বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবছেন অথবা ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠাতে চান। আর তার জন্য ঋণ নিতে চান। সে ক্ষেত্রে প্রথম যে চিন্তা মাথায় আসে, তা হল, সুদের হার ঠিক কত যাচ্ছে? যার উপর নির্ভর করবে আপনার মাসিক কিস্তির অঙ্ক। অর্থাৎ প্রতি মাসে কত টাকা ফেরত দিতে হবে, ঋণ নেওয়ার আগেই সেই হিসাবও কষে রাখতে হয় আপনাকে। তার পর যদি সুদের হার বাড়ে, তা হলে তো অতিরিক্ত টাকা খরচের বোঝা চেপে বসবে আপনার ঘাড়ে। কিন্তু এমন যদি কোথাও লগ্নি করা যায়, যাতে সুদ বাড়লেও তা আপনার গায়ে না লাগে? সেই রাস্তাই আমরা আজ খুঁজব আগাম পণ্য লেনদেন বাজারে সুদের হারের কেনা-বেচার (ইন্টারেস্ট রেট ফিউচার বা আইআরএফ) মাধ্যমে। তবে প্রথমেই আলোচনা করব জিনিসটা কী, তা নিয়ে।
আইআরএফ কী?
• চলতি বছরের শুরুতেই দেশের আগাম লেনদেনের বাজারে পা রেখেছে এই নয়া পণ্য।
• এটি এক ধরনের চুক্তিপত্র। বাজারে বন্ডের দামের উপর ভিত্তি করে এই চুক্তিপত্র তৈরি করা হয়। অর্থাৎ আগাম বাজারে আপনি যখন টাকা ঢালেন, তখন আসলে এই চুক্তিপত্রটিই লেনদেন করে থাকেন।
• বাজারে তো বন্ড কেনাই যায়, তা হলে আইআরএফের সঙ্গে এর তফাৎ কী? মূল তফাৎ, আগাম লেনদেনে সরাসরি বন্ড কিনছেন না। বন্ডের দামের ওঠা-পড়ার উপর টাকা ঢালছেন। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর বন্ডের দাম কতটা উঠবে বা পড়বে, তা আন্দাজ করেই চুক্তিপত্র কেনা-বেচা করছেন।
• তবে অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম বার এই বাজারে পা রাখার সময় সঠিক লগ্নির পরিমাণ বোঝা এবং সেই মতো বিনিযোগ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
সুদে লেনদেন বলে কেন?
প্রথমেই যে প্রশ্নটা সবার মনে আসবে, তা হলে একে ইন্টারেস্ট রেট ফিউচার বলা হয় কেন? সুদের হারের সঙ্গেই বা এর সম্পর্ক কোথায়?
সম্পর্ক আছে। কারণ, বন্ডের দামের ওঠা-পড়া বেশির ভাগটাই নির্ভর করে সুদের হারের উপর। আমরা জানি সুদের হার কমলে বন্ডের দাম বাড়ে, আর সুদ বাড়লে উল্টোটা হয়। ফলে বন্ডের দামের বাড়া-কমায় লগ্নি করা মানে, পরোক্ষ ভাবে সুদের হারের উপরই বিনিয়োগ করছেন আপনি। তাই একে ‘ইন্টারেস্ট রেট ফিউচার’ (আইআরএফ) বলা হয়।
ধরুন আপনি আজকের দরের ভিত্তিতে আগাম লেনদেনের বাজারে ওই চুক্তিপত্র কেনা বা বেচার জন্য চুক্তি করলেন। সে ক্ষেত্রে মেয়াদকালে (সর্বোচ্চ এক বছর) পণ্যটির দাম ওঠা-নামা করবে। তখন আপনি নিজের সুবিধা মতো তা কিনে অথবা বিক্রি করে বাজার থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। অথবা অপেক্ষা করতে পারেন মেয়াদ শেষের জন্যও।
• সাধারণত সুদের হার বাড়বে মনে করলে কোনও লগ্নিকারী এই চুক্তিপত্রটি আগাম লেনদেনের বাজারে বিক্রি করে রাখতে পারেন।
• একই ভাবে ভবিষ্যতে সুদের হার কমবে বলে মনে করলে বিনিয়োগকারী তা কিনে রাখতে পারেন। এ নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। তার আগে বলে রাখি কোন বন্ডের ওঠা-নামার উপর লগ্নি করছেন আপনি।
কীসে লগ্নি?
এ ক্ষেত্রে লগ্নিকারী ইচ্ছেমতো যে কোনও ঋণপত্রের দামে টাকা ঢালতে পারেন না। এ জন্য কিছু নিয়ম রয়েছে। বর্তমানে ভারতে সুদের হারের আগাম লেনদেনের ক্ষেত্রে দু’টি বন্ডের দরের উপর লগ্নি করা হয়—
• ১০ বছরের কেন্দ্রীয় সরকারি সিকিউরিটিজ (টেন ইয়ার গভর্মেন্ট অব ইন্ডিয়া সিকিউরিটি)। এর মূল দর ১০০ টাকা। কুপন রেট আজকের দিনে প্রায় ৮.৮৩%। পাওয়া যায় প্রতি ষান্মাসিকে।
• ৯১ দিন মেয়াদের ভারত সরকারের ট্রেজারি বিল।
• সাধারণ ভাবে মনে করা হয় এই ধরনের সরকারি সিকিউরিটিজ অথবা ট্রেজারি বিল লগ্নির অন্যতম সুরক্ষিত মাধ্যম। কেন্দ্রীয় সরকার এই ধরনের বন্ড ছাড়ে বলে, টাকা ফেরতের নিশ্চয়তাও এ ক্ষেত্রে অনেকটাই বেশি। ফলে আইআরএফের ক্ষেত্রেও এই ধরনের পণ্যের চাহিদা আগামী দিনে আরও বাড়বে বলেই ধারণা।
দামের ওঠা-পড়া
লগ্নি তো করবেন, কিন্তু কী দেখে বুঝবেন যে কখন পণ্যটি বিক্রি করবেন বা কখন কিনবেন? আসুন তা নিয়েই একটু আলোচনা করে নিই। তবে তার আগে বুঝতে হবে বন্ডের দাম কী ভাবে ওঠে-পড়ে। কারণ আসলে তো বন্ডের দামের উপরই লগ্নি করছি, তাই না?
• আমরা জানি বাজারে সুদের হার বাড়লে বন্ডের দাম কমে। আর সুদের হার কমলে বন্ডের দাম বাড়ে। তার কারণ, বন্ডের একটি নির্দিষ্ট কুপন রেট থাকে। অর্থাৎ সুদের হার নির্দিষ্ট থাকে। এ বার ধরে নিন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়াল। যার জেরে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিও সুদ বাড়াল (সব সময় তা না-ও হতে পারে)। তখন স্বাভাবিক ভাবেই লগ্নিকারীদের কাছে ব্যাঙ্কের আকর্ষণ বেশি। যে কারণে বাজারে বন্ডের দাম কমে যায়। লগ্নিকারী যদি মনে করেন আগামী কয়েক মাস এই অবস্থাই চলবে, সে ক্ষেত্রে তিনি আগাম লেনদেনের বাজারে চুক্তিপত্রটি বিক্রি করে রাখতে পারেন। সে ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে বন্ডের দাম আরও কমে গেলেও তখনকার কম দামেই তা কিনে লগ্নিকারী মুনাফার মুখ দেখবেন। অথবা মেয়াদ শেষের আগে পছন্দমতো সময়ে কম দামে চুক্তিপত্র কিনে বাজার থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন।
• একই ভাবে যদি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমায়, তখন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিও সুদ কমাতে থাকে (সব সময় হয় না)। যে কারণে বিনিয়োগকারীদের কাছে বন্ডে লগ্নি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ফলে বাজারে তার দাম বেড়ে যায়। এ বার লগ্নিকারী যদি এই ধারা বজায় থাকবে বলে মনে করেন, সে ক্ষেত্রে আগাম লেনদেনের বাজারে পণ্যটি কিনে রাখতে পারেন। কারণ এর পরও বন্ডের দাম বাড়তে থাকলে, মেয়াদ শেষে আপনি তখনকার বেশি দামে তা বিক্রি করে দিতে পারবেন। ফলে মুনাফা হবে। অথবা মেয়াদ শেষের আগে লগ্নিকারী চাইলে পণ্য বিক্রি করে নিজের মুনাফা বুঝে নিতে পারেন।
• এক জন সাধারণ লগ্নিকারী এতে উৎসাহী হবেন কেন? তার কারণ হিসেবে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরুন, বাড়ি কেনার জন্য ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু এখন সুদ অত্যন্ত চড়া। অথচ পরে সুদ কমবে বলে মনে হচ্ছে। তখন আপনি চড়া সুদের লোকসান পুষিয়ে নিতে আগাম লেনদেনের বাজারে চুক্তিপত্রটি কিনে রাখলেন। যখনই সুদের হার কমবে ও বন্ডের দাম বাড়বে, আপনি তা বিক্রি করে বেরিয়ে যেতে পারবেন। ফলে চড়া সুদ আর ততটা গায়ে লাগবে না।
লগ্নি করবেন কোথায়?
• ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই), বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ (বিএসই) ইত্যাদিতে আইআরএফ লেনদেন হয়।
• শেয়ার বা কমোডিটি মার্কেটে লেনদেনের জন্য যেমন আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়, এখানেও কেনা-বেচা করার জন্য এক্সচেঞ্জগুলিতে নথিভুক্ত ব্রোকারদের মাধ্যমে একটি ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়।
চুক্তিপত্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য
• লগ্নিকারীকে ন্যূনতম ২,০০০টি বন্ড (এক লট) কিনতেই হয়। সে ক্ষেত্রে তার মোট মূল্য হিসাব করা হবে যে দিন চুক্তিপত্র কেনা হচ্ছে, সেই দিনের বাজার দরকে ২,০০০ দিয়ে গুণ করে। ৮.৮৩% কুপনের সরকারি বন্ডের বাজার দর যদি ১০২ টাকা হয়। সে ক্ষেত্রে এক লটের মোট মূল্য হবে (২০০০x১০২)= ২.০৪ লক্ষ টাকা।
• লগ্নির জন্য চুক্তি করার সময় একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা প্রথমেই দিতে হয়, যা মার্জিন মানি নামে পরিচিত। এই ক্ষেত্রে মার্জিন মানি প্রায় ৩%। ফলে ১ লটের জন্য চুক্তি করতে প্রথমেই বিনিয়োগকারীকে প্রায় ৬,০০০ টাকা দিতে হবে (২ লক্ষের ৩% ধরে)।
• প্রত্যেক মাসের শেষ বৃহস্পতিবার সেই মাসের চুক্তিপত্রটির মেয়াদ শেষের দিন ধার্য করা হয়েছে। সেই দিন ছুটি থাকলে তার আগের দিন (বুধবার) চুক্তির শেষ বলে ধরা হয়।
• লেনদেন চলে সোম থেকে শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
• হাতে বন্ড পাওয়া যায় না। টাকার মাধ্যমেই লাভ-ক্ষতির হিসাব হয়।
লেখক পণ্যবাজার বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy