China allegedly brainwashes Uyghurs in prison camps, know the reason dgtl
Uyghurs Crisis in China
জোর করে ধর্মান্তরণ, মগজধোলাই! সস্তায় পণ্য উৎপাদন করতে বুটের নীচে রেখে উইঘুরদের পরিচয় ভোলাচ্ছে চিন
উইঘুর মুসলিমদের উপর চিনের কমিউনিস্ট সরকারের নির্মম অত্যাচারের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। সস্তায় পণ্য উৎপাদন করতে তাঁদের দাস হিসাবে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে বেজিঙের বিরুদ্ধে।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২৫ ০৭:৫৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
জোর করে ক্যাম্পে আটকে রাখা। স্বাধীন ভাবে ধর্মাচরণে বাধা দেওয়া। কিংবা খাদ্যাভাস আমূল বদলে দেওয়ার চেষ্টা। দশকের পর দশক ধরে চিনের কমিউনিস্ট সরকারের ‘অত্যাচার’ সহ্য করতে হচ্ছে শিনজিয়ান প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের। বেজিঙের বিরুদ্ধে উঠেছে গণহত্যারও অভিযোগ। কিন্তু, কেন উইঘুরদের জুতোয় তলায় রাখতে চায় ড্রাগন? নেপথ্যে রয়েছে কোন চালবাজি? সময়ের চাকা ঘুরতেই ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর।
০২১৮
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুনিয়ার বাজার দখল করতে দীর্ঘ দিন ধরে সস্তা দরে পণ্য বিক্রি করছে চিন। এই ব্যবস্থা চালু রাখতে সুনির্দিষ্ট একটি পন্থা অনুসরণ করে চলে ড্রাগন সরকার। সেটা হল, শ্রমশক্তির জন্য ন্যূনতম ব্যয়। অর্থাৎ, পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের পিছনে সে ভাবে খরচ করে না বেজিং।
০৩১৮
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এই কারণে উইঘুর মুসলিমদের আরও বেশি করে প্রয়োজন চিনা সরকারের। বছরের পর বছর ধরে নামমাত্র অর্থে কারখানাগুলিতে তাঁদের কাজ করতে বাধ্য করছে বেজিং। এর জন্য ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পান না তাঁরা। উল্টে প্রতিবাদ করলেই ‘পুনঃশিক্ষা’ শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের। সেখানে ভয়ঙ্কর বন্দিজীবন কাটাতে হয় উইঘুরদের।
০৪১৮
২০১৮ সালে চিনের শিনজিয়ান প্রদেশের এই বিশেষ মুসলিম সম্প্রদায়কে নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে রাষ্ট্রপুঞ্জ। তার ছত্রে ছত্রে ছিল উইঘুরদের উপর বেজিঙের নির্মম অত্যাচারের কাহিনি। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, কমপক্ষে ১০ লক্ষ মানুষকে বিভিন্ন শিবিরে আটকে রেখেছে বেজিঙের কমিউনিস্ট সরকার। এই তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর দুনিয়া জুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল।
০৫১৮
রাষ্ট্রপুঞ্জের দাবি, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি দু’লক্ষ উইঘুরকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা দানের কথা বলে জোরপূর্বক ‘পুনঃশিক্ষা’ শিবিরে পাঠান চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা বিবিসির দাবি, শুধু আটকে রাখা নয়, সেখানে গণহারে তাঁদের ধর্মান্তরণ করে ড্রাগন সরকার। যদিও এই রিপোর্টকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছে বেজিং।
০৬১৮
চিনের উইঘুর মুসলিমদের দুরবস্থা নিয়ে একটি নথি ফাঁস করে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস’ বা আইসিআইজে নামের সংস্থা। বিবিসি প্যানোরামা এবং দ্য গার্ডিয়ান-সহ বিশ্বের নামীদামি ১৭টি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁদের। ফাঁস হওয়া নথির মাধ্যমে শিনজিয়ানের উইঘুরদের বন্দি শিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নিরাপত্তা আধিকারিকদের কাছে পাঠানো চিনা কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিসির (কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না) ডেপুটি সেক্রেটারির নির্দেশাবলি প্রকাশ্যে চলে আসে।
০৭১৮
ওই সময়ে সিপিসির ডেপুটি সেক্রেটারি পদে ছিলেন ঝু হাইলুন। ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, ‘পুনঃশিক্ষা’ শিবিরগুলিতে কঠোর নিয়মকানুন চালু রাখার নির্দেশ দেন তিনি। মোট ন’টি বিষয়ের উপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয় ওই নথিতে। তার প্রথমেই ছিল, উইঘুররা যেন কোনও ভাবেই শিবির থেকে পালাতে না পারেন।
০৮১৮
এর পাশাপাশি ফাঁস হওয়া নথিতে আরও কিছু বিষয়ের উপর জোর দেওয়ার নির্দেশ ছিল। তার মধ্যে অন্যতম হল মান্দারিন ভাষার শিক্ষা। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, উইঘুররা যাতে অন্য কোনও ভাষায় কথা না বলেন, সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলে চিন। তাঁদের খাদ্যাভাস, ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে মুছে ফেলতে উদ্যত জিনপিং সরকার।
০৯১৮
রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট এবং আইসিআইজের ফাঁস করা নথি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন মানবাধিকার কর্মী সোফি রিচার্ডসন। তাঁর কথায়, ‘‘যেটুকু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, তা আন্তর্জাতিক ভাবে চিনকে কোণঠাসা করার পক্ষে যথেষ্ট। তবে এ ব্যাপারে সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে।’’ এই ইস্যুতে রাষ্ট্রপুঞ্জের অবিলম্বে পদক্ষেপ করা উচিত বলেও দাবি করেন তিনি।
১০১৮
প্রায় একই সুর শোনা গিয়েছে বিশ্ব উইঘুর সম্মেলনের উপদেষ্টা তথা আইনজীবী বেন এমারসন কিউসির গলায়। তিনি বলেছেন, ‘‘শিনজিয়ান প্রদেশে একের পর এক মসজিদ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন অফ আর্মি’ বা পিএলএ। তাদের শিবিরগুলিতে পরিকল্পিত ভাবে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মগজধোলাই চলছে। আর সেখানে নির্যাতনের সমস্ত সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে বেজিং।’’
১১১৮
গত শতাব্দীর ’৯০-এর দশকের শেষ দিকে চিনের কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে উইঘুরদের বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ওই সময়ে প্রতিবাদীদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে পিএলএ। ১৯৯৭ সালে কাজ়াখস্তান সীমান্তবর্তী এলাকায় ঘটে ওই ঘটনা। উইঘুররা একে গুলজ়া গণহত্যা বলেছিল। এর পর আর কখনওই কোনও বিদ্রোহ সে ভাবে দানা বেঁধে ওঠেনি। তবে পরবর্তী দশকগুলিতে চিন ছেড়ে অনেকেই বিশ্বের অন্যান্য দেশে পালিয়ে গিয়েছেন।
১২১৮
বেজিঙের দেওয়া সরকারি তথ্য অনুযায়ী, শিনজিয়ানের জনসংখ্যার অর্ধেকই উইঘুর মুসলিম। গত ৪০ বছরে তাদের জনসংখ্যা ৫৫ লক্ষ থেকে বেড়ে ১.২ কোটিতে পৌঁছে গিয়েছে। ১৯৫৩ সালের জনগণনায় বলা হয়, কাশগড় শহরের ৯৭ শতাংশ মানুষই উইঘুর সম্প্রদায়ভুক্ত। আর হোতানের সাত লক্ষ মানুষের মধ্যে ৯৯ শতাংশ উইঘুর। তবে চিনে এই সম্প্রদায়ের মোট কত শতাংশ মানুষ বসবাস করেন, তা স্পষ্ট নয়।
১৩১৮
‘উইঘুর’দের উপর অত্যাচার নিয়ে চিনা সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট যুক্তি রয়েছে। বেজিঙের দাবি, এই সম্প্রদায়ের সকলেই চরমপন্থায় বিশ্বাসী। তার বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট সরকারকে লড়াই করতে হচ্ছে। সেই কারণেই ‘পুনঃশিক্ষা’ শিবিরগুলি খোলে রেখেছে প্রশাসন। সেখানে উইঘুরদের চিনের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে ভাল মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে।
১৪১৮
যদিও ড্রাগন সরকারের এই যুক্তি মানতে নারাজ বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, উইঘুরদের দাস হিসাবে ব্যবহার করে বেজিং। ফলে নামমাত্র খরচে পণ্য উৎপাদন করে বিশ্ব জুড়ে ব্যবসা করতে পারছে চিন। সস্তায় পছন্দের সামগ্রী হাতে চলে আসায় তাদের এই নীতির বিরুদ্ধে রা কাটছে না আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া।
১৫১৮
সরকারি ভাবে এই ইস্যুতে কখনও কড়া প্রতিক্রিয়া দেয়নি ভারতও। কারণ, চিনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাতে নিমরাজি নয়াদিল্লি। তবে আন্তর্জাতিক স্তরে এ ব্যাপারে সরব রয়েছে এ দেশের বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন। এতে ঘুরপথে ড্রাগনের উপর চাপ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে কেন্দ্র।
১৬১৮
১৯৫৫ সালে শিনজিয়ানকে উইঘুরদের স্বায়ত্তশাসনে থাকা অঞ্চল বলে ঘোষণা করে চিন। তবে সেখানে হান চিনা, কাজ়াখ, কিরঘিজ়, মঙ্গোল, তাজিক, উজবেক এবং তাতার জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরাও বসবাস করেন। এলাকাটির মোট আয়তন ১৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। ড্রাগনভূমির এটি বৃহত্তম প্রদেশ হিসাবে চিহ্নিত। শিনজিয়ান প্রদেশ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ হওয়ায় বেজিঙের কমিউনিস্ট সরকারের কাছে এর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।
১৭১৮
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, উইঘুরদের বুটের নীচে রাখার এটাও একটা কারণ। শিনজিয়ান থেকে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস বিপুল পরিমাণে উত্তোলন করে থাকে চিনা সরকার। এর পুরোটাই যায় ড্রাগনভূমির কারখানাগুলিতে। এ ছাড়া ওই প্রাকৃতিক সম্পদ ভোগ করে পিএলএ। অর্থাৎ, এক কথায় ‘লাভের গুড়’ পুরোটাই পান সিপিসির নেতা-নেত্রীরা। উইঘুর বিদ্রোহে সেটা যাতে ভেস্তে না যায়, তাই এই ব্যবস্থা।
১৮১৮
১৯৩৩ সালে খুব অল্প সময়ের জন্য চিনের ওই এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি চলে গিয়েছিল উইঘুরদের হাতে। পরে অবশ্য চিয়াং কাই শেকের বাহিনী সম্পূর্ণ শিনজিয়ান উদ্ধার করেন। ১৯৪৯ সালে চিয়াং কাই শেককে ক্ষমতাচ্যুত করে মাও সে তুঙের নেতৃত্বে বেজিং দখল করে কমিউনিস্ট দল। এর পর তৎকালীন সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিনের সম্মতিতে এলাকাটিকে চিনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তবে জিনপিং সরকারের সীমাহীন অত্যাচারের জেরে সেখানে নতুন করে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠার আশঙ্কা বাড়ছে বলেই মনে করে পশ্চিমি বিশ্ব।