‘ডুরান্ড লাইন’-এ পাক-পঠানের বারুদবর্ষণ! কেন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল দুই প্রতিবেশী? সমাধান কোন পথে?
কাবুলের বিমান হামলার প্রত্যাঘাত শানাতে ‘ডুরান্ড লাইন’-এ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়েছে আফগানিস্তানের তালিবান বাহিনী। এই সংঘাত রাতারাতি যুদ্ধে বদলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:১৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
আকাশসীমা লঙ্ঘন করে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে বোমাবর্ষণের জের। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সুদে-আসলে সেই হামলার বদলা নিতে যুদ্ধের বিউগল বাজিয়ে দিল তালিবান। পাকিস্তান সীমান্তে যে ভাবে পঠানভূমির লড়াকুরা গোলা-গুলি ছুড়েছে, তাতে আগামী দিনে পুরোদস্তুর সংঘর্ষে জড়াতে পারে দুই প্রতিবেশী। সে ক্ষেত্রে অস্থিরতায় সুযোগ নিয়ে দুনিয়ার ‘সুপার পাওয়ার’ দেশগুলি যে পর্দার আড়ালে থেকে ধীরে ধীরে সেখানে প্রবেশ করবে, তা বলাই বাহুল্য। আর তাই পশ্চিম ফ্রন্টের উপর কড়া নজর রাখছে নয়াদিল্লি।
০২১৮
চলতি বছরের ১১ অক্টোবর সীমান্তে ভারী গোলাগুলি বর্ষণের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের উপর প্রত্যাঘাত হানে আফগানিস্তানের তালিবান বাহিনী। গভীর রাত পর্যন্ত দু’পক্ষের মধ্যে চলে তীব্র সংঘর্ষ। ১২ অক্টোবর বেলা বাড়লে লড়াইয়ের পরিণাম নিয়ে প্রকাশ্যে আসে দু’রকমের তথ্য। দু’পক্ষেরই দাবি, কাঙ্খিত জয় এসে গিয়েছে। যা দেখে এ দেশের সাবেক সেনাকর্তাদের বড় অংশই মনে করছেন, এখনই এই যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম। উল্টে আক্রমণ এবং প্রতি আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াতে পারেন কাবুল এবং ইসলামাবাদের ফৌজি জেনারেলরা।
০৩১৮
১২ অক্টোবর দুপুরে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষের বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খোলেন আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী হেলমন্দ প্রদেশের প্রাদেশিক সরকারের মুখপাত্র মলাওয়ি মহম্মদ কাসিম রিয়াজ়। তাঁর কথায়, ‘‘১১ তারিখ রাতে ডুরান্ড লাইন পেরিয়ে সামরিক অভিযানের চেষ্টা চালায় ইসলামাবাদের ফৌজ। সেই আক্রমণ প্রতিহত করা গিয়েছে। আমাদের বাহিনীর পাল্টা হামলায় প্রাণ হারিয়েছে ১৫ জন পাক সেনা।’’ শুধু তা-ই নয় ‘ডুরান্ড লাইন’ সংঘর্ষে রাওয়ালপিন্ডির তিনটি ঘাঁটি তালিবান যোদ্ধারা কব্জা করতে পেরেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
০৪১৮
উল্লেখ্য, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত ‘ডুরান্ড লাইন’ দ্বারা বিভক্ত। ১৮৯৩ সালে সংশ্লিষ্ট সীমান্তটি তৈরি করে তৎকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার। যদিও পাকিস্তানের জন্মের পর এই ব্যবস্থা মানতে চায়নি আফগান প্রশাসন। ২০২১ সালে কাবুলের কুর্সিতে দ্বিতীয়বারের জন্য তালিবান এলে আরও জটিল হয় পরিস্থিতি। এ-হেন ‘ডুরান্ড লাইন’-এর উপর দুই প্রতিবেশীর সংঘর্ষের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। রিয়াজ় অবশ্য জানিয়েছেন, লড়াইয়ে দখল হওয়া পাক ঘাঁটি থেকে বহু অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত করেছে তালিবান যোদ্ধারা।
০৫১৮
অন্য দিকে ইসলামাবাদের সরকারি সংবাদমাধ্যম ‘পিটিভি নিউজ়’ জানিয়েছে, সীমান্তে আফগানিস্তানের অন্তত ১৯টি ঘাঁটি দখল করেছে পাক সেনা। সেখান থেকেই নাগাড়ে গোলাগুলি বর্ষণ করছিল তালিবান যোদ্ধারা। সূত্রের খবর, ঘাঁটিগুলিতে যত জন আফগান লড়াকু ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে হত্যা করেছে ইসলামাবাদের ফৌজ। বেগতিক দেখে প্রাণভয়ে চম্পট দেন বাকিরা। তবে মোট কত জন তালিবানি যোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এই ইস্যুতে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে কাবুলের তালিবান সরকার।
০৬১৮
‘পিটিভি নিউজ়’-এর পাশাপাশি ‘ডুরান্ড লাইন সংঘর্ষ’ নিয়ে বড় তথ্য দিয়েছে ‘রেডিয়ো পাকিস্তান’। নিরাপত্তাবাহিনীর সূত্র উল্লেখ করে ইসলামাবাদের এই গণমাধ্যমটির দাবি, আফগান তালিবানের মানোজবা ক্যাম্প ব্যাটেলিয়নের সদর দফতর, জনদুসর ঘাঁটি, তুর্কমেনজ়াই ঘাঁটি এবং খরচার দুর্গ ধ্বংস করেছে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজ। ‘রেডিয়ো পাকিস্তান’-এর কথা সত্যি হলে সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকার উপর যে কাবুলের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ হারাতে চলেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
০৭১৮
এ ছাড়া পাক সেনার একটি সূত্রকে উল্লেখ করে সংবাদসংস্থা ‘বিবিসি’ জানিয়েছে, ‘ডুরান্ড লাইন’-এর উপর অধিকাংশ সংঘর্ষই হয়েছে কুনার-কুরম এলাকায়। লড়াইয়ের সময়ে দু’পক্ষই মূলত ছোট অস্ত্র এবং কামান থেকে গোলা-গুলি ছুড়তে থাকে। যুদ্ধ পরিস্থিতি সবচেয়ে তীব্র ছিল আঙ্গুর আড্ডা, বাজ়াউর, কুররাম, দির, চিত্রাল এবং বড়মচাতে। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কুররাম জেলার জিরো পয়েন্টে মোতায়েন থাকা এক পুলিশ কর্মী বলেন, ‘‘স্থানীয় সময় রাত ১০টা নাগাদ আচমকাই হামলা শুরু করে তালিবানি বাহিনী। ফলে আমাদেরও জবাব দিতে হয়েছে।’’
০৮১৮
ইসলামাবাদের গণমাধ্যমগুলির দাবি, আফগান তালিবান যে প্রত্যাঘাত শানাবে, তা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। সেই মতো সীমান্তে বাহিনীকে প্রস্তুত রেখেছিলেন তিনি। ফলে যাবতীয় হামলা প্রতিহত করে এই সাফল্য পেয়েছে পাক ফৌজ। অন্য দিকে এই ইস্যুতে এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) একটি পোস্ট করেন ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নকভি। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘আগুন আর রক্ত নিয়ে খেলছে কাবুল। আর তাই ইটের জবাব পাথরে দেওয়া হচ্ছে।’’
০৯১৮
এ বারের পাক-আফগান সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় গত ৭ অক্টোবর। ওই দিন হিন্দুকুশের কোলের দেশটির সীমান্ত লাগোয়া খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ বা টিটিপির হামলায় প্রাণ হারান এক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও মেজর-সহ ইসলামাবাদের ১১ জন সৈনিক। ঠিক এর দু’দিনের মাথায় (পড়ুন ৯ অক্টোবর) প্রতিবেশী দেশটির রাজধানী কাবুলে ‘এয়ার স্ট্রাইক’ করে রাওয়ালপিন্ডির বিমানবাহিনী। এ ছাড়া আফগানিস্তানের পকতিকা প্রদেশেও বোমাবর্ষণ করে তাঁরা।
১০১৮
খাইবার-পাখতুনখোয়ায় সক্রিয় টিটিপিকে বহু আগেই জঙ্গি গোষ্ঠীর তকমা দিয়েছে পাক সরকার ও সেনা। ইসলামাবাদের অভিযোগ, পর্দার আড়ালে থেকে তাদের ক্রমাগত সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে কাবুলের তালিবান সরকার। অন্য দিকে ২০০৭ সালে জন্ম হওয়া টিটিপির দাবি, ইসলামীয় রাষ্ট্রের যে সমস্ত রীতিনীতি মেনে চলা উচিত, ইসলামাবাদ মোটেই তা পালন করছে না। সেই কারণেই সরকার বদলের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করে এই কট্টরপন্থী সংগঠন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, টিটিপিকে নিয়ে পাক সরকারের কোনও অভিযোগ কখনওই মানেনি আফগান তালিবান।
১১১৮
উপরন্তু, ৯ অক্টোবর ইসলামাবাদের বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে কড়া বিবৃতি দেয় কাবুল। এই ঘটনাকে সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হিসাবে উল্লেখ করে তালিবান সরকার। সূত্রের খবর, ওই দিন থেকেই সীমান্তে হাতিয়ার জড়ো করা শুরু করে তাদের যোদ্ধারা। ফলে খুব দ্রুত যে তাঁরা পাক ফৌজের উপর হামলা চালাবে, তা একরকম স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
১২১৮
৯ তারিখ অবশ্য সপ্তাহব্যাপী ভারত সফরে আসেন তালিবান শাসিত আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। নয়াদিল্লিকে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন তিনি। সেখানে এ দেশ থেকে কাবুলে সরাসরি বিমান পরিষেবা চালু করা এবং পঠানভূমির পড়ুয়াদের ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেন জয়শঙ্কর। শুধু তা-ই নয়, হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে দূতাবাস খোলার ঘোষণাও করে নয়াদিল্লি। মুত্তাকির এই সফরের মধ্যেই কাবুলে হামলা চালায় পাক বিমানবাহিনী।
১৩১৮
আর তাই কাবুল-ইসলামাবাদ সংঘর্ষের নেপথ্যে পাক সেনা ও গুপ্তচর বাহিনী ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআইয়ের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের যুক্তি, ভারত এবং আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হলে বিপদ বাড়বে ইসলামাবাদের। আর তাই মুত্তাকির সফরের মধ্যেই হিন্দুকুশের কোলের দেশটিকে যুদ্ধের ময়দানে টেনে নামানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা।
১৪১৮
এ বছরের সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করেই আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত চেয়ে বসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু তাঁর হুমকি উপেক্ষা করে এ ব্যাপারে পাল্টা হুঁশিয়ারি দেয় তালিবান সরকার। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে ‘মস্কো ফরম্যাট’-এর গোষ্ঠীভুক্ত যাবতীয় দেশ। পরে যৌথ বিবৃতিতে আমেরিকার কড়া সমালোচনা করতে দেখা যায় তাদের। এতে ভারত, রাশিয়া এবং চিনের পাশাপাশি সুরে সুর মেলাতে দেখা গিয়েছিল পাকিস্তানকেও।
১৫১৮
বিশ্লেষকদের অবশ্য দাবি, যৌথ বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করলেও ট্রাম্পের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে একপায়ে খাড়া হয়ে আছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির চাইছেন খুব দ্রুত পঠানভূমিতে পা পড়ুক মার্কিন ফৌজের। কারণ, সম্পূর্ণ ভাবে স্থলবেষ্টিত হওয়ায় সেখানে বাহিনী নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকার পাক ভূমি ব্যবহার করা ছাড়া দ্বিতীয় রাস্তা নেই। এর বিনিময়ে ‘কাবুলিওয়ালার দেশ’টিকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলদের সামনে।
১৬১৮
আর তাই সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হতে না হতেই ভারতকে নিশানা করে এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করেছেন নকভি। সেখানে পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লিখেছেন, ‘‘নয়াদিল্লির মতোই আমরা আফগানিস্তানকে উপযুক্ত জবাব দেব। তারা আর আমাদের দিকে বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে সাহস করবে না।’’ এ দিকে ভারত সফরে থাকা তালিবানের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মুত্তাকি বলেছেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার পরিণাম কী হতে পারে সেটা ব্রিটেন, রাশিয়া, আমেরিকা বা নেটো বাহিনীকে জিজ্ঞাসা করে নিতে পারে ইসলামাবাদ। তবে সমস্যা সমাধানে আলোচনা চাইলে আমরা প্রস্তুত।’’
১৭১৮
গত সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে পাকিস্তান। সেই সমঝোতার শর্ত অনুযায়ী, স্বাক্ষরকারী যে কোনও দেশের উপর তৃতীয় কোনও দেশের হামলা উভয়ের উপর হামলা হিসাবে দেখা হবে এবং উভয়েই সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করবে। যদিও এই সীমান্ত সংঘর্ষের ক্ষেত্রে দু’পক্ষকে সংযত হওয়ার বার্তা দিয়েছে রিয়াধ। ওই চুক্তির শর্ত মেনে এখনও কোনও পদক্ষেপের ইচ্ছা যে তাদের নেই, তা স্পষ্ট করেছে সংশ্লিষ্ট উপসাগরীয় দেশ।
১৮১৮
এ বছরের মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ভারতীয় সেনার হাতে মারাত্মক ভাবে মার খাওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই আফগানিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াল পাকিস্তান। বিশ্লেষকদের দাবি, এর মূল্য ইসলামাবাদকে চোকাতে হতে পারে। কারণ, কাবুলের তালিবান সরকারের ভারত, রাশিয়ার মতো দেশগুলির থেকে সাহায্য পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের কপালের ভাঁজ যে আরও চওড়া হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।