অভিনয় নিয়ে কেরিয়ার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে যিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁর উপর এসে পড়ে সংসারের দায়দায়িত্ব। অভিনয় নয়, সহ-পরিচালনার মাধ্যমে নিজের কেরিয়ার শুরু করেছিলেন পঙ্কজ।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৭:৪০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
অভিনয়জগতে শোকের ছায়া। প্রয়াত জনপ্রিয় অভিনেতা পঙ্কজ ধীর। ‘মহাভারত’-এর কর্ণের চরিত্রে অভিনয় করে যিনি দর্শকমনে চিরকালীন স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন, সেই অভিনেতার অকালপ্রয়াণে অভিনয়জগৎ শোকস্তব্ধ। ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যু হয় তাঁর।
০২২০
শৈশব থেকেই অভিনয় নিয়ে কেরিয়ার গড়ার স্বপ্ন ছিল পঙ্কজের। কিন্তু কখনও পরিস্থিতির চাপে, কখনও আবার অর্থাভাবের কারণে দীর্ঘ দিন সেই স্বপ্ন পূরণ করার সুযোগ পাননি তিনি। কাঁধের উপর বাবার ঋণ ছিল তাঁর। অর্থাভাবের কারণে সংসারের হাল ধরতে বলিপাড়ায় কাজ করা শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু পরে তাঁর জীবন অন্য খাতে বয়ে গিয়েছিল।
০৩২০
১৯৫৬ সালের নভেম্বর মাসে পঞ্জাবে জন্ম পঙ্কজের। তাঁর বাবা সিএল ধীর ছিলেন তৎকালীন বলিপাড়ার খ্যাতনামী পরিচালক। ‘জ়িন্দেগি’, ‘আলিঙ্গন’ এবং ‘বহু বেটি’র মতো ছবি পরিচালনা করেছিলেন সিএল ধীর। এমনকি, হিন্দি ছবিতে কাজ করবেন বলে তৎকালীন পূর্ব আফ্রিকা থেকে মুম্বইয়েও যান তিনি। চিত্রনাট্য লেখা থেকে পরিচালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি।
০৪২০
ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে ফিল্মের সেটে যেতেন পঙ্কজ। এ ভাবেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মায় তাঁর। ষাটের দশকে একটি হিন্দি ছবির পরিচালনা করছিলেন পঙ্কজের বাবা। ছবির শুটিং প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর ছয়-সাত দিনের মধ্যে শুটিং শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে ছবির কাজ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এই ছবির জন্য প্রচুর খরচ করে ফেলেছিলেন সিএল ধীর। লোকসানের ধাক্কা সামলাতে পারেননি পঙ্কজের বাবা।
০৫২০
অভিনয় নিয়ে কেরিয়ার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে যিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁর উপর এসে পড়ে সংসারের দায়দায়িত্ব। অভিনয় নয়, পরিস্থিতির চাপে সহ-পরিচালনার মাধ্যমে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন পঙ্কজ। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পরওয়ানা’ ছবিতে সহ-পরিচালনার মাধ্যমে কাজ শুরু করেন তিনি।
০৬২০
সত্তরের দশকে একাধিক হিন্দি ছবিতে সহ-পরিচালনা করতে দেখা যায় পঙ্কজকে। সহ-পরিচালনার কাজ করলেও ফিল্ম সেটে উপস্থিত থেকে অভিনয়ের খুঁটিনাটির দিকে নজর রাখতেন পঙ্কজ। ‘পুনম’, ‘সুখা’ এবং ‘মেরা সুহাগ’ নামের হিন্দি ছবিতে স্বল্পদৈর্ঘ্যের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় পঙ্কজকে। পরিচালনার ক্ষেত্রে হাতেখড়ি করতে চাইছিলেন পঙ্কজ। কিন্তু তাঁকে বাধা দেন দক্ষিণী ফিল্মজগতের স্বনামধন্য অভিনেতা কমল হাসনের প্রাক্তন স্ত্রী সারিকা।
০৭২০
১৯৭৮ সালের ঘটনা। গাড়িতে চেপে শুটিং করতে যাচ্ছিলেন সারিকা। শুটিং স্পটেই ছিলেন পঙ্কজ। তাঁকে দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে দেখা করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সারিকা। এক সাক্ষাৎকারে পঙ্কজ জানিয়েছিলেন যে, ‘তিতলি’ নামের একটি ছবিতে তাঁকে অভিনয় করার অনুরোধ করেছিলেন সারিকা। কিন্তু সারিকার প্রস্তাব শুনে ইতস্তত বোধ করছিলেন পঙ্কজ। তিনি যে পরিচালক হতে চান, সে কথা সারিকাকে জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পঙ্কজের কোনও কথা শুনতে রাজি ছিলেন না নায়িকা।
০৮২০
পঙ্কজ জানিয়েছিলেন, ‘তিতলি’ নামের ছবিতে দ্বৈতচরিত্রে অভিনয় করছিলেন সারিকা। বলি অভিনেতা রাজ বব্বরেরও সেই ছবিতে অভিনয় করার কথা ছিল। পঙ্কজকে সেই ছবির দ্বিতীয় অভিনেতা হিসাবে পছন্দ করেছিলেন সারিকা। পঙ্কজের কোনও কথা না শুনে তাঁর নামে চেক পর্যন্ত লিখে দিয়েছিলেন সারিকা। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে সেই ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
০৯২০
১৯৭৯ সালে অনীতা নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন পঙ্কজ। পেশায় পোশাক পরিকল্পক ছিলেন অনীতা। ‘বক্সার’ এবং ‘ইক্কে পে ইক্কা’র মতো ছবিতে পোশাক পরিকল্পক হিসাবে কাজ করেছিলেন তিনি। পঙ্কজ-অনীতার এক পুত্রসন্তান রয়েছে, নাম নিকিতিন।
১০২০
বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে অভিনয় নিয়েই কেরিয়ার গড়ে তুলেছেন নিকিতিন। ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’, ‘যোধা আকবর’, ‘দবং ২’, ‘হাউসফুল ৩’-এর মতো একাধিক হিন্দি ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। এ ছাড়া গুটিকতক তেলুগু ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি হিন্দি ধারাবাহিকেও অভিনয় করেন নিকিতিন। ২০১৪ সালে ক্রাতিকা সেনগর নামের এক অভিনেত্রীকে বিয়ে করেন তিনি। ২০২২ সালে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন ক্রাতিকা। মুম্বইয়ে স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূ এবং নাতনির সঙ্গে থাকতেন পঙ্কজ।
১১২০
সত্তরের দশকের শেষের দিকে ‘বেখবর’ নামের একটি ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন পঙ্কজ। এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বলি অভিনেতা অমরীশ পুরীও। ‘বেখবর’ ছবিতে অভিনয় করে পারিশ্রমিক হিসাবে ৩১ হাজার টাকা পেয়েছিলেন পঙ্কজ। একই ছবিতে অভিনয়ের জন্য পারিশ্রমিক হিসাবে ১১ হাজার টাকা পেয়েছিলেন অমরীশ। এই ছবিতে অমরীশের চেয়ে বেশি উপার্জন করলেও কেরিয়ারের দৌড়ে পঙ্কজকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন অমরীশ।
১২২০
অভিনেতা হিসাবে সফল হতে পারছিলেন না পঙ্কজ। বার বার ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল তাঁকে। শেষ পর্যন্ত কোনও উপায় না দেখে ডাবিংয়ের কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। পরিচালক বিআর চোপড়ার স্টুডিয়োয় হিন্দি ভাষায় ইংরেজি ছবির ডাবিং করা হত। সেই কাজই করতেন পঙ্কজ। বিআর চোপড়া যে ‘মহাভারত’ ধারাবাহিক তৈরি করছেন সে খবর জানতে পেরেছিলেন পঙ্কজ। ধারাবাহিকের জন্য অডিশন দিতেও গিয়েছিলেন তিনি।
১৩২০
কানাঘুষো শোনা যায়, ‘মহাভারত’ ধারাবাহিকে প্রথমে অর্জুন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব পেয়েছিলেন পঙ্কজ। যখন বিআর চোপড়ার কাছে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে তাঁকে দাড়ি-গোঁফ কাটতে হতে পারে, তখন অভিনয়ের প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিলেন পঙ্কজ। কারণ, দাড়ি-গোঁফ কাটানোয় ঘোর আপত্তি ছিল তাঁর। সে কারণে কেরিয়ারের সর্বনাশও ডেকে আনতে চলেছিলেন তিনি।
১৪২০
গুঞ্জন, অর্জুনের চরিত্রে অভিনয় করতে চান না শুনে পরিচালক আর সাধেননি পঙ্কজকে। কয়েক মাস পর অবশ্য আবার সেটে ডাক পড়েছিল পঙ্কজের। তখন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল অন্য এক চরিত্র। কর্ণের চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল পঙ্কজকে। সেই প্রস্তাব লুফে নিয়েছিলেন তিনি। তার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
১৫২০
নিজের মতো করে কর্ণের চরিত্রটিকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন পঙ্কজ। দর্শকের কাছে ভালবাসাও পেতে শুরু করেছিলেন অগাধ। এই প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাকে দর্শক এত ভালবাসা দিয়েছেন যে, পাঠ্যবইয়ে কর্ণের কথা উঠলে সেখানে কর্ণের সাজসজ্জায় আমার ছবি থাকে। এমনকি ভারতের দুই জায়গায় (হরিয়ানার কারনাল এবং ছত্তীসগঢ়ের বস্তার) যে কর্ণের মন্দির রয়েছে সেখানেও আমার শরীরী গঠনে মূর্তি তৈরি করে পুজো করা হয়।’’
১৬২০
আশির দশকে জনপ্রিয় পৌরাণিক ধারাবাহিকে অভিনয় করে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন পঙ্কজ। কিন্তু এই ধারাবাহিকের শুটিং চলাকালীন কম আঘাত সহ্য করতে হয়নি তাঁকে। শুটিংয়ের সময় রথ থেকে ঝাঁপ দিতে গিয়ে গুরুতর চোট পেয়েছিলেন তিনি। চোখের পাশে তির লেগে সেলাইও পড়েছিল তাঁর। সেই অবস্থায়ও শুটিং করেছিলেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে অভিনয়ের পাশাপাশি ছবি প্রযোজনা করতে দেখা গিয়েছিল পঙ্কজকে।
১৭২০
১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ইক্কে পে ইক্কা’ ছবির প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন পঙ্কজ। এই ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল অক্ষয় কুমারকে। বলিপাড়ার অধিকাংশের দাবি, এই ছবিতে অভিনয় করে অক্ষয় যা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন তা দিয়েই মুম্বইয়ে বাড়ি কিনেছিলেন অভিনেতা। ধীরে ধীরে পঙ্কজ এবং অক্ষয়ের মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।
১৮২০
২০১০ সালে পঙ্কজ যখন মুম্বইয়ে অভিনয় শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলেছিলেন, তখন তার উদ্ধোধন করতে উপস্থিত ছিলেন অক্ষয়। সেই প্রশিক্ষণকেন্দ্রের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন বলি অভিনেতা গূফী পেন্টল। ২০০৬ সালে ভাইয়ের সঙ্গে মুম্বইয়ে একটি স্টুডিয়োও খুলেছিলেন পঙ্কজ।
১৯২০
ছোট পর্দায় ‘কানুন’, ‘চন্দ্রকান্তা’, ‘যুগ’ এবং ‘সসুরাল সিমর কা’র মতো হিন্দি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছিলেন পঙ্কজ। চল্লিশটিরও বেশি ছবি এবং ধারাবাহিকে কাজ করেছিলেন তিনি। ২০২৪ সালে ‘ধ্রুব তারা’ নামের এক ধারাবাহিকে শেষ অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল পঙ্কজকে।
২০২০
বলিপাড়া সূত্রে খবর, দীর্ঘ দিন ধরেই ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন পঙ্কজ। তবে ধীরে ধীরে সেরেও উঠেছিলেন। কিন্তু মাস কয়েক আগে আবার তাঁর অবস্থার অবনতি হয়েছিল। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অভিনেতা। ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করতে করতেই ৬৮ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন পঙ্কজ।