Is Libya’s Army chief Mohamed Al-Haddad plane crash mystery death a big conspiracy of Pakistan dgtl
Pakistan Conspiracy in Libya
মরুর দেশের সেনাপ্রধানের মৃত্যু ঘিরে ঘনাচ্ছে রহস্য, টাকার লোভে খুন? ‘বন্ধু’র পিঠে ছুরি বসাল ষড়যন্ত্রী পাকিস্তান?
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় লিবিয়ার সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মহম্মদ আল-হাদ্দাদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঘনীভূত রহস্য। সে দেশের বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁকে গোপনে খুন করাল পাকিস্তান? কিন্তু কেন?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:০৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
তুরস্কের আকাশে সাহারার দেশের সেনাপ্রধানের ‘গুপ্তহত্যা’! সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হচ্ছে উত্তর আফ্রিকার রাজনীতি। ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কি পাকিস্তান? ইসলামাবাদের থেকে সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার কেনার খবর প্রকাশ্যে আসতেই তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। এই ইস্যুতে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে আঙ্কারা। ফলে দোষ প্রমাণিত হলে শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের।
০২১৮
উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া। ২০১১ সাল থেকেই গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী সাহারা মরুভূমির এই দেশ। চলতি বছরের ২৩ ডিসেম্বর রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় সেখানকার সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মহম্মদ আল-হাদ্দাদের। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় ছিলেন তিনি। সেখান থেকে দেশের ফেরার সময় আচমকা ভেঙে পড়ে তাঁর ব্যক্তিগত বিমান। এতে আল-হাদ্দাদ-সহ প্রাণ হারান আরও চার আরোহী। গোটা বিষয়টিকে দুর্ঘটনা বলে মানতে নারাজ তুর্কি প্রশাসন। ফলে দানা বেঁধেছে বিতর্ক।
০৩১৮
আল-হাদ্দাদের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানের সেনা সর্বাধিনায়ক বা সিডিএফ (চিফ অফ ডিফেন্স ফোর্স) তথা ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে নিয়ে প্রকাশ্যে আসে একটি বিস্ফোরক তথ্য। জানা যায়, হাদ্দাদের তুরস্ক সফরকালে লিবিয়ায় গিয়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে দেখা করছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের হাতে বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার ও সামরিক সরঞ্জাম তুলে দেওয়ার চুক্তিও সেরে ফেলেছে ইসলামাবাদ। এর মধ্যে রয়েছে চিনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘জেএফ-১৭ থান্ডার’ লড়াকু জেট।
০৪১৮
রয়টার্স-সহ একাধিক পশ্চিমি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট ৪০০ কোটি ডলার মূল্যের হাতিয়ার ও গোলা-বারুদ বিক্রির প্রতিরক্ষা চুক্তি ত্রিপোলির বিদ্রোহীদের সঙ্গে করেছে পাকিস্তান। সমঝোতা পর্বের একটি ছবিও প্রকাশ্যে আনে তারা। সেখানে মুনিরকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘লিবিয়া ন্যাশনাল আর্মি’র (এলএনএ) ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাদ্দাম খলিফা বেলকাশিম হাফতারের সঙ্গে করমর্দন করতে দেখা গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট চুক্তির জন্য উত্তর আফ্রিকার দেশটির বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত বেনগাজ়িতে যান তিনি। বেনগাজ়িকে রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়েছে এলএনএ।
০৫১৮
পাকিস্তানের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি। এই সমঝোতার ঠিক পড়েই আল-হাদ্দাদের জেট আঙ্কারায় ভেঙে পড়ায় ঘনীভূত হয়েছে রহস্য। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, তাঁকে ‘খুনের’ নেপথ্যে হাত রয়েছে ইসলামাবাদের গুপ্তচরবাহিনী ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআইয়ের। লিবিয়ার সেনাপ্রধানকে সরিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন মুনির।
০৬১৮
প্রথমত, উত্তর আফ্রিকার দেশটি থেকে আগামী দিনে সস্তায় খনিজ তেল আমদানি করতে পারবে পাক সরকার। দ্বিতীয়ত, এই ঘটনায় আফ্রিকায় প্রভাব বৃদ্ধির সুযোগ পাচ্ছে ইসলামাবাদ। আল-হাদ্দাদের মৃত্যুতে সাহারা মরুভূমির দেশটিতে আরও তীব্র হতে পারে গৃহযুদ্ধের আগুন। বলা বাহুল্য, তখন হাতিয়ার ও গোলা-বারুদের জন্য ত্রিপোলির বিদ্রোহীদের কাছে ‘সেরা পছন্দ’ হয়ে উঠবেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা। অস্ত্র ব্যবসার এ-হেন বিপুল লাভের হাতছানি তাই কোনও অবস্থাতেই হারাতে রাজি নন পাক ফিল্ড মার্শাল মুনির।
০৭১৮
সূত্রের খবর, বেনগাজ়িতে বিদ্রোহীদের ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ হাফতারের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পর সংশ্লিষ্ট প্রতিরক্ষা চুক্তিটি চূড়ান্ত করেন ইসলামাবাদের ‘সিপাহসালার’। এই সমঝোতা অনুযায়ী, কী কী হাতিয়ার এলএনএ যোদ্ধাদের পাকিস্তান সরবরাহ করবে, তা স্পষ্ট নয়। যদিও রয়টার্স জানিয়েছে, লড়াকু জেট ছাড়াও স্থল, আকাশ এবং নৌসেনার বেশ কিছু সামরিক সরঞ্জাম রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলদের থেকে পেতে চলেছেন তাঁরা। চুক্তিতে সই হওয়ার পর বেনগাজ়িতে এই ইস্যুতে বিবৃতি দেন মুনির।
০৮১৮
লিবিয়ার বিদ্রোহীদের রাজধানী শহরে অস্ত্রের চুক্তি সম্পন্ন হতেই ‘অপারেশন সিঁদুর’ প্রসঙ্গ তোলেন পাক ফিল্ড মার্শাল। বলেন, ‘‘বর্তমানে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ দেশীয় সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করছে ইসলামাবাদ। এর সাহায্যে মে মাসে পাক বিমানবাহিনী ভারতের রাফাল, মিরাজ়-২০০০, এসইউ-৩০ এবং মিগ-২৯-এর মতো একগুচ্ছ লড়াকু জেট ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। আমরা দিল্লির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ উড়িয়ে দিয়েছিলাম।’’
০৯১৮
লিবিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের ‘বন্ধুত্ব’ কিন্তু আজকের নয়। ১৯৬৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উত্তর আফ্রিকার দেশটির ক্ষমতা দখল করেন কর্নেল মুয়ম্মর গদ্দাফি। গত শতাব্দীর ৭০-এর দশকে লাহোরে মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সংগঠন ওআইসির (অর্গানাইজ়েশন অফ ইসলামিক কান্ট্রিজ়) বৈঠকে যোগ দিয়ে ইসলামাবাদকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির ব্যাপারে উৎসাহ দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্মসূচিতে বিপুল টাকা ঢেলেছিল ত্রিপোলি। এতে বেজায় খুশি ছিলেন তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টো।
১০১৮
১৯৭৮ সালে তৃতীয় বারের জন্য সামরিক শাসনে চলে যায় ইসলামাবাদ। ফলে প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসেন পাক সেনাপ্রধান জেনারেল মহম্মদ জিয়া উল হক। তাঁর সময়ে ত্রিপোলির সঙ্গে সম্পর্কের অনেকটা অবনতি ঘটে। বিরক্ত গদ্দাফি ইসলামাবাদের কাছে পরমাণু কর্মসূচির জন্য প্রদেয় অর্থ ফেরত চেয়ে বসেন। পাশাপাশি, নয়াদিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন তিনি। পরবর্তী বছরগুলিতেও উত্তর আফ্রিকার দেশটির সঙ্গে ইসলামাবাদের ‘মেলামেশা’ কখনওই সরলরেখায় থাকেনি।
১১১৮
এই অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে ২০১১ সালে। ওই সময় আরব বসন্তের ছোঁয়ায় হঠাৎ করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে লিবিয়া। আমজনতার বিদ্রোহে পতন হয় গদ্দাফি সরকারের। কিছু দিনের মধ্যে দু’টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায় উত্তর আফ্রিকার এই দেশ। দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয় ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হাতিয়ার আমদানিতে ত্রিপোলির উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় রাষ্ট্রপুঞ্জ। যদিও তাতে লাভ যে খুব বেশি হয়েছে, এমনটা নয়।
১২১৮
বর্তমানে রাজধানী ত্রিপোলি-সহ লিবিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ‘গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল ইউনিটি’ বা জিএনইউর। এই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। আল-হাদ্দাদ ছিলেন এই জিএনইউর সেনাপ্রধান। অন্য দিকে দেশের বাকি অংশ কব্জা করে ফেলেছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘লিবিয়া ন্যাশনাল আর্মি’ বা এলএনএ। উত্তর আফ্রিকার মরু-রাষ্ট্রটির সিংহভাগ এলাকা তাঁদের দখলে রয়েছে বলা চলে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল পর্দার আড়ালে থেকে এই বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং রাশিয়া।
১৩১৮
বিশ্বের খনিজ তেল উত্তোলনকারী দেশগুলির মধ্যে প্রথম ১০-এ রয়েছে লিবিয়ার নাম। গৃহযুদ্ধের কারণে দুই গোষ্ঠীর হাতে শাসনব্যবস্থা চলে যাওয়ায় ‘তরল সোনা’ উত্তোলন এবং তা বিক্রির পরিমাণ কমিয়েছে ত্রিপোলি। সমস্যার জায়গা হল, বিদ্রোহীদের দখলকৃত এলাকাতেই রয়েছে উত্তর আফ্রিকার দেশটির অধিকাংশ তেলের কুয়ো। বিশেষজ্ঞদের দাবি, সেই কারণেই এলএনএর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ফিল্ড মার্শাল মুনির।
১৪১৮
উল্টো দিকে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়া রাষ্ট্রপুঞ্জ স্বীকৃতি ত্রিপোলির ‘গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল ইউনিটি’-কে সমর্থন জানিয়েছে তুরস্ক। সম্প্রতি বিদ্রোহীদের ঠেকাতে তাদের হাতিয়ার সরবরাহ শুরু করে আঙ্কারা। এই পরিস্থিতিতে আরও অত্যাধুনিক অস্ত্র জোগাড় করতে আল-হাদ্দাদ সেখানে গিয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্থলবাহিনীর প্রধান (চিফ অফ স্টাফ) মেজর জেনারেল আল-ফাতুরি ঘ্রেইবেল এবং সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনকারী সংস্থার ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ আল-কাতিউই।
১৫১৮
এই দুই সঙ্গীর পাশাপাশি সেনাপ্রধানের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ আল-আসাউই দিয়াব এবং মিডিয়া অফিসের চিত্রগ্রাহক মহম্মদ ওমর আহমেদ মাহজ়ুবকে নিয়ে আঙ্কারা ছাড়েন আল-হাদ্দাদ। এলাকাবাসীদের দাবি, তাদের জেট আকাশে ওড়ার কিছু ক্ষণের মধ্যে বিকট শব্দ করে ভেঙে পড়ে। চার জনেরই মৃত্যু হয়। বিমানে অতি শক্তিশালী বোমা ছিল বলে দাবি করেছেন তাঁরা। যদিও এই নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি তুরস্ক।
১৬১৮
আঙ্কারা জানিয়েছে, ঘটনার দিন রাত ৮টা ১০ মিনিটে এগেনবোগা বিমানবন্দর থেকে ওড়ে আল-হাদ্দাদের ব্যক্তিগত জেট। প্রায় ৪২ মিনিট আকাশে ছিল সেটি। এই সময়সীমার মধ্যে জরুরি অবতরণের অনুমতি চেয়ে ককপিট থেকে বার্তা পাঠান ওই বিমানের পাইলট। কিন্তু তার পরেও শেষরক্ষা হয়নি। এ ব্যাপারে কিছু বলার আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ। এর মিনিটখানেকেরও কম সময়ে ভেঙে পড়ে আল-হাদ্দাদের জেট।
১৭১৮
লিবিয়ার সেনাপ্রধানের এই রহস্যমৃত্যুর তদন্ত শুরু করেছে তুরস্ক প্রশাসন। আঙ্কারার গোয়ান্দাকর্তাদের অনুমান, এটা কোনও সাধারণ দুর্ঘটনা নয়। কারণ, আকাশে ওড়ার আগে জেটটির রুটিন পরীক্ষা হয়েছিল। সেখানে ফিট সার্টিফিকেট পায় ওই উড়োজাহাজ। ফলে কোনও অন্তর্ঘাত বা চক্রান্ত থাকতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।
১৮১৮
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময়ে সামরিক ড্রোন পাঠিয়ে পাকিস্তানকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন করেছিল তুরস্ক। কিন্তু, সাত মাসের মধ্যেই ইসলামাবাদের গুপ্তচরবাহিনী তাদের পিঠে ছুরি বসাল বলে একরকম নিশ্চিত এ দেশের সাবেক সেনাকর্তারা। তাঁদের দাবি, লিবিয়ার অস্ত্রের বাজার ধরতে আঙ্কারাকে আন্তর্জাতিক স্তরে বিপদের মুখে ফেলতে দ্বিতীয় বার ভাবেনি পাকিস্তান। এই ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র শোধ তুলতে তুর্কি প্রশাসন শেষ পর্যন্ত কী পদক্ষেপ করে সেটাই এখন দেখার।