Advertisement
০৮ মে ২০২৪
Presents

শেয়ারের বাছবিচার

নববর্ষের পাতে ইলিশ আর চিংড়ি তো দেখেই কিনেছেন। শেয়ার? লিথছেন অদিতি (দে) নন্দীএত দিনে দু’জনের কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে, শেয়ারে বিনিয়োগ না করলে যেমন মূল্যস্ফীতির দৈত্যের কাছে হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা, তেমনই বিনিয়োগ ভুল হলে রোজগারের টাকা এমনিই উবে যাবে। সুতরাং? ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি, খবরের কাগজের পাতা ওল্টানো, পড়াশোনার পথই স্থির হল। দু’জনেরই সময়ের অভাব, কিন্তু ঠিক হয়েছে পয়লা বৈশাখের শপিংয়ের টাকাটা লাগানো হবে শেয়ারেই।

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৪ ০২:২৬
Share: Save:

আজ আমি আপনাদের এক সদ্য বিবাহিত দম্পতির গল্প বলব। তাঁদের নাম কৃষ্ণেন্দু আর রিনা। কৃষ্ণেন্দু পেশায় চিকিৎসক, রিনা শিক্ষিকা। গত পাঁচ বছরে নিজেদের সম্পর্ক তৈরি করার পাশাপাশি তাঁরা আর যা যা করেছেন তা হল, কেরিয়ার তৈরি এবং টুকিটাকি সঞ্চয়। তবে ভবিষ্যৎ চিন্তার অবকাশ তেমন ঘটেনি। অবশেষে সেই ভাবনা মাথায় এল মধুচন্দ্রিমা কাটাতে গিয়ে। সমুদ্রতটের বালুকাবেলায়। এবং তখন থেকেই স্বপ্নগুলোকে সত্যি করতে ও আগামী দিনের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুরু হয়ে গেল পরিকল্পনা, আলোচনা। বোঝা গেল, জিনিসপত্রের বাড়তে থাকা দামের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে শেয়ারে হাত লাগাতেই হবে। তা না হলে দিনরাত এক করে রোজগার করা অর্থ জল হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।

শেয়ার কেনার কথা যখন উঠল, তখন দু’জনের কারওরই পরিচিত মহলে পরামর্শের তেমন অভাব ঘটল না। সহকর্মী, বন্ধুবান্ধবরা, পাশের বাড়ির দাদা থেকে পাড়াতুতো মাসিমা —অনেকেই অতি উৎসাহে উপদেষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। কিন্তু সমস্যা হল পয়েন্টগুলো নোট করার সময়। দেখা গেল, এঁদের একজনের পরামর্শও অন্য জনের সঙ্গে মিলছে না। ফলে কারটা যে ঠিক, আর কোনটা বেঠিক, সেটা বোঝা সাত জন্মে শেয়ারে উৎসাহ না নেওয়া কৃষ্ণেন্দু-রিনার কাছে নিতান্তই অসম্ভব ঠেকল। কিন্তু হাল ছাড়ার প্রশ্ন নেই। পরিশ্রম, পড়াশোনা, লেগে থাকা, জেদ —এ সব ছাড়া যে অন্য অনেক কিছুর মতো লগ্নির পথেও যে সাফল্য আসবে না, তা বিলক্ষণ জানেন কৃষ্ণেন্দু-রিনা। তাই এ ক্ষেত্রেও উঠেপড়ে লাগলেন তাঁরা।

শুভস্য শীঘ্রম

এত দিনে দু’জনের কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে, শেয়ারে বিনিয়োগ না করলে যেমন মূল্যস্ফীতির দৈত্যের কাছে হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা, তেমনই বিনিয়োগ ভুল হলে রোজগারের টাকা এমনিই উবে যাবে। সুতরাং? ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি, খবরের কাগজের পাতা ওল্টানো, পড়াশোনার পথই স্থির হল। দু’জনেরই সময়ের অভাব, কিন্তু ঠিক হয়েছে পয়লা বৈশাখের শপিংয়ের টাকাটা লাগানো হবে শেয়ারেই। বিয়ের অজস্র কেনাকাটার পর আর কিছু কেনার ইচ্ছে বা প্রয়োজন কোনওটাই যেহেতু নেই। শুভস্য শীঘ্রম। কিন্তু এগোনো যায় কী ভাবে? কোথা থেকে?

নীতিবাক্য অক্ষরে অক্ষরে

ধনকুবের ওয়ারেন বাফেকে বিশ্বের সফলতম শেয়ার বাজার বিনিয়োগকারী হিসেবে মনে করা হয়। এদিক-ওদিক পড়াশোনা আর নেট ঘাঁটতে গিয়ে তাঁর কয়েকটি নীতিবাক্য খুবই বাস্তবসম্মত মনে হল চিকিৎসক কৃষ্ণেন্দুর—

• শেয়ার বাজারকে নিজের থেকে দূরে রাখুন (টার্ন অফ দ্য স্টক মার্কেট)!

• অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা করার কোনও মানে নেই।

• নিজেকে সংস্থার বাণিজ্যের মালিক ভাবুন, শেয়ারের নয়।

• বিভিন্ন ব্যবসার পোর্টফোলিও সাজান।

‘এগুলোর মানে কী?’ —শুনেই রিনার প্রথম প্রশ্ন। এ বার কৃষ্ণেন্দু বসল তাঁকে বোঝাতে। আর বোঝানোর সময় দেখল, নিজের কাছে কিছুক্ষণ আগে পড়া বাফের কথাগুলো আরও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

শেয়ার বাজারকে নিজের থেকে দূরে রাখুন: অর্থাৎ একবার শেয়ার কেনা হয়ে গেলে শেয়ার বাজারের সুইচটি বন্ধ করে দিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাজার সেন্টিমেন্টের উপর নির্ভর করে ওঠানামা করে। নিজের পেশায় ব্যস্ত একজন মানুষের পক্ষে সেই তালে তাল মেলানো ক্ষতিকারক, অপ্রয়োজনীয়।

অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা করার অর্থ নেই: এর কারণ হল, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কী ঘটতে চলেছে তা বোঝা বা জানা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বরং এমন সংস্থার শেয়ারে লগ্নি করা ভাল যা যে কোনও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজের কাজ ঠিকঠাক করে চলে।

শেয়ারের নয়, নিজেকে সংস্থার বাণিজ্যের মালিক ভাবুন: শেয়ার বাছার সময় কয়েকটি কথা মাথায় রাখার জন্যই এ ভাবনাটা জরুরি। যেমন—

১) সংস্থাটির ব্যবসাপত্র যেন লগ্নিকারীর কাছে সরল হয়। সংস্থা কী কাজ করে, সেটাই যেখানে বোঝা যাচ্ছে না, সেখানে টাকা ঢেলে কাজ নেই।

২) সংস্থার কাজকর্ম আর লাভ-ক্ষতির ইতিহাস ভরসাযোগ্য মনে হলে তবেই তো তার মালিকানায় হাত দেওয়া যায়। শেয়ারের ক্ষেত্রেও তাই।

৩) যদি নিজে ব্যবসায় নামেন, তা হলে যে ব্যবসা লাভজনক তাতেই নিশ্চয়ই হাত লাগাবেন। তাই না? শেয়ার কেনার ক্ষেত্রেও সেটাই হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে বিচার করতেই হবে সংস্থার ম্যানেজমেন্টের নির্ভরযোগ্যতা, ব্যবসায়িক আয়, লাভযোগ্যতা, উপযুক্ত দাম ইত্যাদি।

বিভিন্ন ব্যবসার পোর্টফোলিও সাজান: মালিক হিসেবে আপনি যদি অনেকগুলো ব্যবসা কিনতেন, তা হলে নিশ্চয়ই বিভিন্ন ধরনের ক্ষেত্রকে বিচার করে বেছে নিতেন। সে ক্ষেত্রে অ্যাডহক পদ্ধতিতে যখন-তখন যা হোক একটা শেয়ার অর্থাৎ ব্যবসা নিশ্চয়ই কিনে ফেলতেন না।

অতএব...

গুণীজনের নীতিবাক্য প্রথমেই অনেকটা ভরসা জোগালো কৃষ্ণেন্দুদের। সত্যি তো! নিজেদের পেশার চাপ সামলে দিনরাত শেয়ারের বাজারদরের খবর রাখতে হলে, হয় বিনিয়োগটাই হয়ে উঠবে না, আর তা না-হলে ক্ষতি হবে পেশার। তা হলে এখন এমন শেয়ার বার করতে হবে, যার ব্যবসাটা বুঝবেন চিকিৎসক কৃষ্ণেন্দু আর বিজ্ঞানের শিক্ষিকা রিনা। যা এতটাই নির্ভরযোগ্য হবে যে, দেশ বা বিশ্ব অর্থনীতি কোনও কারণে মন্দায় পড়লেও ওই শেয়ার নিজের লাভ বজায় রাখবে, বা বলা যায় অন্তত ক্ষতির সমুদ্রে ডুববে না। অন্তত দীর্ঘ মেয়াদে। সেই সঙ্গে ভাল ভাবে দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থার আর্থিক ফলাফল, ম্যানেজমেন্টের ইতিবৃত্ত ইত্যাদি। তারপর নিক্তিতে মেপে করতে হবে ঝাড়াই-বাছাই। আর, একবার এই কাজটা কষ্ট করে সেরে ফেলার পর অন্তত এক বছর শেয়ার বাজারের ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না কৃষ্ণেন্দু-রিনা।

সোনার চেয়ে দামি

খাটুনি আপাতত এক বার। সব ঠিকঠাক ভাবে করতে পারলে লাভ তার অনেক গুণ বেশি। তাই সময় দিয়ে আরও একটু গবেষণা করতে আপত্তি কী? এ বার বেরলো আর এক বিশেষজ্ঞের সোনার চেয়ে দামি কিছু অভিমত, যাঁর নাম বেঞ্জামিন গ্রাহাম। বিশ্ববিখ্যাত দু’টি বই, ‘সিকিউরিটি অ্যানালিসিস’ এবং ‘ইন্টালিজেন্ট ইনভেস্টর’-এর লেখক। তিনি বলছেন—

১) বার্ষিক বিক্রয় অর্থাৎ সেল্স-এর বিচারে সংস্থাটি যেন বৃহৎ হয় (ক্ষুদ্র বা মাঝারি নয়)।

২) শিল্প সংস্থার ক্ষেত্রে ‘কারেন্ট অ্যাসেট’ (বর্তমান সম্পদ) যেন ‘কারেন্ট লায়াবিলিটি’ (বর্তমান দায়বদ্ধতা)-র অন্তত দ্বিগুণ হয়। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ যেন ‘নেট কারেন্ট অ্যাসেট’ (সংস্থার নিট বর্তমান সম্পদ)-এর থেকে বেশি না হয়। এবং পরিষেবা সংস্থার ক্ষেত্রে ‘ডেট-ইকুইটি রেশিও’ অর্থাৎ ঋণ এবং শেয়ার মূলধনের অনুপাত যেন কখনও ২-এর বেশি না হয়।

৩) গত ১০ বছরে সংস্থার শেয়ার প্রতি আয় যেন ধারাবাহিক ভাবে লাভজনক থাকে। অর্থাৎ সংস্থাটিকে অন্তত ১০ বছরের পুরনো হতেই হবে এবং অন্তত এই মাপকাঠিতে লোকসানে পড়লে চলবে না, বলেছেন গ্রাহাম।

৪) ধারাবাহিক ভাবে প্রত্যেক বছর বিনিয়োগকারীদের ‘ডিভিডেন্ড’ অর্থাৎ ব্যবসার লভ্যাংশ বিতরণ করতেই হবে (গ্রাহাম বলেছেন গত ২০ বছরে!)।

৫) তিন বছরের গড় শেয়ার প্রতি আয় (আর্নিংস পার শেয়ার বা ইপিএস) যেন প্রত্যেক বছর এক-তৃতীয়াংশ করে বাড়ে (বিগত দশ বছর ধরে)

৬) শেষ তিন বছরে শেয়ারের প্রাইস টু আর্নিং (পি ই) অর্থাৎ বাজারদর এবং শেয়ার প্রতি আয়ের অনুপাত কখনও যেন ১৫-র ওপরে না যায়।

৭) বাজারে শেয়ারটির বর্তমান দাম এবং তার শেয়ার প্রতি মোট সম্পদের অনুপাত (প্রাইস টু বুকভ্যালু বা পি বি) যেন ১.৫-এর বেশি না হয়। কোনও কোনও শিল্প ক্ষেত্রে বা সংস্থা বিশেষে ১.৫ এর ওপরে ওঠা যায়, যদি তার পি ই ১৫-র কম হয়। মনে রাখতে হবে পি ই এবং পি বি এই দুই অনুপাতকে গুণ করলে তা যেন ২২.৫ না ছাড়ায়। (অর্থাৎ মোট সম্পদ তুলনায় কম হলে চলবে, যদি আয় ততটাই বেশি থাকে)।

ধাঁধার উত্তর

তত্ত্ব-তলাশ তো হল। এ বার তথ্য জোগাড়ের পালা। বিজ্ঞানের ছাত্রী রিনা এক সময় ধাঁধার উত্তর খুঁজতে খুব ভালবাসতেন। এই ব্যাপারটা অনেকটা সে রকমই লাগছে তাঁর। কী ধরনের ব্যবসা বিশ্ব বা দেশের অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও মার খাবে না? এমন জিনিষ বা পরিষেবা, যা মানুষের অবশ্য প্রয়োজনীয় এবং যে ক্ষেত্রে খরচ ছাঁটাই করলেও তা কমে অতি সামান্য।

আমাদের দেশে খাদ্য-বস্ত্র বহুলাংশেই শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত পাবলিক লিমিটেড সংস্থা থেকে কেনা হয় না (অর্থাৎ এমন সংস্থা যার শেয়ার বাজারে ছাড়া আছে)। তবে শেয়ার বাজার নথিভুক্ত সংস্থার থেকে কিন্তু তেল, সাবান ইত্যাদি কেনা হয়। যেগুলির পোশাকি নাম ‘ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস’ (এফ এম সি জি বা ভোগ্যপণ্য)। অসুস্থতায় ওষুধ অবশ্য প্রয়োজনীয়। আর একেবারে অসুখ করে না, এমন মানুষ পাওয়া যায় না কি? যাতায়াত এবং পণ্যসামগ্রী পরিবহণ কোনও সময়ই এড়ানো সম্ভব নয়। বাস, লরি, ট্রাক চললে লাগবে তার যন্ত্রপাতি এবং টায়ার। বিদ্যুৎ ছাড়া এ যুগে জীবন অচল। সুতরাং বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সরবরাহ চলতেই থাকবে। পাশাপাশি আবার বিভিন্ন সময় ভাল-খারাপের মধ্যে দিয়ে গেলেও, সব দিক মিলিয়ে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা বন্ধ হওয়ার নয় কোনও সময়েই। অন্তত সরকারি ব্যাঙ্ক তো নয়ই। তারা যথেষ্ট ভরসাযোগ্য।

তা হলে? রিনার নোটবুকে ধাঁধার উত্তরে লেখা হয়ে গেল বেশ কয়েকটি শিল্পক্ষেত্রের নাম। ভোগ্যপণ্য, ওষুধ, পরিবহণ, যন্ত্রাংশ ও টায়ার, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও পরিষেবা এবং ব্যাঙ্কিং পরিষেবা (সরকারি)।

ধাঁধার উত্তর মেলাতে কৃষ্ণেন্দু আবার নেট ঘেঁটে জোগাড় করে আনলেন কিছু শিল্প ক্ষেত্র ও সংস্থার আয়-ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য। প্রাথমিক ভাবে মিলে গেল রিনার পর্যবেক্ষণ। এই শিল্প ক্ষেত্রগুলির ‘ইন্ডাস্ট্রি পি ই’ (একটি শিল্পের অন্তর্গত সব সংস্থার গড় পি ই) মোটামুটি ভাবে ১৫-র নীচে। সুতরাং ভুল হচ্ছে না। এ পথে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

কৃষ্ণেন্দু আবার নিয়ে এসেছে বিভিন্ন সংস্থার তথ্য। পরের ধাপে খোলা হল সেগুলি। এক্সেল শিটে। এ বার শুরু ঝাড়াই বাছাই পর্ব।

পর্ব এক: বাছাই করা হল রিনার পছন্দ করা শিল্প ক্ষেত্রগুলিকে।

পর্ব দুই: গ্রাহামের তত্ত্ব অনুযায়ী, ওই সব সংস্থার তথ্যের ওপর আরও কয়েকটি ফিল্টার করা হল— পি ই ১৫ বা তার কম। পি বি ১.৫ বা তার বেশি। এই দুই বাছাইয়েই দেখা গেল সংস্থার বিশাল তালিকা কিছুটা নাগালের মধ্যে চলে এসেছে।

পর্ব তিন: এখনই গত ১০ বা ২০ বছরের তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই ইপিএস-এর ক্ষেত্রে প্রথমে ফিল্টার করা হল ১ বা তার বেশি থাকা সংস্থাগুলিকে। এর মানে যে সব সংস্থা লোকসানে নেই সেগুলিকে। দেখা গেল তালিকা অনেকটা লম্বা। তাই লাভের অঙ্ক বেশি, এমন সংস্থাকে রাখতে বাড়ানো হল ইপিএস। করা হল ১০ বা তার বেশি।

এই পর্বে বাছাই ব্যাপারটা খুব আকর্ষণীয় ও উৎসাহব্যঞ্জক লাগতে শুরু করল কৃষ্ণেন্দু, রিনার। দেখা গেল অনেক নামকরা সংস্থারই ইপিএস ২০০ টাকার বেশি। এই তালিকায় উঠে এল, কৃষ্ণেন্দুর বাবা যে ব্যাঙ্কে বরাবর টাকা রেখে এসেছেন এবং কৃষ্ণেন্দুকেও খুলিয়েছেন তাঁর প্রথম অ্যাকাউন্ট, তার নাম। রিনা যে সংস্থার শ্যাম্পু ব্যবহার করেন গত দশ বছর। কৃষ্ণেন্দু যাদের ওষুধের নাম প্রেসক্রিপশনে সব চেয়ে বেশি বার লিখেছেন এবং যে সংস্থার ওষুধ ছোটবেলা থেকে বহুবার খেয়েছেন, তাদের নাম। বহুগুণ বেড়ে গেল আত্মবিশ্বাস। গ্রাহাম ঠিকই বলেছেন। এখন এই তালিকায় শুধু চোখ বুলিয়েই বলে দেওয়া যায় কার ইতিহাস দশ বছরের বেশি পুরনো।

পর্ব চার: এ বার তালিকা যে মাপে পৌঁছেছে, তাতে পরবর্তী ঝাড়াই-বাছাই অনেকটাই হাতের মধ্যে। এক শনি-রবিবার অন্য কোনও কাজ না রেখে খুলে দেখা হবে পছন্দসই সংস্থাগুলির ওয়েবসাইট। এতক্ষণে নিজেদের কিন্তু সত্যিই ব্যবসার হবু ক্রেতা বলে মনে হচ্ছে তাঁদের। উত্তেজনাও বাড়ছে। কৃষ্ণেন্দুর হাতে পুরো সময়টা খালি না থাকলেও কাজটা রিনা মনের আনন্দে করে ফেলতে পারেন।

সংস্থার ওয়েবসাইট খুলে দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই রিনা বুঝে ফেললেন, কার লাভের তথ্য সন্দেহজনক, আর কারটা বেশ সোজাসাপ্টা, স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য। ওয়েবসাইটের ‘অ্যাবাউট’ অংশে ঢুকে সংস্থার মালিকদের চিনে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন রিনা। একটি সংস্থাকে বাতিল করা হল শুধুমাত্র বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্যদের পছন্দ হল না বলে। যদিও বাজারে তাদের তৈরি তেল প্রচুর বিক্রি হয়। খুব ভুল করেননি রিনা। বিক্রি এক ব্যাপার। আর বিনিয়োগকারীদের ভাল লাভ দেওয়া সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।

‘ডিভিডেন্ড’ অর্থাৎ লভ্যাংশ প্রতি বছর কোন সংস্থা কেমন দিয়ে আসছে, অনেকের ওয়েবসাইটেই তার তথ্য পাওয়া গেল ঠিকঠাক। কুড়ি বছর না হলেও ৫-৭ বছরের ইতিবৃত্ত তো ভাল ভাবেই জানা গেল। এর ভিত্তিতে বাছাই হল এই পর্বের তালিকা।

পর্ব পাঁচ: এ বার বাছাই তালিকায় থাকা সংস্থাগুলির ঋণের পরিমাণ যাচাই করার পালা। কোথাও ডেট-ইকুইটি রেশিও (যা দিয়ে মাপা যায় সংস্থার শেয়ার প্রতি ঋণ), কোথাও কারেন্ট রেশিও (সম্পদ বনাম দায়বদ্ধতা), কোথাও বা কৃষ্ণেন্দুর অ্যানালিস্ট বন্ধুর পরামর্শে ইন্টারেস্ট কভারেজ রেশিও (সংস্থার হাতে প্রদেয় সুদের কত গুণ নগদ আছে) দেখে নেওয়া হল। যেমন, একটি সংস্থা খতিয়ে দেখতে গিয়ে রিনা দেখলেন, সংস্থাটি যে সুদ দেয়, নগদের পরিমাণ তার ১০০ গুণেরও বেশি। রিনা নিশ্চিন্ত। এ রকমই তো চাই!

পর্ব ছয়: বাছাই মোটামুটি শেষের দিকে। এ বার সাজিয়ে নেওয়ার পালা তালিকাটি। শেষ পর্বে চাই ঝুঁকি এবং বাজেটের মধ্যে মেলবন্ধন। যিনি তথ্য জুগিয়ে প্রথম থেকে সাহায্য করে আসছেন, সেই অ্যানালিস্ট বন্ধু শিখিয়ে দিলেন কী ভাবে ‘বেটা’ নামক অঙ্কের মাধ্যমে ঝুঁকি মাপতে হয়।

তিনি বললেন যে, বেটা ‘শূন্য’ মানে ঝুঁকি শূন্য। এই ক্ষেত্রে রিটার্ন পূর্বনির্ধারিত এবং অল্প। একটু একটু করে বাড়াতে বাড়াতে যদি কেউ বেটা ‘১’ পরিমাণ ঝুঁকি নিতে পারেন, তা হলে পৌঁছে যাবেন শেয়ার বাজারে। এখানে গড় বেটা ‘১’ ধরা হয়। বিভিন্ন সংস্থার বেটা, ‘১’-এর কম, ‘১’ বা তার বেশি হতে পারে। যদি আলাদা আলাদা সংস্থার শেয়ার কেনা হয়, তা হলে সব মিলিয়ে গড় বেটা হিসাব করতে হবে। মোট যতগুলি শেয়ার কেনা হয়, তাদের একসঙ্গে বলা হয় পোর্টফোলিও। যদি কোনও শেয়ারের পোর্টফোলিওর গড় বেটা হয় ‘১’, তবে সেটিকে বলা যাবে আদর্শ ব্যালান্সড পোর্টফোলিও। অর্থাৎ যেখানে ঝুঁকি এবং লাভের মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য বজায় রাখা হয়েছে।

সেই অনুযায়ীই তালিকায় রাখা হল বাছাই শেষে প্রতিটি সংস্থার পাঁচ বছরের গড় বেটা। এ বার বাজেট অনুযায়ী বসানো হল কী পরিমাণ শেয়ার কেনা হবে। পাওয়া গেল ‘ওয়েটেড অ্যাভারেজ পোর্টফোলিও বেটা’। এর মানে হল মোট যতগুলি শেয়ার কেনা হচ্ছে অর্থাৎ যে পোর্টফোলিও তৈরি হয়েছে তার গড় বেটা। আশ্চর্য, দেখা গেল তা দাঁড়িয়েছে ১-এর সামান্য কম। অর্থাৎ ঝুঁকি বরং সামান্য কমই।

বন্ধুটি অবশ্য তালিকাটি দেখে কৃষ্ণেন্দুদের একটা পরামর্শ দিলেন। বললেন, রিনা-কৃষ্ণেন্দুর বয়স কম। দু’জনেই রোজগার করেন। এখনও অনেক দায়িত্ব ঘাড়ে চাপেনি। কাজেই সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে কিন্তু তাঁদের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা অনেকটাই বেশি। শেয়ার বাজারে লগ্নির ক্ষেত্রে সুযোগ থাকলে যদি একটু বেশি ঝুঁকি নেওয়া যায়, তবে লাভের সম্ভাবনাও বাড়ে। কাজেই এই ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতার বিচারে গড় বেটা ‘১’-এর সামান্য বেশি রাখা উচিত।

তাঁর মতে, এ জন্য পরিকাঠামো শিল্পের আরও কিছু সংস্থার শেয়ার যোগ করলে ভাল হয়। পরিকাঠামো বলতে বোঝায় রাস্তাঘাট, ব্রিজ, হাইওয়ে ইত্যাদি তৈরি সংক্রান্ত ক্ষেত্র। যেমন ইস্পাত, সিমেন্ট ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে বন্ধুটির পরামর্শ ইস্পাতের কথা তাঁরা প্রথম ভাবুন। তার পর যদি সম্ভব হয় তা হলে সিমেন্ট (এই সব শিল্পের বাজারচলতি যে সব সংস্থার শেয়ারে বেশি লেনদেন চলে, তাদের বেটা ‘১’-এর একটু বেশি হতে দেখা যায়)।

অতএব গোড়া থেকে যে পদ্ধতিতে বাছাই পর্ব চলেছে, সেই একই পদ্ধতিতে পছন্দমতো কয়েকটি ইস্পাত সংস্থার নাম তালিকায় তোলা হল। সিমেন্ট সংস্থার ব্যাপারটা এখনই বাজেটে না পোষানোয় ভবিষ্যতের জন্য মুলতবি রইল। এ বার তাঁদের পোর্টফোলিওর গড় বিটা দাঁড়াল ১.০২।

এ বার শুধু মাঠে নামা

তার মানে বিনিয়োগের আদর্শ পোর্টফোলিও বানিয়ে ফেললেন কৃষ্ণেন্দু-রিনা? প্রথম প্রচেষ্টাতেই?

হ্যাঁ, কারণ তাঁরা ব্যকরণ মেনে সংস্থা বেছেছেন এবং প্রত্যেক শেয়ারে মোটামুটি কাছাকাছি বাজেট (তহবিল) রেখেছেন।

তালিকা প্রস্তুত। এ বার বিনিয়োগের পালা। কৃষ্ণেন্দু এখন অতি উৎসাহে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁদের তৈরি পোর্টফোলিওর মালিক হতে চাইছেন। কারণ গুণীজন এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে, এই পোর্টফোলিও-ই বাণিজ্যে পা রাখার প্রথম ধাপ কৃষ্ণেন্দু-রিনার কাছে।

কিন্তু মুশকিল! এত তাড়াতাড়ি কৃষ্ণেন্দুর ওয়ারেন বাফে হতে চাওয়ার পথে বাদ সাধলেন রিনা স্বয়ং। দোকানে ডিসকাউন্ট-এর বোর্ড দেখে তবে জামাকাপড় বা অন্য জিনিসপত্র কেনা তাঁর বরাবরের অভ্যাস। সুতরাং ঠিক হল, বাজারের ওঠা-নামা দেখে, দাম বুঝে একটা-একটা করে শেয়ার কেনা হবে। কৃষ্ণেন্দু নিশ্চিন্ত হয়ে এই দায়িত্বটা বউয়ের কাঁধেই ফেলে নিজের কাজে ডুব দিলেন।

রিনা জানেন, শেয়ার বাজারের ব্যাপারে এখন আপাতত আর মাথাই ঘামাতে দেখা যাবে না তাঁর ঘরের ওয়ারেন বাফেকে। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে নেমে পড়ার পর এই কাজটা তাঁর নিজেরই এত ভাল লেগে গিয়েছে যে, তা করতে এক ফোঁটাও আপত্তির আর প্রশ্ন নেই। তা ছাড়া, এত দিন নাড়াচাড়া করতে করতে এই ব্যাপারে তাঁর আত্মবিশ্বাসও এখন তুঙ্গে।

লেখক শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bishoy ashoy aditi dey nandi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE