Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
শনিবারের নিবন্ধ ১...

বিদায় বাঙালি ব্যায়ামবীর

ওঁরা বুকে হাতি তুলতেন। ভারতশ্রী’র স্বপ্ন দেখতেন। এখন সিক্স প্যাক্সই একমাত্র লক্ষ্য এবং মোক্ষ। ব্যায়ামাগারের অন্দরের খবর নিলেন কৃশানু ভট্টাচার্য।ওঁরা বুকে হাতি তুলতেন। ভারতশ্রী’র স্বপ্ন দেখতেন। এখন সিক্স প্যাক্সই একমাত্র লক্ষ্য এবং মোক্ষ। ব্যায়ামাগারের অন্দরের খবর নিলেন কৃশানু ভট্টাচার্য।

ছেলে বিশ্বনাথের উপর উঠে যাবে ওই গাড়ি, দেখছেন বাবা বিষ্ণুচরণ।

ছেলে বিশ্বনাথের উপর উঠে যাবে ওই গাড়ি, দেখছেন বাবা বিষ্ণুচরণ।

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৪ ১৩:৫৬
Share: Save:

বসন্তের ফুরফুরে বিকেলে মনোহর আইচের জিমন্যাসিয়ামে উঁকি দিলে গুণময় বাগচীকে কোথাও খুঁজে পেতেন না লালমোহনবাবু। আর কী করেই বা পাবেন? গুণময়ের মতো ভারতশ্রীকে কি যখন-তখন খুঁজে পাওয়া যায়? বাংলায় তাঁদের সংখ্যা এখন প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির মতো।

গুণময়কে মনে আছে তো? ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবির সেই ব্যায়ামবীর! নিজের শরীর দেখিয়ে জটায়ুকে যিনি বলেছিলেন, “এটা মন্দির, আর মাসলগুলো তার মধ্যে সব কারুকার্য।”

গুণময় তো দূর অস্ত, নিজের ব্যায়ামাগার আগলে বসে থাকা একদা বিশ্বশ্রী ‘পকেট হারকিউলিস’-ই বা কোথায়? যিনি বলতেন, “আয়নাই আমার অনুপ্রেরণা। প্রতিদিন যখন এর সামনে দাঁড়াই, তখন গর্ব অনুভব করি নিজের শরীর দেখে।”

যাঁর সারা জীবনের তপস্যা ছিল বাঙালিকে ব্যায়ামাগারে টেনে এনে স্বাস্থ্যবান করা, সেই মনোহরবাবুই আজ বয়সের ভারে অস্তাচলে। কোথায় তাঁর সার্থক উত্তরসূরিরা?

মনোহর আইচের কাছে শরীরচর্চার ট্রেনিং নিয়েই না একদিন ভারতশ্রী হয়েছিলেন সত্য পাল, সত্যেন দাস, ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায়েরা?

“এখন আর কেউ বাবাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয় না। শরীর সাধনার মতো কঠিন কাজে মনের জোর বা পরিশ্রম করার ক্ষমতা কি আর সবার থাকে?” বলার সময় মনোহরবাবুর ছেলে মনোজের গলায় বিষণ্ণতা। তিনিও যে বাবার মতো গড়তে পারেননি নিজেকে। দুঃখ তো থাকবেই। অথচ মনোহরবাবুর একটিমাত্র মন্তব্যে পাল্টে গিয়েছিল পার্থ ভট্টাচার্যের গোটা জীবনটাই।

মুম্বইয়ের দাদারে পার্থকে প্রথম দেখেই মনোহরবাবু বলেছিলেন, “এই শরীরে ‘ভারতশ্রী’ হতে পারবি না।” পার্থর সঙ্গে গিয়েছিলেন এল কে অধিকারী। পরে তিনি ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ হয়েছিলেন। “তাঁকে নানা টিপস দিয়েছিলেন মনোহরবাবু। কিন্তু তাঁর মন্তব্যে সে দিন আমার আত্মবিশ্বাসটাই টলে গিয়েছিল,” দূরভাষে বললেন ন’বারের ভারতশ্রী পার্থ।

হতাশ হয়ে দেহচর্চা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন তিনি। “তখনকার দিনে মনোহরবাবুর যে-কোনও মন্তব্য ভবিষ্যতের ভারতসেরাদের উৎসাহিত বা অনুৎসাহিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল,” বলছিলেন পার্থ। সিঙ্গাপুরে ‘মিস্টার এশিয়া’ প্রতিযোগিতায় চতুর্থ হয়েছিলেন তিনি। আর সেরা দিনে ভারতশ্রী হওয়া সত্ত্বেও তাইপে-তে তাঁকে যেতে অনুমতি দেয়নি নেভি। সে দুঃখ তাঁর এখনও যায়নি।

পার্থর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সহকর্মী কে সিদ্দিকি। হতাশ পার্থকে নিজের হাতে স্বেচ্ছায় সব কিছু শেখানোর ভার তুলে নিয়েছিলেন তিনি। পার্থ বললেন, “এক বছরের মধ্যে আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছিল ও।”

আশির দশকের শেষে ভারতশ্রী খেতাবের লড়াইয়ে রেলকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন চার বাঙালি। পার্থ ভট্টাচার্য, লক্ষ্মীনারায়ণ নায়েক, দেবব্রত সিংহ আর সন্তোষ ঘোষ। শৈশবে ফুটবল, ক্রিকেট আর অ্যাথলেটিক্সেও তাঁদের সহজাত দক্ষতা ছিল। কিন্তু ‘ওয়েট ট্রেনিং না করলে কোনও খেলাতেই সফল হওয়া যাবে না’, খেলোয়াড় হওয়ার আদি শর্তে বিশ্বাস করে তাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন দেহচর্চায়।

মলয় রায়

শটপুট ডিসকাসে ভারত সেরার স্বপ্ন তখন দেবব্রতর চোখে। “কিন্তু ক্রমশই ফুটবল-ক্রিকেট-অ্যাথলেটিক্স হারিয়ে গেল আমাদের জীবন থেকে। ওয়েট ট্রেনিং করে তখন শরীরে পেশির তরঙ্গ তোলাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য,” ফেলে আসা দিনের কথায় মুখর ফুটবলার বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের দাদা পার্থ। ফুটবল না-খেলেও যিনি ভাইয়ের মতোই সফল। এগারো বছর নেভিতে চাকরি করে ছ’বার এবং নেভি ছেড়ে রেলে চাকরি পাওয়ার পরে আরও তিন বার ভারতশ্রী হয়েছেন পার্থ। দিনে চার থেকে ছ’ ঘণ্টা একটানা প্র্যাকটিস। বহু বছর ধরে। এমন পরিশ্রম আর কোন খেলায় করতে হয়?

কিন্তু আজ সবই যেন ইতিহাস। গোয়াবাগানে প্রায় শতাব্দী প্রাচীন ‘গোবর গোহোস জিমন্যাসিয়াম’-এর দেওয়াল ঢাকা পড়ে গিয়েছে গুমটি দোকানের আড়ালে। এক পাশে কোনও রকমে এখনও দাঁড়িয়ে গোবরবাবুর শতবর্ষ স্মারকস্মৃতি ফলক। অযত্ন আর অবহেলায় ম্যাড়মেড়ে আর বিবর্ণ।

ভিতরে উঁকি মারলেই নজরে পড়ে সেই ঐতিহাসিক কুস্তির আখড়া। পাশে ব্যায়ামাগার। বিকেল সাড়ে ৫টাতেও শুনশান। অফিস ঘরের দেয়ালে টাঙানো যতীন্দ্রচরণ (গোবর) গোহোর ছবি। ভারোত্তলন আর কুস্তির দৌলতে যে-শরীর তিনি তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন। কুড়ির দশকে আমেরিকায় সান ফ্রানসিস্কো শহরে কুস্তির লড়াইয়ে যিনি অ্যাড স্যান্টেলকে হারিয়ে লাইট হেভিওয়েটে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরে এসেছিলেন দেশে। তাঁর সঙ্গে কুস্তির আসরে পেরে উঠতেন না ইউরোপীয়রাও।

এক দিন গোবরবাবুর কাছে উঠতি ব্যায়ামবীর কমল ভাণ্ডারিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর গুরু প্রবাদপ্রতিম বিষ্ণুচরণ ঘোষ। কমলবাবুর খালি গা দেখে বেজায় খুশি হয়েছিলেন সেই কিংবদন্তি কুস্তিগির। মন্তব্য করেছিলেন, “ব্যায়াম ছেড়ো না, তোমার হবে।” গরিবের ছেলে কমলবাবুকে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন, ব্যায়ামের পরে গুড়ের জলে পাতিলেবুর রস চিপে পান করতে। গায়ে শক্তি হবে।

বাঙালির দেহচর্চার গৌরবের সেই সব সোনার দিনের কাহিনি যেন আজ কেবলই রূপকথা। কোথায় গেলেন সেই সব বিশালদেহী বাঙালিরা? যাঁদের হারিয়ে ভারতশ্রী হওয়ার স্বপ্ন শুধু ঘুমের মধ্যে দেখতেন অন্য প্রদেশের প্রতিযোগীরা?

“আগে ৯টি পদকের আটটিই যেত বাংলার ঘরে,” মোট পাঁচ বার ভারতশ্রী হওয়ার সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীত এখনও ছড়িয়ে কমলবাবুর গোটা শরীরে। গৌরবর্ণ মানুষটির মুখচোখ দেখলে কে বলবে কলকাতা পুলিশের চাকরি থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন প্রায় ২৫ বছর আগে। ৮৩ বছর বয়সেও সপ্তাহে চার দিন চেতলা থেকে ইউনিভার্সির্টি ইনস্টিটিউটের জিমন্যাসিয়াম-এ শরীরচর্চা করতে আসেন এই কিংবদন্তি।

কমলবাবুর মতে আগের তুলনায় এখন জিমের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। স্বাস্থ্যচর্চা করে নিজেদের ফিট রাখতে তৎপর আজকের প্রজন্ম। “কিন্তু শরীরচর্চা করে ভারতশ্রীর মতো কম্পিটিশনে লড়াই করার জন্য যে-মানসিকতা বা পাগলামির প্রযোজন হয়, তার অভাবেই সেই সাধনার পথে বেশি দূর আর কেউ এগোতে চায় না,” বললেন তিনি।

পাগলামি না-থাকলে কি সাফল্য আসে? কেমন সেই পাগলামি? ভারত তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। বাড়ি থেকে দু’ মাইল পথ হেঁটে সোনারপুর স্টেশনে এসে ট্রেন ধরতেন কমলবাবু। শিয়ালদহে নেমে গড়পারে এসে ‘ঘোষেস্ কলেজ’-এ পৌঁছতেন। এক-আধ দিন নয়, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। তার আগে লাঠিখেলা শিখতেন বিদ্যাসাগর স্ট্রিটে বিপ্লবী পুলিন দাসের ‘বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতি’তে। বললেন, “১৯৪৯-এর মার্চ মাসে বিষ্টুদার কলেজে যোগ দেওয়ার ছ’মাস পরেই কম্পিটিশনে প্রথম হয়েছিলাম।” ১৯৬০ সালে লন্ডনে ‘মিস্টার ইউনির্ভাস’ প্রতিযোগিতায় প্রথম ছ’জনের মধ্যে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি। খেতাব জিততে না-পারলেও প্রচারমাধ্যমে লেখা হয়েছিল, ‘অ্যামং সিক্স, এনি ওয়ান অব কম্পিটিটরস্ কুড হ্যাভ বিন মিস্টার ইউনিভার্স।’

ছোট থেকেই শরীরচর্চা করায় যে-কোনও খেলাতেই সহজাত দক্ষতা ছিল তুষার শীলের। “কিন্তু কেন জানি না, ওজন তোলার এই কুলিকামারির খেলাটাই আমাকে বেশি টানত।” এই টানের জন্যই না তিনি পাঁচ বার ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’।

ঘাড়ে ৯০ কেজি ওজন তুলে ৫০ বার ওঠবোস করতেন পার্থ। “সিদ্দিকি মানা করতেন। বলতেন, ‘আরে কেয়া করতে হো ভট্টা, মর যাওগে কেয়া?’ একবার চোখে অন্ধকার দেখেছিলাম,” দূরভাষে পার্থের হাসি অমলিন শোনায়। আসলে গোটা কুড়ির বেশি কেউ ওঠবোস করে না। “কিন্তু যে ভারতশ্রী হবে, তার কি এ সব বিলাসিতা দেখালে চলে?” মুম্বইয়ে ১১ বছর নেভি-তে চাকরি করার পরেও গোটা শহরটাকে ঘুরে দেখার সময় পাননি তিনি। দেহচর্চাতেই যে চলে যেত সারাটা দিন!

বাঙালির দেহচর্চা মানে অবধারিত ভাবে এসে পড়বে দিগ্দর্শক গুরু বিষ্ণুচরণ ঘোষের কথা। কেন আজও বাঙালি ব্যায়ামবীরের তালিকায় সবার উপরে তিনি?

গুরুর স্মৃতিচারণে অক্লান্ত কমলবাবু। “বিষ্টুদার অগম্য স্থান বলে কিছু ছিল না। দুম করে একদিন আমাকে নিয়ে হাজির হলেন বাংলার তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের বাড়ি। শুধু তা-ই নয়, মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে ধর্মেন্দ্র-উত্তমকুমার থেকে হেমন্তবাবুর মতো গায়ক সবার সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল।” বিদগ্ধ ক্রিকেট কোচ কার্তিক বসু পর্যন্ত আসতেন বিষ্টুবাবুুর আখড়ায়। “উঠতি ফাস্ট বোলারদের মাসলস্ ঠিকঠাক করিয়ে নেওয়ার জন্য”, জানালেন কমলবাবু।

গড়পারে এখনও জ্বলজ্বল করছে ‘ঘোষেস কলেজ’। কিন্তু কোথায় শরীরচর্চার সেই আখড়া? প্রবেশদ্বারের বাঁ-দিকে বিষ্ণুবাবুর তৈরি বজরঙ্গবলীর ছোট্ট মন্দির। মহাবীরের গলায় মালা। বাঁ দিকে মাসলসের কারুকার্য দিয়ে তৈরি ধ্যানাসনে বসে থাকা বিষ্ণুচরণ ঘোষের সম্ভ্রম জাগানো মূর্তি। দোতলায় অফিসঘরে হাতি নিয়ে বিষ্ণুবাবুর একমাত্র সন্তান বিশ্বনাথ ঘোষের ঈর্ষণীয় শরীরের ছবি।

বাবার মতোই ভারতবিখ্যাত ছিলেন বিশ্বনাথবাবুও। “দাদুর হুকুমে মাত্র ষোলো বছর বয়সে আমার বাবা বুকে হাতি তুলতে এতটুকু ভয় পাননি। জাপানে গিয়ে যোগাসন দেখিয়ে খুব নাম করেছিলেন তিনি”, জানালেন বিশ্বনাথের মেয়ে মুক্তামালা। তিনিও অবশ্য যোগাসনে পারদর্শিনী।

শরীরচর্চার তাগিদে এই কলেজের প্রিন্সিপ্যাল প্রেমসুন্দর দাসকে শৈশবেই তাঁর বাবা নিয়ে এসেছিলেন বিষ্ণুবাবুর কাছে। তাঁর দাবি, “গোটা বাংলাদেশে সততা-সাহস-পরাক্রম-জুজুৎসু-ভারোত্তলন বা যোগাসনে বিষ্ণুবাবুর সমকক্ষ কেউ ছিলেন না।” দাঙ্গার সময়ে মাত্র চার জন ব্যায়ামবীরকে নিয়ে নাকি বিষ্ণুবাবু সামলেছিলেন নিজের এলাকা। “মনোতোষ রায় থেকে রবিন গোস্বামী থেকে কমল ভাণ্ডারীর মতো সেরাদের তিনিই তৈরি করেছিলেন,” যোগ করলেন প্রেমসুন্দর।

তাঁর সঙ্গে একমত কমলবাবুও। তিনি বললেন, বিষ্ণুচরণ ঘোষেস্ কলেজ-এ শরীরচর্চা করার স্বপ্ন দেখতেন সাধারণ ঘরের প্রায় সব বাঙালিই। কিন্তু কেন তা আজ শুধুই অতীত?

“বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, আমি জিমন্যাসিয়াম চালাতে পারব না। তাই যোগাসনকেই আমরা বেছে নিয়েছি,” মুক্তামালার দাবি, যোগাসনেও শরীরচর্চা হয়। টোনআপ করা যায় মাসলস্কে। ধরে রাখা যায় বয়সকে। “আমার ১৩ বছরের ছেলেও যোগাসন শিখছে। এক দিন হয়তো ওর হাত দিয়েই নতুন করে শুরু হবে আমাদের মাল্টিজিম”, মুক্তামালা আশাবাদী।

যোগাসন করে তো আর বিশালদেহী হওয়া যায় না। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে গুণময় বাগচীর বাইসেপ-ট্রাইসেপ-ডেলট্রয়েট-ফোরট্রাইসেপের চোখধাঁধানো মুগ্ধতায় শুধু শুধু তো আর আচ্ছন্ন হননি লালমোহনবাবু! তাঁর অতি চেনা ছকের পৃথিবীতে কোনও বাঙালির শরীরের পরতে পরতে জিমযাত্রার এমন লৌহস্বাক্ষর থাকতে পারে, কল্পনাও করতে পারেননি রহস্যকাহিনির লেখক জটায়ু!

সাধে কী আর কমলবাবু মন্তব্য করলেন, “অন্তত একবার ভারতশ্রী হওয়ার জন্য আমাদের মতো ছেলেরা পড়ে থাকত ব্যায়ামাগারে।”

“এখনও পড়ে থাকে। তবে ভারতশ্রী বা এশিয়াশ্রী হতে নয়। ছেলেরা জিমে আসে রোমিও হতে। না-হলে জুলিয়েটদের সঙ্গে ঘুরবে কী করে?” ডানলপে নিজের অত্যাধুনিক মাল্টিজিমে ব্যস্ত মলয় রায়ের কথা বলার সময় নেই। সন্ধ্যার মুখে একের পর এক ছাত্র-ছাত্রী জিমে আসছে। তাঁর কথা, “আজকের প্রজন্ম ভাল করেই জানে, শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তা। ব্যায়াম এবং যোগাসন করে নীরোগ থাকাই ওদের আসল লক্ষ্য।”

কিন্তু ওরা ভারতশ্রী হতে চায় না। কেন চাইবে? শরীরচর্চা করে আজকাল তেমন চাকরিবাকরি পাওয়া যায় না। “তাই আজকের ছেলেরা মন দিচ্ছে ক্রিকেট-ফুুটবলে। আইপিএলে খেলেই কত ক্রিকেটার কোটি টাকা কামাচ্ছে। অথচ শরীরচর্চায় না-আছে টাকা, না-আছে চাকরি, না কোনও গ্ল্যামার,” বললেন মলয় রায়।

একই খেলায় বাবা-ছেলে প্রায় তুল্যমূল্য সাফল্য পেয়েছেন, এমন নজির ভারতে হাতে গোনা। খেলাধুলোর জগতে রায় পরিবারের মতো পরম্পরা খুব বেশি নেই। মলয়বাবুর বাবা মনোতোষ রায় প্রথম ভারতীয় হিসেবে ১৯৫১-তে বিশ্বশ্রী হয়েছিলেন। তিনিও ছিলেন বিষ্ণুচরণের শিষ্য। “বাবার মুখে শুনেছি, বিষ্ণুবাবুর কাছে ব্যায়াম এবং যোগচর্চা শিখে বাবা গিয়েছিলেন জাপান সফরে। সেখানে একবার যোগাসনের মাধ্যমে বাবা নিজের হার্টবিট বন্ধ করে ভারতের যোগের মহিমা প্রচার করেছিলেন”, দাবি করলেন মলয়বাবু।

যোগ্য ছাত্রদের ভারতশ্রী করানোর জন্য মনোহর আইচ বা বিষ্ণুবাবু নানা ভাবে সাহায্য করতেন, বলছিলেন পার্থ। তাঁর কথা, যোগ্য গুরুর অভাবেই আজ ভারতশ্রীর তালিকায় থাকে না কোনও বাঙালির নাম। তিনি নাম করলেন তাঁর কাকা ফণীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের। পার্থ এবং তাঁর ভাই বিশ্বজিৎকে লেকের জলে টেনে নিয়ে যেতেন তিনি সারা বছর। “আমাদের শরীরের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন তিনি। পরে বডিবিল্ডিংয়ে সাহায্য করেছেন মানিক বসু।” এ কালে অমন ‘গুরু’ও নাকি দুর্লভ!

নেভিতে চাকরি করার সময়ে মুম্বইয়ে পার্থ দেখেছিলেন শরীরচর্চার জোয়ার কাকে বলে! বলছিলেন, “নেভির যে-জিমে শরীরচর্চা করতাম, তা ছিল অত্যাধুনিক। ওখানে আমার সঙ্গে ভারোত্তলন করতেন ভারতশ্রী কে সিদ্দিকি, রাও বলে একজন, প্রেমচাঁদ ডেগরা। আমরা অবাক হয়ে যেতাম ডেগরার শরীর দেখে। এমন শরীর না-হলে কি আর ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ খেতাব ছিনিয়ে আনা যায়?”

প্রেমচাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পার্থরা খাটতেন দিনরাত। খাওয়াদাওয়ায় কোনও কার্পণ্য করতেন না ডেগরা। প্রতিদিন তাঁকে চারশো টাকা খাওয়ার জন্য দিত টাটা। “আর নেভি থেকে আমরা পেতাম মাত্র দশ টাকা”,বলছিলেন পার্থ। অথচ নেভি-র হয়ে তিনি দশবার জিতেছিলেন ‘মিস্টার সার্ভিসেস’ খেতাব। “আসলে সিরিয়াস দেহচর্চায় কিন্তু প্রচুর টাকা লাগে। আমাদের বাঙালিরা পিছিয়ে পড়েছে অর্থের অভাবেও।”

বাবার মতো বিশ্বশ্রী না-হতে পারলেও মলয়বাবুই প্রথম ভারতীয়, যিনি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন ‘মিস্টার এশিয়া’ খেতাব। আটবারের ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ মলয়বাবুই প্রথম ‘বডিবিল্ডার’, যিনি পেয়েছিলেন অর্জুন পুরস্কার। ১৯৭৯-তে রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার সেই ছবি আজও টাঙানো তাঁর জিমের দেওয়ালে। শরীরচর্চায় বাবার ‘পাগলামি’ গ্রাস করেছিল তাঁকেও। আজও তা বজায় রেখেছেন।

কেন এই পিছিয়ে পড়া

বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে খরচ?
তেমন গুরুও বা কই ?
নেই সরকারি সাহায্য?
দেহচর্চার ধ্যানধারণা-চেহারা সবটাই বদলে গিয়েছে?
চর্চায় যে ধৈর্য-সময়-অধ্যবসায় লাগে, তার বড় অভাব?
এ খেলায় তেমন টাকা কই, চাকরি’ই বা কোথায়?

মলয় রায়ের মতো কেন নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন না তুষার শীল? তুষারের মতে, ‘হেল্থ ইজ ওয়েলথ’ এই প্রবাদবাক্যটি তাঁদের মতো ওজন তোলার মানুষ ছাড়া আর কারও বলার অধিকার নেই। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে এক লাখ লোক হয়তো তাঁদের দেখলে চিনতে পারবেন না। “কিন্তু পাঁচ জনের মুগ্ধ চোখ সার্চলাইটের মতো এসে পড়ে আমাদের শরীরে। তাঁরা অন্তত স্বীকার করবেন, আ-হা-হা ভারী সুন্দর চেহারা তো!”

তাঁর মতে, সুস্থভাবে জীবনটাকে পেতে হলে শরীরচর্চা করতেই হবে। “আজ এই ৬৩ বছর বয়সে এসে হাড়ে হাড়ে বুঝি, ওজন তোলা আর যোগাসনের কী ফল। মনোহর আইচ থেকে আমার গুরু মনোতোষ রায় থেকে কমল ভাণ্ডারি, সবাই দীর্ঘজীবী। এবং তা শরীরচর্চার ফলেই।” কিন্তু সারা জীবন শরীরচর্চা সাধনে ব্যয় করার পরেও সরকারি স্বীকৃতি কোথায়, প্রশ্ন তোলেন তুষার। পাঁচ বার ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ এবং ‘মিস্টার এশিয়া’ প্রতিযোগিতায় রানার্স আপ হওয়ার পরেও মলয় রায় বা সুনীল পাত্রের মতো অর্জুন পুরস্কার না-পাওয়ার হতাশায় তিনি আজও ব্যথিত। “সরকারি স্বীকৃতি পেলাম না, ওজন তোলার জন্য যত লোক আমাকে চেনে, তার চেয়ে বেশি চেনে যোগাসন করি বলে।”

সাধারণ ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম করে এবং ওজন তুলেই অতীতে বাঙালিরা নানা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতেন প্রায় হাসতে হাসতে। “এখন তো সবই মাল্টিজিম। আসলে ছোট জায়গায় একসঙ্গে অনেকে ব্যায়াম করতে পারে কারও সাহায্য ছাড়াই। যন্ত্রপাতি সব ফিট করাই থাকে। তাই কমে গিয়েছে সাধারণ ব্যায়ামাগারের কদর,” বলছিলেন কমলবাবু। তাঁর মতে, এখনকার ছেলেরা চায় সলমন বা হৃতিক রোশনের মতো নায়কোচিত চেহারা। তারা মুখিয়ে থাকে মাল্টিজিমে সিক্স প্যাকের জন্য।

বিবেকানন্দ রোডে ওয়াইএমসির ব্যায়ামাগারের সুনাম বহু বছর ধরে। একদা গমগমে ব্যায়ামাগারে ভরসন্ধ্যায় মাত্র জনা তিনেক মধ্যবয়সি মিলে শরীরচর্চায় ব্যস্ত। ’৮৩ সাল থেকে ব্যায়াম করছেন সুব্রত রায়। পেশায় ব্যবসায়ী। “আগের মতো এখানে আর ভিড় হয় না। মাল্টিজিমে হয়। ওখানে প্রচুর পয়সা লাগে। সাপ্লিমেন্ট দিয়ে শরীর গড়ে দেওয়া হয়। বয়স হয়ে গেলে তার ফল কিন্তু মারাত্মক। ভেঙে যেতে পারে শরীর। কিন্তু আমাদের তা হবে না।” বয়সের তুলনায় অনেক তরুণ দেখায় সুব্রতবাবুকে। বললেন, “জেনে রাখুন, পেটে ছ’টার বেশি মাসল্ হয় না, এইট প্যাক্স কী করে হবে?”

প্রেমচাঁদ ডেগরার পরে এখন সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় অন্য প্রদেশের ব্যায়ামবীরদেরই দাপুটে উপস্থিতি। ওষুধ খেয়ে শরীর তৈরির অভিযোগ অনেক বার করেছেন মনোহরবাবু। কমলবাবুরও একই অভিযোগ। “লোহা পেটাতে আসে গরিব ঘরের বাঙালি ছেলেরাই। কোথায় পাবে তারা ওষুধ কেনার পয়সা? ফলে বাঙালিরা আজকাল আর দাঁড়াতেই পারে না ভারতশ্রী প্রতিযোগিতায়।”

ভারতশ্রী হতে গেলে স্টেরয়েডহীন সাপ্লিমেন্টের উপরে জোর দিলেন সবাই। কিন্তু এর জন্য মাসে খরচ প্রায় ২৫ হাজার টাকা। সাধারণ বাঙালি পরিবারের ছেলেরা কোথায় পাবে? প্রশ্ন তুললেন পার্থ-তুষারেরা। দেহচর্চায় কোনও স্পনসর পাওয়া যায় না। রেলে চাকরি করার সময়ে পার্থের প্রতিদিনের খরচা চালানোর জন্য তাঁর স্ত্রীকে বেচে দিতে হত নিজের গয়না। বলছিলেন, “মাইনে শেষ হয়ে যেত দশ দিনে।” সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে নব্বই দশকের শুরুতে দেহচর্চা ছেড়ে দেন তিনি।

এর পরেও কোন ভরসায় সাধারণ ঘরের ছেলেরা দেহচর্চায় মন দেবে? “আমাদের এখানে এখন যোগ্য গুরুরও খুব অভাব। বাংলার প্রাক্তন ভারতশ্রীরা প্রায় সবাই ব্যস্ত যোগাসন নিয়ে। বিষ্ণুবাবু বা মনোহরবাবুর মতো গুরু কোথায়? অথচ মাসলসের জন্য ফ্রিওয়েট করতেই হবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থেকে আলাদা আলাদা এক্সারসাইজ করতে হবে ডাম্বেল, বারবেল নিয়ে। কেরিয়ারের পিছনে ছোটা আজকের প্রজন্মের পক্ষে তা কি সম্ভব?

‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে অভিনয় করার পরে পাল্টে গিয়েছিল মলয়বাবুর গোটা জীবনটাই। সত্যজিৎবাবুর স্মৃতিতে আজও আচ্ছন্ন ৬৩ বছরের তরুণ মলয়বাবু। স্বীকার করলেন, ওই ছবির পর থেকেই তাঁর পরিচিতি বেড়ে গিয়েছিল বহু গুণ। “প্রচারও পেয়েছিলাম দেখার মতো”, ফেলে আসা দিনে ফিরে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। দেওয়ালে সেই বয়সের ছবি দেখিয়ে মলয়বাবু স্বীকার করলেন, বয়সের থাবা শরীরে তো পড়বেই। তবে এখনও সমানে লড়ে যেতে পারেন তরুণদের সঙ্গে।

শুধু মলয়বাবুই নন, সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন পার্থও। হিন্দি ছবি ‘কামাগ্নি’-তে অভিনয় করেছিলেন হি-ম্যানের ভূমিকায়। রোজ রাতে ঘুমের ঘোরে নায়িকা স্বপ্নে দেখতেন তাঁর হি-ম্যানকে। নেভিতে থাকাকালীন একটি নাটকে হারকিউলিসের ভূমিকায় অভিনয় করেন।

মাল্টিজিমের চাপে পুরনো ব্যায়ামাগারের ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাঙালি কি আর ভারতসেরা হবে না? কমল ভাণ্ডারি থেকে নিরাপদ পাখিরা বাঙালি ভারতশ্রীর দীর্ঘ তালিকা। কিন্তু সে সবই ১৫-১৬ বছর আগের কথা। তার পর আর এই তালিকায় নাম নেই কোনও বাঙালির। ভবিষ্যতে হবে? তুষার শীল এবং মলয় রায় আশাবাদী। সরকারি সাহায্য পেলে পরের প্রজন্ম তৈরি করে দেওয়ার দাবি করলেন মলয় রায়। খালি একটু সুযোগসুবিধার অপেক্ষা। “আর তার পরেই ফিরে আসবে পুরনো ঐতিহ্য।”

নিজের মাল্টিজিমে এই প্রজন্মের কসরত দেখতে দেখতে তুষার আবেগতাড়িত, “আর কিছু পারি না-পারি, দেহচর্চা করিয়ে তো সুস্থসবল রাখতে পারি সমাজকে।” ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও ফিটনেসের উপরে জোর দিচ্ছেন তিনি। “আমার দু’জন ছাত্রী ‘ওয়ার্ল্ড ফিটনেস চ্যাম্পিয়নশিপ’ থেকে ব্রোঞ্জ জিতে ফিরে এসেছে। ভারত থেকে ওরাই প্রথম এত বড় সাফল্য পেল। শরীরচর্চার সুদিন ফিরবেই। আমি প্রত্যয়ী”, তুষারের স্বরে শীত-শেষে বসন্তের ডাক।

খানদান

• প্রতিযোগিতার ছ’মাসে আগে পালটে যায় ওঁদের খাবার তালিকা।
আর শেষ এক মাসে? প্রোটিন-কার্বহাইড্রেট-ভিটামিন্স-স্যালাডস,
সাদা ভাত-রুটি-চিনেবাদাম থাকেই, সঙ্গে কুসুম ছাড়া
ডিম-২০-২২টা, মুর্গির বুকের অংশ এক কেজি।
শাক-সবজি-মাছ-ছানা-সয়াবিন, পোড়া রাঙাআলু।

• এ ছাড়াও পর্যাপ্ত পেয়ারা-মুসুম্বি-শশা। যতটা সম্ভব নুন ছাড়া লাগে
স্টেরয়েডহীন মাস গেইনার প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট। যার দাম প্রতি
কেজি চার--সাড়ে চার হাজার টাকা। মাসে দরকার পাঁচ কেজি।

তথ্য: তুষার শীল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

krishnanu bhattacharja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE