Around 24 thousand companies shutting down in 2025 amid corporate bankruptcy hits a decade high in Germany dgtl
Germany Bankruptcy
বছর শেষের আগেই ২৪০০০ সংস্থায় তালা! বাড়ছে বেকারত্ব, হিটলারের দেশের শিল্পক্ষেত্রে কেন জ্বলছে লালবাতি?
জার্মানির শিল্পক্ষেত্রে শনির দশা! বছর শেষ হওয়ার আগেই ছোট ও বড় মিলিয়ে মোট ২৪ হাজারের বেশি সংস্থায় জ্বলতে চলেছে লালবাতি। কেন হঠাৎ দেউলিয়া দশায় পড়ল বার্লিনের অর্থনীতি?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:৫৩
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
মহামন্দার খাদে পড়ে খাবি খাচ্ছে জার্মানি! লালবাতি জ্বলায় একের পর এক ছোট ও মাঝারি সংস্থায় পড়ে গিয়েছে তালা। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বেকারত্বের হার। বছর শেষে এই সংক্রান্ত সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই চোখ কপালে উঠেছে আমজনতা থেকে শুরু করে তাবড় শিল্পপতিদের। পরিস্থিতির বদল না হলে বার্লিনের আর্থিক বৃদ্ধির সূচক থমকে যেতে পারে বলেও মনে করছেন তাঁরা। জার্মানদের কেন এমন দেউলিয়া দশা? জবাব খুঁজছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরাও।
০২১৮
চলতি বছরের ১২ ডিসেম্বর ঘরোয়া শিল্পসংস্থাগুলির উপর করা সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করে বার্লিনের বণিকসভা ‘জার্মান চেম্বারস অফ ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কমার্স’। সেখানে বলা হয়েছে, গত তিন বছরের মধ্যে ২০২৫ সালে জার্মান অর্থনীতিতে দেখা গিয়েছে মন্দার সর্বাধিক প্রভাব। সেই ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক ছোট এবং মাঝারি শিল্পসংস্থা। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো বার্লিনের পক্ষে বেশ কঠিন বলেই মনে করছে ওই বণিকসভা।
০৩১৮
বিষয়টি নিয়ে সংবাদসংস্থা ‘রয়টার্স’-এর কাছে মুখ খুলেছেন ‘জার্মান চেম্বারস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র চিফ অ্যানালিস্ট ভলকার ট্রেয়ার। তাঁর কথায়, ‘‘দেউলিয়ার ঢেউ অব্যাহত রয়েছে। ফলে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি বিপদের মুখে পড়েছে।’’ সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০ জনের কম কর্মচারী-সহ প্রতি তিনটি সংস্থার মধ্যে একটি ব্যবসায়িক দিক থেকে ধুঁকছে। যে কোনও মুহূর্তে সেগুলি বন্ধ হতে পারে।
০৪১৮
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, জার্মানির মোট ব্যবসার ৮৫ শতাংশ জুড়ে আছে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের পণ্য। বার্লিনের পরিসংখ্যান দফতর জানিয়েছে, এ বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ ১৮ হাজার ১২৫টি কর্পোরেট সংস্থা তাদের দেউলিয়া ঘোষণার জন্য স্থানীয় আদালতে মামলা দায়ের করেছে। সংখ্যাটা গত বছরের (পড়ুন ২০২৪ সাল) তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। শুধু তা-ই নয়, ২০১৪ সালের পর ২০২৫ সালের প্রথম তিনটি ত্রৈমাসিকে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) দেউলিয়া হওয়া সংস্থার সংখ্যা সর্বোচ্চ।
০৫১৮
এ ব্যাপারে ‘হ্যালে ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চ’-এর সদস্য স্টিফেন মুলার বলেছেন, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাচ্ছে। ফলে কর্পোরেট সংস্থাগুলির বাইরেও এর ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপ ফুটে উঠছে। এর ফলে ছোট ব্যবসার অসামঞ্জস্য ঝুঁকি গবেষকদের অবাক করছে না।’’ ২০২৫ সালে জার্মানিতে দেউলিয়া বাসিন্দাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোক্তাদের এ-হেন দুরবস্থা এর আগে লক্ষ করা যায়নি।
০৬১৮
জার্মান সরকারের পরিসংখ্যান দফতর জানিয়েছে, এ বছরের প্রথম তিন ত্রৈমাসিকে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) ভোক্তা দেউলিয়ার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৮২৪। বছর থেকে বছরের হিসাবে এতে আট শতাংশের বৃদ্ধি লক্ষ করা গিয়েছে। ছোট ও মাঝারি সংস্থাগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১.৭০ লক্ষ পদ বিলুপ্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে, যেটা কোভিড অতিমারি আসার আগের তুলনায় অনেকটাই বেশি।
০৭১৮
মুলারের অনুমান, এ বছর চাকরি হারানো কর্মীর সংখ্যা দু’লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে, যেটা ২০২০ সালে কোভিড অতিমারি শুরু হওয়ার আগের বছরগুলির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কোলনের ‘জার্মান ইকোনমিক ইনস্টিটিউট’-এর সদস্য ক্লাউস-হাইনার রোহল জানিয়েছেন, বেকারত্বের এই মাত্রাতিরিক্ত হার সমাজজীবনে, বিশেষত ঘরোয়া রাজনীতিতে সর্বাধিক প্রভাব ফেলতে পারে। এটা চরমপন্থী ডানপন্থী দলের উত্থানকে তরান্বিত করবে।
০৮১৮
জার্মান অর্থনীতির এ-হেন দুরবস্থার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, কোভিত অতিমারির সময় থেকেই ইউরোপীয় দেশটির বৃদ্ধির সূচক ঝিমিয়ে পড়ে। সেখান থেকে বার্লিন কখনওই বেরিয়ে আসতে পারেনি। ঘরোয়া উৎপাদন কমতে থাকায় পরবর্তী বছরগুলিতে জার্মান শিল্পসংস্থাগুলি ঋণের উপর ঋণ নিতে শুরু করে। তাদের এ-হেন বেপরোয়া মনোভাবে প্রচ্ছন্ন মদত ছিল সরকারের। বর্তমানে যার কুফল বেআব্রু হয়ে গিয়েছে।
০৯১৮
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে খোলাখুলি ভাবে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা করে জার্মানি। পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো মস্কোর উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় বার্লিনও। কিন্তু এর ফল হয়েছে হিতে বিপরীত। এত দিন ক্রেমলিনের থেকে সস্তা দরে বিপুল পরিমাণে খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস কিনতে পারছিল জার্মানি। নিষেধাজ্ঞার জেরে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে পশ্চিম এশিয়ার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হতে হয়েছে তাকে।
১০১৮
খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই জ্বালানি সঙ্কটে ভুগছে জার্মানি। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। এর জেরে শিল্পসংস্থাগুলির খরচ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। অন্য দিকে বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে গিয়ে জিনিসের দাম সে ভাবে বাড়াতে পারেনি বার্লিন। ফলে শিল্পসংস্থাগুলিতে বাড়তে থাকে লোকসানের অঙ্ক।
১১১৮
আর্থিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শিল্পসমৃদ্ধ জার্মানির চাহিদা মেটাতে বেশি করে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র খোলা উচিত ছিল। কিন্তু, ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা পরমাণুকেন্দ্রে দুর্ঘটনার পর সম্পূর্ণ উল্টো রাস্তায় হাঁটা শুরু করে বার্লিন। ওই সময় পরিবেশবিদদের আন্দোলন তীব্র হলে আণবিক বিদ্যুৎচুল্লি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। জার্মান সরকারের এ-হেন পদক্ষেপ ছিল নিজের পায়ে কুড়ুল মারার শামিল।
১২১৮
ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর থেকেই ধীরে ধীরে দেশের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিকে বন্ধ করতে থাকে বার্লিন। ২০২৩ সালে পৌঁছে চূড়ান্ত পরিণতি পায় এই প্রক্রিয়া। ওই বছর সর্বশেষ তিনটি আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয় জার্মান সরকার। ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা এবং খরচ কী ভাবে মেটানো হবে, তা অবশ্য ওই সময় চিন্তা করা হয়নি।
১৩১৮
চলতি বছরের এপ্রিলে জার্মানি থেকে আমদানি করা গাড়ির উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বার্লিনের জন্য এই ঘোষণা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। এত দিন জার্মানির গাড়িশিল্পের অন্যতম বাজার ছিল আমেরিকা। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কনীতির জন্য মার খায় সেখানকার ব্যবসা। সেই আর্থিক ধাক্কা সামলানো ছোট এবং মাঝারি শিল্পের পক্ষে একেবারেই সম্ভব হয়নি।
১৪১৮
তা ছাড়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই গত পৌনে চার বছরে সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের ভয়ে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বাড়িয়েছে জার্মান সরকার। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের থেকে হাতিয়ার কিনে তা কিভে সরবরাহ করতে দেখা গিয়েছে বার্লিনকে। সরকারের এই ধরনের সিদ্ধান্ত যে কোষাগারের উপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে, তা বলাই বাহুল্য।
১৫১৮
জার্মান অর্থনীতি খারাপ হওয়ার নেপথ্যে আর একটি কারণ হল চিন। গত কয়েক বছরে উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলিকে টেক্কা দিয়েছে বেজিং। সস্তায় পণ্য বিক্রির মাধ্যমে বিশ্বের বাজারের একটা বড় অংশই দখল করতে পেরেছে ড্রাগন সরকার। তা ছাড়া, বর্তমানে বিরল খনিজের ভান্ডারকে নিয়ন্ত্রণ করছে মান্দারিনভাষীরা। সেগুলি ছাড়া বৈদ্যুতিন গাড়ি নির্মাণ অসম্ভব।
১৬১৮
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, বার্লিনের পক্ষে কখনও চিনা ব্যবসার মডেলকে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। ফলে ব্যাপক সস্তায় পণ্য বিক্রি করে বিশ্ববাজারে নিজের জায়গা পাকা করতে ব্যর্থ হয় জার্মান শিল্পসংস্থা। বিরল খনিজের অভাব বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম উৎপাদন ক্ষেত্রে তাদের অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে।
১৭১৮
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর শেষ হতে হতে জার্মানিতে বন্ধ হবে প্রায় ২৪ হাজার শিল্পসংস্থা। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলির ঋণের মাত্রা এতটাই বেশি যে, তাদের পক্ষে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪ সাল) তুলনায় ২০২৫ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্পসংস্থার সূচক আট শতাংশ বৃদ্ধি পেল বলে জানা গিয়েছে।
১৮১৮
অর্থনীতিবিদ মুলার জানিয়েছেন, বর্তমানে রেড জ়োনে ঢুকে পড়েছে জার্মানি। ফলে বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলির আরও বেশি করে দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। এর পরিমাণ গত দু’দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। জার্মান শুল্ক, চিনা প্রতিযোগিতা এবং উচ্চ জ্বালানি খরচ বার্লিনকে পরিকাঠামোগত ভাবেও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে চ্যান্সেলার ফ্রিডরিখ মের্ৎজ় কী ব্যবস্থা নেন, সেটাই এখন দেখার।