়ে গেল খোদ অ্যাকাডেমির মঞ্চে, খুব মিস করছিলাম ওকে। বার বার মনে হচ্ছিল, থাকলে কত খুশিই না হত। শোক হয়তো আর নেই। কিন্তু জানি, আমি ওকে মিস করব সারা জীবন।

ফিরে যাই গালিবের হাভেলিতে। কত দীর্ঘ একটা জীবন পার করে এলেন তিনি। তাঁর আর উমরাও বেগম-এর এত দিনকার দাম্পত্যে বেশ কয়েক বার সন্তানসুখ লাভ করেছেন দু’জনেই। কিন্তু হয়তো কয়েক ঘণ্টার জন্য। কোনও ক্ষেত্রে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক দিনে। কিন্তু কিছুতেই ‘আব্বু’ ডাক শোনার সুযোগ ঘটেনি মির্জার। একের পর এক মৃত্যুকে জন্ম দিতে দিতে উমরাও আজ পাথরে পরিণত।

হাল ছেড়ে ভাইপো আরিফকে দত্তক নিলেন মির্জা। সেরার সেরা শায়র তাঁর সমস্ত ব্যর্থতার উল্টো দিকে এনে বসালেন ছোট্ট আরিফকে। সেই আরিফ যখন ১৬ বছর বয়সে মারা যাচ্ছে, তখন উন্মাদ না হয়ে গিয়ে, ভাঙচুর বা আত্মহত্যা না করে একজন মানুষ কী করছেন? যা তিনি সারা জীবন ধরে করে এসেছেন লেখা। ‘লাজিম থা কে দেখো মেরা রাস্তা...।’

ভেতরের সমস্তটা ভাঙচুর করে ফেলা ঢেউয়ের উথাল-পাথালের সামান্যই উঠে এল তাঁর কলমে। বদলে তৈরি হল বাবা-ছেলের এক দৈনন্দিন কথোপকথন। দেরি করে বাড়ি ফিরলে বাবা যেমন ছেলেকে বকুনি দেন, ঠিক তেমনই আদরের, অভিমানের বকুনি দিচ্ছেন বাবা। দেরি করে ফেরার জন্য নয়। তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার জন্য। এখানেই, আরও একবার, মৃত্যুকে, মৃত্যুশোককে হেলায় হারিয়ে দিচ্ছেন মির্জা।

এইখানে আরেক জনের প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। মনে করা যাক, পুরানি দিল্লির টিমটিমে রোশনাইয়ের সেই সন্ধে থেকে আরও বেশ কয়েক দশক দূরের এক রাত। অন্ধকার চিরে ঝমঝমিয়ে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। কামরায় বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছেন আরেক কবি।

গালিবের সঙ্গে তাঁর চেহারা বা পোশাকে কিছুটা মিল থাকলেও থাকতে পারে। আলখাল্লায়, টুপিতে, সাদা চুল আর দাঁড়ি গোঁফে। কিন্তু আরও বড় মিলটি আঁকা হয়েছে সেই দিনই। পুত্রশোক। এবং গালিবের মতোই, সন্তানশোক তাঁর কাছে নতুন কিছুই নয়। তবু কোনও কোনও সন্তান তো একটু হলেও বেশি আদরের, বেশি কাছের হয়। তেমনই একজন চলে গিয়েছে আজ। ট্রেনের জানলার বাইরে রাতের আকাশ তখন পরিষ্কার।

দেখতে দেখতে কবির মনে হল, তাঁর আরও এক সন্তান যে চলে গেল আজ, কই, রাতের আকাশে কোথাও তো কিছু এতটুকু কম পড়েনি।

ব্যক্তিগত শোকের পাহাড়প্রমাণ স্রোত ঠেলে বৃহত্তর বোধের বন্দরে এসে ওঠা এ কোনও রহস্যময় শিল্পের চাইতে কম কিছু নয়। এই কবিকে তো আমরা চিনি, কাছ থেকেই। মৃত্যু এক পোষ না মানা ঝড়ের মতো বারবার ছুটে এসে তছনছ করে দিতে চেয়েছে তাঁর সমস্ত কিছু। কিন্তু তিনি, রবীন্দ্রনাথ, এক আশ্চর্য জাদুকর, প্রতিটি মৃত্যুর কাছ থেকে দু’হাত পেতে শোককে গ্রহণ করে বন্ধ করেছেন মুঠো। যখন খুলেছেন, সেখানে রাখা রয়েছে কোনও না কোনও গান কিংবা লেখা।

প্রশ্ন করা যেতেই পারে, চেনা বা অচেনা যাই হোন না কেন, এঁদের প্রত্যেকের একেকটা বড় অবলম্বন ছিল। সৃষ্টিশীল কাজই কেবল নয়, যে কোনও রোজকার কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও মানুষ একটা স্বস্তিবোধ করে। কিন্তু সম্পর্কই যাঁদের জীবনের একমাত্র অবলম্বন, তাঁরা কী ভাবে লড়াইটাকে দেখেন?

তাঁকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে খুব কাছ থেকে চিনি। আর চিনি বলেই অবাক হই রোজ। নিতান্তই একজন গৃহবধূ, বর আর দুই ছেলেকে নিয়ে সাজানো সংসার তাঁর।

বরকে অফিসে আর দুই ছেলেকে স্কুলে রওনা করিয়ে দিয়ে গল্পের বই পড়া, সোয়েটার বোনা, বাগান করা, চিঠি লেখা...এই তাঁর কাজ।

এই জীবন নিয়ে যথেষ্ট সন্তুষ্ট হয়েই তিনি কাটিয়েছেন অনেকগুলো বছর। বেঁচে থাকার কাছ থেকে, পরিস্থিতির কাছ থেকে কখনও কিছু চাইতে হয়নি তাঁকে।

বাধ সাধল বরের হৃদরোগ। করা হল ওপেন হার্ট সার্জারি। সেই দিনই ছোট ছেলের বাইকে বেমক্কা ধাক্কা মারল একটি গাড়ি, ছিটকে গিয়ে তার মাথা লাগল ল্যাম্পপোস্টে। তাকে ভর্তি করা হল আরেক হাসপাতালে।

বড় ছেলে তত দিনে ভারতীয় সেনার উচ্চপদস্থ অফিসার। স্ত্রী আর শিশুপুত্রকে নিয়ে বিপন্ন মা’র কাছে ছুটে এল সে। দিন দশেক পর, যেদিন ভদ্রলোক ছাড়া পাবেন হাসপাতাল থেকে, সেই দিন সকালেই মৃত্যু হল ছোট ছেলের।

প্রয়োন্মাদ অবস্থা থেকে ভদ্রমহিলাকে সুস্থ করার দায়িত্ব নিল বড় ছেলেই। থেকে গেল বাবা মা’র কাছে। দু’জনেই যখন কিছুটা মেনেই নিয়েছেন পরিস্থিতির এই মার, সে ফিরে গেল ক্যাম্পে।

ঠিক এক মাসের মাথায়, নিজের রিভলভার পরিষ্কার করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত বুলেট বেরিয়ে এসে গেঁথে গেল তাঁর পাঁজরে (অন্তত ভারতীয় সেনার পক্ষ থেকে এরকমটাই জানানো হয়েছিল)। তৎক্ষণাৎ মৃত্যু।

তিন মাসের মাথায় জীবনের দ্বিতীয় বহুমূল্য চিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন সচ্ছল অথচ সর্বহারা এক দম্পতি। ফিরে এসে যৌথ আত্মহত্যাও করতে পারতেন তাঁরা। সিদ্ধান্ত নিলেন একে অপরকে জড়িয়ে বাঁচার। দুই পুত্রের অদৃশ্য মৃতদেহ কাঁধে নিয়েও হেসে উঠছিলেন তাঁরা, শামিল হচ্ছিলেন পরিবারের আয়োজনে, উৎসবে। এই সংগ্রামী দাম্পত্য টিকল শেষমেশ ছ’বছর। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ভদ্রলোক মারা গেলেন ২০১৩-র শেষ দিকে।

মহিলা কিন্তু এখনও বেঁচে আছেন। এই শহরেরই এক কোণে, একটা ফাঁকা নিঃঝুম ফ্ল্যাটে দিন কাটে তাঁর। আত্মীয়েরা বহু বার নিয়ে যেতে চেয়েছেন, তিনি কারও বাড়ি যাননি। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে বেঁচে রয়েছেন শোককে হারিয়ে দিয়ে।

খুব শান্তভাবে স্টেপ আউট করে ছয় মারার মধ্যে একটা আভিজাত্যের আরাম রয়েছে। এই সাধারণ আটপৌরে মানুষটিও জাদু জানেন নিশ্চয়ই। সামাজিক ভাবে সাধারণ হলেও, আত্মবিশ্বাসে অসাধারণ। তাই শোক এখন তাঁর স্টেডিয়ামের বাইরে।

কিন্তু প্রশ্ন হল পারলেন কী করে? তাঁর কাছে তো লেখা নেই, গান নেই, বৃহত্তর সমাজের কাছে কোনও দায়ও নেই। তবু কোত্থেকে পেলেন বেঁচে থাকার এই জোর? জিজ্ঞেস করলে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বলেন ‘ওঁদের কথা ভেবেই এখনও বেঁচে আছি।’

রহস্যটা বোধ হয় এখানেই। মনীষী থেকে সাধারণ জাদুর করিগরিটা একই সূত্রে বাঁধা। কেউ বিস্তারের দিকে হেঁটে যান, কেউ অন্তর্মুখীনতায় ডুব দেন। কিন্তু দু’টো রাস্তাতেই স্মৃতির মাইল ফলকগুলো ঝলমল করতে থাকে।

শোকের দীর্ঘ রাস্তায় স্মৃতিই বোধ হয় বলে দিতে পারে, আর কত দূর হাঁটলে একটু জিরোনো যাবে। থিতিয়ে যাওয়ার পর মুসুর ডালের উপরের অংশে যেমন ভেসে ওঠে জল, অভিঘাত ঠান্ডা হয়ে এলে শোকের উপরে ঠিক তেমন ভাবেই ভেসে ওঠে স্মৃতি। ভালবাসার, ভাল লাগার, ভাল থাকার স্মৃতি। মৃত্যুশোক সমুদ্রের নীচের প্রবালদ্বীপ হয়ে থেকে যায়। স্মৃতি হয়ে ওঠে তার চূড়া, দূর থেকে যাকে দেখে দিক-হারানো জাহাজ স্বস্তি পেয়ে এসেছে চিরকাল।

উঠে দাঁড়ানোর কাহিনি

তপন দত্ত, রামধন মিত্র লেনের বাসিন্দা। বাগড়ি মার্কেটে হোল সেল ওষুধের কারবারি। তাঁর স্ত্রী মঞ্জুদেবী স্কুলের শিক্ষিকা। প্রায় মধ্য পঞ্চাশে দাঁড়িয়ে ওঁরা তাঁদের একমাত্র ছেলেকে হারান। বেঙ্গালুরুতে চাকরিরত ছেলের তখন বিয়ের কথা চলছিল। কলকাতায় এসে হঠাৎই ঘুমের ঘোরে সেরিব্রাল অ্যাটাক। তাতেই মারা যায় সে। শোকাচ্ছন্ন, ছন্নছাড়া, উদ্ভ্রান্ত দম্পতি স্বভাবতই তখন স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে যান দূরে। কিছু দিন পর এক মনোবিদ-বন্ধু তাঁদের পরামর্শ দেন, যে করেই হোক, কাজে ফিরতে হবে। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিতে চাইলে মঞ্জুদেবীকে বাধা দেন তিনি। চাকরিতে তো ফিরলেনই, সঙ্গে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও যুক্ত হন মঞ্জুদেবী। জোর করে ব্যবসার কাজে ফেরেন তপনবাবুও। ঘটনাটি চার-পাঁচ বছর গড়িয়ে গিয়েছে। এখন মঞ্জুদেবী শিক্ষকতা ছাড়াও সেই প্রতিষ্ঠানটির নিয়মিত কর্মী। বছরে এক বার ছেলের জন্য বড় করে স্মরণসভা আয়োজন করেন তপনবাবু। সপ্তাহান্তে পুরনো বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় যান।

তপতী ঘোষের যখন তিরিশ বছর বয়স, তখন তাঁর স্কুল শিক্ষক স্বামী চরণতুলসীবাবু হঠাৎই মারা যান। ক্লাসে পড়াতে পড়াতে তাঁর হার্ট ফেল করে। ছেলে নিতাইয়ের বয়স তখন বারো-তেরো। ওঁরা থাকতেন বকুলবাগানের কাছে। গৃহবধূ তপতীদেবী পড়লেন অগাধ জলে। এক দিকে স্বামী হারানোর শোক। অন্য দিকে ছেলেকে মানুষ করে তোলার উৎকণ্ঠা। অসম্ভব হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। মনোবিদের পরামর্শে তাঁর ভাই বোনের জন্য ছোট একটা কাজের ব্যবস্থা করেন। তাতে যোগ দেন তপতীদেবী। কথায় কথায় মনোবিদ জানতে পারেন এক সময় গানবাজনার চর্চা করতেন তিনি। তখন তিনি পরামর্শ দেন, চাকরি থেকে বাড়িতে ফিরে শুধুমাত্র ছেলের পড়াশোনা দেখা নয়, পাশাপাশি গানবাজনা শেখানো শুরু করতে। কথা শোনেন তপতীদেবী। ধীরে ধীরে জীবনের ছন্দ ফিরে পেতে থাকেন তিনি।

সঞ্জয় বসু রায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সঞ্চিতা সেন, বিদ্যাসাগর মর্নিং কলেজের ছাত্রী। দীর্ঘ দিনের প্রেম। বিয়ের যখন প্রায় সব ঠিকঠাক, তখন সঞ্চিতার লিউকোমিয়া ধরা পড়ল। মাস কয়েকের মধ্যেই মারা যায় সে। বেঁচে থাকার সমস্ত ইচ্ছেটা হারিয়ে ফেলে সঞ্জয়। টানা দশ-বারো দিন প্রায় নাওয়াখাওয়া ভুলে ঘরেই পড়ে থাকত সে। তখনই পূর্ব পরিচিত এক মনোবিদ তাকে ‘সারভাইভিং থেরাপি’-র কাজ শুরু করেন। প্রথমে তাকে দিনে পরিমাণ মতো জলটা অন্তত খাওয়ানো, তারপর ধীরে ধীরে খাবার দেওয়া, তারপর একটু আধটু-বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। কখনও সিনেমা দেখানো, কখনও ট্রামে করে শহর ঘোরানো। সব কিছু থেকেই ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইত সঞ্জয়। মুখে একটাই কথা, ‘কিচ্ছু ভাল্লাগছে না’। মনোবিদের তখন একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তাঁর অক্লান্ত চেষ্টার প্রতি সঞ্জয়ের সহানুভূতি আদায় করা। আর ঘুণাক্ষরেও তাঁর সামনে সঞ্চিতার প্রসঙ্গ না তোলা। ধীরে ধীরে তাতেই কাজ হতে থাকে। ঘটনার বহু বছর কেটে গিয়েছে। সঞ্জয় এখন বিবাহিত। বিদেশে কর্মরত।

দিদি কেকার বয়স ১৪। ভাই অতনুর বয়স ১০। ওদের বাবা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের কর্মী। মা গৃহবধূ। টাইফয়েডে ভুগে অতনু হঠাই মারা যায়। তাতে শোক সামলাতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় কেকা। ২৮ দিন বাদে পটনা থেকে দুই ভদ্রলোক এসে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেন। তাঁদের মুখেই শোনা যায়, পটনা স্টেশনে ভিক্ষা করত মেয়েটি। তখনই ওই দুই ভদ্রলোক তাকে উদ্ধার করেন। বাড়িতে ফিরে কথা বন্ধ করে দেয় কেকা। মনোবিদ ডেকেও তেমন কোনও কাজ হয় না। তখন ওই মনোবিদই তাঁর শিক্ষক, কলকাতার এক সিনিয়র মনোবিদের কাছে তাকে নিয়ে যান। তিনি তাকে সাত দিনের একটা ইনজেকশন-এর কোর্স দেন। মেয়েটি ইনজেকশন নিতে ভয় পেত। ফলে ইনজেকশন দেখে আতঙ্কিত হয়ে প্রথমে তাঁর মুখ খোলে। এর পর শুরু হয় তার ভাইয়ের জন্য কান্না। তখন সুযোগ হয় নর্মাল কাউন্সেলিঙের। মাঝে মধ্যে তাকে বাড়ি থেকে বার করে হাতিবাগানে হকারদের বাজারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জিনিসপত্র কেনাকাটি করাতেও পরামর্শ দিয়েছিলেন মনোবিদ। ধীরে ধীরে কেকা ফিরতে থাকে স্বাভাবিক জীবনে। এখন সে বিবাহিত। প্রতিষ্ঠিতও।

কী বলেন মনোবিদ

গালিব

মৃত্যু। চিরবিচ্ছেদ। চেষ্টা করলেও প্রিয় মানুষটিকে একবারের জন্য দেখাও যাবে না। এর থেকে এক ধরনের ‘ট্রমা’ খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু মনোবিদরা বলেন, এই ট্রমা থেকে বেশির ভাগ মানুষই বেরিয়ে আসতে পারেন। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এর ‘হিলিং প্রসেস’ বা ‘শুশ্রূষার পদ্ধতি’টা আপনা-আপনিই শুরু হয়। মৃত্যুর মতো অনিবার্য পৃথিবীতে কিছু নেই। তবে এই সত্যিটা প্রিয়জনকে হারিয়ে কেউ তাড়াতাড়ি মানেন, কেউ দেরিতে। তবে এই সময়টায় একাকী না কাটিয়ে যতটা সম্ভব কাছের মানুষদের সঙ্গ নেওয়াটা ভাল

তবে যে কোনও মৃত্যুর পর চলে যাওয়া ব্যক্তির যে কোনও স্মৃতি নিয়ে (ছবি, ব্যবহৃত জিনিসপত্র ইত্যাদি) বেশি নাড়াঘাটা করলে ‘হিলিং প্রসেস’টা পিছিয়ে যায়। তবে সন্তানহারা বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে এগুলোই কিছুটা অবলম্বন হয়ে ওঠে। তাঁদের অভিঘাতটিই সবচেয়ে বেশি

যত তাড়াতাড়ি পারা যায় স্বাভাবিক রুটিনে ফিরে যাওয়াটা প্রথম কাজ। তার পর ধীরে ধীরে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে ‘ডিটাচমেন্ট’ বা ‘এক ধরনের দূরত্ব’ গড়ে তোলাটা খুব জরুরি। প্রয়োজনে সেক্ষেত্রে বেড়াতে যাওয়া, থিয়েটার-সিনেমা দেখা, হাল্কা বই পড়া, এমনকী একেবারে নতুন কোনও কাজে যুক্ত হওয়ারও পরামর্শ দেন মনোবিদরা। নিজেকে যত বেশি ছড়িয়ে দেওয়া যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে, তত পরিস্থিতি সামলাতে কিছুটা সুবিধে হয়‘উঠে দাঁড়ানোর কাহিনি’ ও মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ মনোবিদ ডঃ রঞ্জিত বসুর দেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি

সামলে নেওয়ার উপায়

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মত শুনলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

আচমকা কোনও দুঃসংবাদ গুরুতর ক্ষতি করতে পারে শরীরের। এমনকী সেই অপ্রত্যাশিত শকের অভিঘাতে মৃত্যু হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সুনীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বা স্নায়ু বিশেষজ্ঞ শ্যামাপদ গড়াই-রা জানিয়েছেন, হঠাৎ শক পেলে হৃদযন্ত্রের গতি বেড়ে যেতে পারে।

হৃদযন্ত্রের ধমনির দেওয়ালে কোলেস্টেরল জমে থাকে। গতি বেড়ে গেলে সেই জমে থাকা কোলেস্টেরলের স্তর মুহূর্তে ফেটে গিয়ে ধমনিতে ছড়িয়ে পড়ে। যাকে বলে ‘প্লাক র্যাপচার’। তখন ব্যক্তি হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারেন। ‘সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’-এ মৃত্যুর হার অত্যন্ত বেশি।

মানুষের দেহে দু’রকম স্নায়ু থাকে। ১. সিমপ্যাথেটিক স্নায়ু ও ২. প্যারা-সিমপ্যাথেটিক স্নায়ু।

দুঃখের খবরে অনেকের সিমপ্যাথেটিক স্নায়ু বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তখন হৃদযন্ত্রের গতি, এবং রক্তচাপ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। তার থেকে মস্তিষ্কের স্ট্রোক হতে পারে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে প্যারা সিমপ্যাথেটিক স্নায়ু বেশি উত্তেজিত হয়ে কারও রক্তচাপ হঠাৎ কমে যেতে পারে। তখন তাঁর ব্ল্যাক আউট হতে পারে এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।

চিকিৎসকদের মতে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার থেকে কমে যাওয়ায় ক্ষতির সম্ভাবনা কম থাকে। রক্তচাপ বেড়ে গেলে স্ট্রোক হয়ে কারও মৃত্যুও সম্ভব। আগেভাগে কোনও প্রতিষেধক নিয়ে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায় না। পুরোটাই নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের স্নায়বিক গঠন এবং মানসিক জোরের উপর।

তাই ডাক্তারদের পরামর্শ হল, যাঁদের আগে থেকেই হৃদরোগ বা রক্তচাপ বৃদ্ধির সমস্যা রয়েছে তাঁদের হঠাৎ করে কোনও খারাপ খবর না-জানানো। জানালেও তা সইয়ে নিয়ে বলা।

চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র আরও একটি শারীরিক সমস্যার কথা বললেন। সেখানে যে সব সময় হার্ট অ্যাটাক হবে বা রোগী অজ্ঞান হয়ে যাবেন অথবা স্ট্রোক হবে তা নয়, কিছু ‘সিমটোম্যাটিক ওভারড্রাইভ’-ও হতে পারে। সেটা কী রকম? যেমন বুকে ব্যথা হওয়া, হাত-পা ঝিনঝিন করে অবশ হয়ে যাওয়া, অত্যধিক স্ট্রেস, মাথা ব্যথা, জলতেষ্টা পাওয়া, খিদে কমে যাওয়া, মাথা ঘোরা, বার বার বাথরুমে যাওয়া, সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ হওয়া ইত্যাদি। এই অবস্থায় সাধারণত মানসিক চাপ কমানোর ওষুধ এবং ঘুমের ওষুধ দিয়ে স্নায়ুর উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করা হয়। নিয়মিত প্রাণায়াম ও ব্যায়ামও কার্যকর হয়।

অনেক সময় শকের ফলে রোগীর অস্বাভাবিক শ্বাসকষ্ট হয় বলে জানিয়েছেন ফুসফুস বিশেষজ্ঞ পার্থপ্রতিম ভট্টাচার্য। একে বলা হয়, ‘সাইকোজেনিক হাইপার ভেন্টিলেশন।’ পার্থপ্রতিমবাবুর কথায়, “আসলে যখন কেউ মনের দুঃখটা কোনও ভাবে বার করতে পারেন না তখন সেটা এই ভাবে প্রকাশ পায়। তাঁর প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, মুখ হাঁ করে খাবি খেতে থাকেন। অথচ ফুসফুসের কোনও সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। এই অবস্থায় একমাত্র ওষুধ হল ঘুম।”

গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে কোনও খারাপ খবর যথেষ্ট উদ্বেগজনক হতে পারে বলেও মত চিকিৎসকদের। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ গৌতম খাস্তগীরের কথায়, গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে এই রকম খবরে গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে, আবার অ্যাডভান্স প্রেগন্যান্সিতে সময়ের আগে প্রসব হয়ে যেতে পারে।

গৌতমবাবু বলেন, “গর্ভাবস্থায় প্রিয়জনের কোনও খারাপ খবর বেশ ঝুঁকির হয়ে যায়। রোগী তখন অবসাদে চলে যান, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেন না, ঘুমোন না, নিজের যত্ন করে না, এমনকী ওষুধও ঠিকঠাক খায় না। বাচ্চা ঠিকমতো নড়াচড়া করছে কি না সে দিকেও তার নজর থাকে না।”

চিকিৎসকদের তা-ই পরামর্শ, খারাপ খবর যতটা সম্ভব গর্ভবতীদের জানতে না দেওয়াটা তাঁদের শরীরের পক্ষে ভাল। একান্তই তা সম্ভব না হলে, চিকিৎসকের পরামর্শ মতো এগোনো উচিত। তেমন বুঝলে চিকিৎসকের উপস্থিতিতে অবাঞ্ছিত খবরটা দেওয়া দরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE