Advertisement
E-Paper

রেসকোর্সে রবির তিন বছরের একটা ঘোড়া ছিল

বাইশ গজের দশ বন্ধুর গল্প। আজ শেষ পর্ব। লিখছেন কিশোর ভিমানীরবি শাস্ত্রী আজকালকার ছেলেমেয়েদের কাছে এক সময়ের শুধুমাত্র একজন প্লে-বয় ক্রিকেটার। তারা ওকে বেশি করে মনে রাখে ওর লাইফস্টাইল, অডি গাড়ি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আর প্রতি মুহূর্তে উত্তেজনায় ঠাসা কেরিয়ারটার জন্য। ভাবলে সত্যিই খুব খারাপ লাগে। আমি যেহেতু শাস্ত্রীর বন্ধু, ককটেল সার্কিটগুলোয় প্রায়ই আমায় জিজ্ঞেস করা হয়, আচ্ছা সত্যিই কি শাস্ত্রী ফিল্ম স্টার আর মডেলদের কাছে ত্রাস ছিল? আশির দশকের চমকে দেওয়া টেনিসতারকা গাব্রিয়েলা সাবাতিনির সঙ্গে সত্যিই কি রবি ডেট-এ গিয়েছিল?

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৪ ০১:০৪
আশির দশকের চমকে দেওয়া টেনিসতারকা গাব্রিয়েলা সাবাতিনির সঙ্গে সত্যিই কি রবি ডেট-এ গিয়েছিল

আশির দশকের চমকে দেওয়া টেনিসতারকা গাব্রিয়েলা সাবাতিনির সঙ্গে সত্যিই কি রবি ডেট-এ গিয়েছিল

রবি শাস্ত্রী আজকালকার ছেলেমেয়েদের কাছে এক সময়ের শুধুমাত্র একজন প্লে-বয় ক্রিকেটার। তারা ওকে বেশি করে মনে রাখে ওর লাইফস্টাইল, অডি গাড়ি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আর প্রতি মুহূর্তে উত্তেজনায় ঠাসা কেরিয়ারটার জন্য। ভাবলে সত্যিই খুব খারাপ লাগে।

আমি যেহেতু শাস্ত্রীর বন্ধু, ককটেল সার্কিটগুলোয় প্রায়ই আমায় জিজ্ঞেস করা হয়, আচ্ছা সত্যিই কি শাস্ত্রী ফিল্ম স্টার আর মডেলদের কাছে ত্রাস ছিল? আশির দশকের চমকে দেওয়া টেনিসতারকা গাব্রিয়েলা সাবাতিনির সঙ্গে সত্যিই কি রবি ডেট-এ গিয়েছিল?

এই অসম্ভব প্রতিভাধর ক্রিকেটারকে নিয়ে নানারকম গল্পগাছা জনপ্রিয় খবরের কাগজেও অনেক বেরিয়েছে। মনে হয় না, রবি কোনও দিন ওর পছন্দের জীবন আর সুন্দরী মহিলাদের জন্য ভালবাসা গোপন করেছে।

রবির বিবাহপূর্ব জীবনের সেই তূরীয় সময়ে যে সব যুবতী সঙ্গিনী ছিলেন, আজ তাঁরা সুখী বিবাহিত জীবন কাটাচ্ছেন এবং যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিতও। এই মুহূর্তে তাঁদের নাম উল্লেখ করাটা কখনওই উচিত কাজ হবে না। এটুকু বলি, ওঁদের মধ্যে ছিলেন একজন এনআরআই ক্রিকেট-প্রেমী, এক-দু’জন ফিল্ম স্টার এবং উঁচুতলার কিছু মহিলা।

রংচঙে, নাছোড় এই বাঁ-হাতি বোলার আর ডান-হাতি ব্যাটসম্যানের অভিষেক নিয়ে আর কী বলব! ১৯৮০-’৮১-র অস্ট্রেলিয়া ট্যুরে পায়ের আঙুলের হাড় ভেঙে গিয়েছিল দিলীপ দোশীর। তাই বাঁ-হাতি স্পিনার স্লটে প্রথম পছন্দ দোশীর জায়গায় রবি শাস্ত্রীকে ডাকা হল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ওর অভিষেক নিউজিল্যান্ড সফরে। সফরটা ছিল অস্ট্রেলিয়া ট্যুরের কয়েক দিন পরেই। মেলবোর্ন থেকে অকল্যান্ড যাওয়ার রাস্তায় টিমমেটদের প্রচুর ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলল। ওরা বলছিল কী জানেন? শাস্ত্রীর আবির্ভাবের কথা শুনে নাকি দোশীর খুঁড়িয়ে চলা ভাবটা হঠাৎ করে অনেক ঠিক হয়ে গিয়েছে!

শাস্ত্রীর শুরুটা একটু স্লো ছিল। ওই সময় নির্বাচকদের হাতে বেশ কিছু বাঁ-হাতি স্পিনার ছিল বলে নির্বাচন নিয়েও চিন্তার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে ওকে।

বয়স হয়ে যাওয়া পদ্মাকর শিভালকর আর ধীরজ পরসানা তো ছিলই, তার সঙ্গে তরুণ মনিন্দর সিংহের সিভি পড়ে ছিল নির্বাচকদের টেবিলে। তা ছাড়া তিরিশের কোঠা পেরিয়ে অভিষেক হওয়া দিলীপও অবসর নেওয়ার তাড়ায় ছিল না। তা এ রকম পরিস্থিতিতে শাস্ত্রীর উঠে আসা এক অলরাউন্ডার হিসেবে। যে কী না দরকারে কৃপণ বোলিং করবে, ব্যাটিংয়ে ভরসা দেবে আর বেশ ভাল ফিল্ডিং করবে। যদিও ও নিজেই স্বীকার করেছিল যে, পরের দিকে ব্যাটিংয়ের উপরই বেশি নজর দিত। না হলে আর ‘চাপাটি শট’-টার পেটেন্ট নিয়ে নেয়!

খুব তাড়াতাড়িই অলরাউন্ডার হিসেবে টিমের বড় অংশ হয়ে উঠল শাস্ত্রী। টেস্ট ম্যাচে শাস্ত্রীর অধিনায়কত্ব করা এক বারই ১৯৮৭-’৮৮ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের তৃতীয় টেস্টে। তা-ও সেটা বেঙ্গসরকরের চোট ছিল বলে।

ওই টেস্টটার সময় চেন্নাইয়ের (তখন মাদ্রাজ) কনেমারা হোটেলের একই তলায় ঘর ছিল রবি আর আমার। রাত পর্যন্ত আড্ডা মারতাম দু’জনে। সাধাসিধে এই যুবকের কাছে প্রচুর ক্রিকেট স্ট্র্যাটেজি শিখেছি আমি।

ম্যাচটার ঘটনাবহুল শেষ দিনের আগের রাতের কথা। হোটেলের ম্যানেজার হরিশ খন্না আমাদের কয়েক জনকে পুলের ধারে একটু মদ্যপানের নেমন্তন্ন করেছিলেন। রবি আমার কাছে এসে হঠাৎ বলল, “দেখে নিও, কাল হিরুকে দিয়েই ম্যাচটা জেতাব। কাল কমেন্ট্রি শুরু করার আগে এক বার আমার সঙ্গে দেখা করে যেয়ো তো।”

পর দিন সকালে মিডিয়া বক্সের তলায় ড্রেসিংরুমে গিয়ে শাস্ত্রীর সঙ্গে বসলাম। ক্যাপ্টেন যখন টিমকে মাঠে নিয়ে যাচ্ছে, দেখলাম হিরওয়ানির কাঁধে ওর হাত। দূরদর্শনের ক্যামেরাম্যান ব্যাপারটা ক্যামেরায় তুলে রাখল। ইনদওরের স্পিনার-কে রবি বলেছিল, “কাম অন হিরু, আমার জন্য ম্যাচটা জিতে দেখাও!”

তার পর যা হল, তা তো ইতিহাস! ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে ১৩৬ রান দিয়ে ১৬ উইকেট নিয়েছিল হিরওয়ানি। একমাত্র টেস্টে ভারতের অধিনায়কত্ব করে ম্যাচটা জিতে গেল শাস্ত্রী। সত্যি, মোটিভেটর একেই বলে!

রবি নিঃসন্দেহে টিমম্যান। ক্রিকেট নিয়ে ওর আবেগও আছে। কিন্তু গ্যালারির সমর্থন নিয়ে কখনওই চিন্তিত দেখিনি। তাই রবি আউটফিল্ডে থাকলে যে টিটকিরি শুরু হত ‘হায় হায় শাস্ত্রী’ তা নিয়ে ওর কোনওদিন বিন্দুমাত্র হেলদোল হয়নি। ডাকটা শুনত আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসত। দু’এক বার তো গ্যালারির জন্য অর্কেস্ট্রা কনডাক্ট করার অভিনয় করতেও দেখেছি।

মাঠের বাইরের রবি শাস্ত্রী নিয়ে কম কথা হয়নি। ওর তথাকথিত মদের নেশা, দ্রুত গতির গাড়ি, রংচঙে জীবন আর সুন্দরী মহিলা কত কথা!


অমৃতা সিংহর সঙ্গে

এর বেশির ভাগই যে বড্ড বেশি রং চড়ানো, তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। মাঠের বাইরে রবির সঙ্গে প্রচুর সময় কাটিয়েছি। প্রথমত, অনুষ্ঠান না থাকলে ও খুব একটা মদ্যপান করত না। এক গ্লাস বিয়ার, একটু ব্র্যান্ডি বা ভাল অস্ট্রেলীয় ওয়াইন রবি উপভোগ করত, তার বেশি না। ওর বন্ধুদের মধ্যে অনেক ফিল্মস্টার আছেন। অনেক সুন্দরী মহিলা আছেন। কিন্তু সেটা কার নেই?

আশির দশকের শেষের দিকের একটা ঘটনা বলি। দুবাইয়ের ‘ডিস্কো ২০০১’ ক্লাবের বাইরেটায় বসে আমরা এক গ্লাস ওয়াইন খাচ্ছিলাম। চার পাশের অতি উৎসাহী কয়েক জন মাঝেমধ্যে এসে কোনও না কোনও অভিনেত্রী নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ছ’ফুট তিন ইঞ্চির ওই চেহারাটা চোখে না পড়ে কোনও উপায় আছে! আর দ্রুত গতির গাড়ির কথা? মেলবোর্নে ১৯৮৫-তে চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স হয়ে একটা অডি পুরস্কার পেয়েছিল রবি। তার পরপরই কেউ একজন ওকে জিজ্ঞেস করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ফাইনালে অডি জেতার চিন্তা নিয়েই ব্যাট করতে নেমেছিলে নাকি? প্রশ্নকর্তা তরুণীর দিকে তাকিয়ে রবি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, “আপনি গাড়িটা দেখেছেন কি?” ব্যস, কথা ওখানেই শেষ। জুয়াখেলা? ভুলে যান। হ্যাঁ, কলকাতা রেসকোর্সে রবি আর আমার তিন বছরের একটা ঘোড়া ছিল। নাম ‘জুয়েল অব দ্য ইস্ট’। মুম্বই বা কলকাতার সমাজের উচ্চশ্রেণির সঙ্গে রেসকোর্সে থাকার গ্ল্যামার আর উত্তেজনাটা উপভোগ করত রবি। কিন্তু কখনওই ও খুব বড় জুয়াড়ি ছিল না।

হ্যাঁ, ক্যাসিনোও ওর প্রিয় জায়গা ছিল। ক্যারিবিয়ানের সেন্ট ভিনসেন্ট, টাসমানিয়ার হোবার্ট বা কার্ডিফে (ও তখন গ্ল্যামারগনে কাউন্টি খেলত) ওর সঙ্গে ক্যাসিনোয় প্রচুর সময় কাটিয়েছি আমি। সোয়ানসি-তে অসাধারণ এই ক্রিকেটারের অন্য আরেকটা দিক দেখেছি। সকালে নিজের ফিটনেস রুটিন নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকত রবি অল্প একটু ব্রেকফাস্ট করে সময়ের অনেক আগেই মাঠে পৌঁছে যেত।

১৯৮৭ থেকে ১৯৯১-এর কথা বলি। ওই সময় গ্ল্যামারগনে কাটানো রবির দিনগুলোয় সোয়ানসিতে ওর কটেজে আমি ছিলাম নিয়মিত অতিথি। ম্যাচের পর সন্ধেয় সমুদ্রের ধারে ‘ক্যাপ্টেন্স ওয়াইফ’ পাবে বিয়ার খেতাম আমরা। মাঝে মাঝে ডিপ সি ফিশিং করতে পাব মালিকের সঙ্গে স্পিডবোটে করে সমুদ্রে বেরিয়ে পড়তাম।

তবে রবির সঙ্গে আমার সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার ১৯৮৯-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। এসেকিবো আর দেমারারা এই দুই বিরাট নদীর মধ্যে স্যান্ডউইচ হয়ে থাকা দেশ গায়ানা। তার চার পাশে রয়েছে বিরাট রেন ফরেস্ট। এমনিতে যেখানে ঘুরে বেড়ানোর কথাই নয় আমাদের। কিন্তু রবির এক বান্ধবী আনা একদম রেনফরেস্টের মাঝখানে একটা কাঠের কারখানার মালকিন ছিল। রেস্ট ডে-র দিন ও রবিকে বলেছিল কয়েক জন বন্ধু নিয়ে ওখানে চলে আসতে। জঙ্গলের মাঝখানের কারখানায় যেতে হবে প্লেনে করে।

দশ সিটার ওই প্লেনে মোহিন্দর অমরনাথ, অরুণলালের পাশাপাশি আরও দু’এক জন ছিল। জঙ্গলের মধ্যে যাওয়ার ওই ফ্লাইটটা মোটেও সুখের ছিল না। তবে অপূর্ব কিছু দৃশ্য দেখা গেল কোলার রঙের মতো নদী, বিশাল বড় বড় সব গাছ, অসংখ্য পোকামাকড়। আর চার দিকে কাটা গাছের স্তূপ। পাইলট বিষ্ণু আমাদের ডাইনিং এরিয়ায় এসে হঠাৎ বলল, বাইরে ঝড় হচ্ছে তাই জর্জটাউনে ফেরাটা পেছোতে হবে।

বিকেল পাঁচটা নাগাদ বৃষ্টি একটু কমলে দু’দফায় ফেরার যাত্রা শুরু করলাম। কেন? দশ সিটারের ওই ছোট্ট প্লেন আমাদের সবাইকে নিয়ে কাদা-মাখা রানওয়েতে নড়তেই পারত না!

গায়ানা পেগ্যাসাস হোটেলে ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে গেল। দিনটা খুব একঘেয়ে ক্লান্তিকর কেটেছিল। টিম-ম্যানেজার বেঙ্কটরাঘবন এই বেড়াতে যাওয়ার কথা জানতে পারলে কী বলবেন ফেরার সময় ওই একটা ব্যাপারে নিয়েই কথা চলল।

সব শুনে বেঙ্কি প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিল। এ ভাবে বেরিয়ে পড়ার কত রকম ঝুঁকি থাকতে পারে, সে সব নিয়ে বক্তৃতাও দিল। টিমের সবাইকে নোটিস ধরানো হল, ভবিষ্যতে কোনও দিন ওরা যেন এমন ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে না পড়ে।

রবির সবচেয়ে ভাল গুণগুলো বোধহয় ওর উষ্ণতা, ওর বড় হৃদয় আর ওর ছোঁয়াচে হাসি। আমার ছেলে গৌতম এখন টিভির ক্রিকেট-অ্যাঙ্কর, ও শাস্ত্রীর খুব বড় ভক্ত ছিল।

কলকাতায় ও যখন স্কুলে পড়ত তখন ক্লাসের বন্ধুদের বলে বেড়াত, আমার বাবা রবিকে আমাদের স্কুলে নিয়ে আসবে। একবার মনে আছে, দিনটা খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটছিল। তবু কী জানি কী ভাবে রবি সে দিন ঠিক সময় বের করে ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পৌঁছে গেল। তাতে ছেলে গৌতম যত না খুশি হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি স্বস্তি পেয়েছিলাম আমি! এর পর ২০০০ সালে যখন গৌতম বিয়ে করল, তখন ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাবের অনুষ্ঠানে সারপ্রাইজ অতিথি কে ছিল, সেটা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না!

অনুবাদ: প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত

gautam bhimani ravi sastri
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy