এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
সিন্ধু জল চুক্তিকে কেন্দ্র করে রণহুঙ্কারে বার বার ভারতকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে পাকিস্তান। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিমানের ঘাটতি নয়াদিল্লির কপালে ফেলেছে চিন্তার ভাঁজ। বিপদকালে অবশ্য ফের পরিত্রাতার ভূমিকায় এগিয়ে এসেছে রাশিয়া। পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির লড়াকু জেট ‘এসইউ-৫৭ই’কে এ দেশের বায়ুসেনার হাতে তুলে দিতে আগ্রহী মস্কো। ওই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ বিমানবাহিনীর বহরে শামিল হলে ইসলামাবাদের যে ঘুম উড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
০২২০
চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর চণ্ডীগড় বায়ুসেনা ঘাঁটিতে অবসর নেবে গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) তৈরি ‘মিগ-২১’ যুদ্ধবিমান। ফলে বিমানবাহিনীর লড়াকু জেটের বহর (পড়ুন স্কোয়াড্রন) কমে দাঁড়াবে ২৯। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এই সংখ্যা অন্তত ৪২ হওয়া উচিত বলে মনে করেন এ দেশের আকাশযোদ্ধারা। বর্তমান পরিস্থিতিতে লড়াকু জেটের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় উদ্বেগ বেড়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকেরও।
০৩২০
সূত্রের খবর, পাক আগ্রাসনের আশঙ্কা থাকায় জরুরি ভিত্তিতে পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির অন্তত ৪০ থেকে ৬০টি লড়াকু জেট বিদেশ থেকে আমদানি করতে পারে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। সে ক্ষেত্রে এক ধাক্কায় দুই থেকে তিন স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান হাতে পাবে ভারতীয় বিমানবাহিনী। উল্লেখ্য, সাধারণত ২০টি করে লড়াকু জেট নিয়ে তৈরি হয় একটি স্কোয়াড্রন।
০৪২০
ভারতীয় বায়ুসেনার জন্য জরুরি ভিত্তিতে যুদ্ধবিমান কেনার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হতেই তুঙ্গে ওঠে একের পর এক জল্পনা। তবে এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই দৌড়ে রয়েছে দু’টি যুদ্ধবিমান। সেগুলি হল, আমেরিকার তৈরি ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’ এবং রাশিয়ার ‘এসইউ-৫৭ ফেলন’। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে শুল্কযুদ্ধ শুরু করায় মার্কিন জেটটি নিয়ে কোনও আগ্রহ দেখাচ্ছে না কেন্দ্র।
০৫২০
‘এফ-৩৫’ যুদ্ধবিমানের থেকে মোদী সরকারের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার নেপথ্যে দ্বিতীয় কারণ হল, ট্রাম্পের পাকিস্তান প্রেম। ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা দেখাচ্ছেন তিনি। অন্য দিকে ‘এসইউ-৫৭’র ব্যাপারে বেশ কিছু ‘মেগা অফার’ দিয়েছে রাশিয়া। এ ছাড়া হাতিয়ারের ব্যাপারে দীর্ঘ দিনের ‘বিশ্বস্ততা’ নয়াদিল্লিকে মস্কোর দিকেই নিয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
০৬২০
গত মার্চে দিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে ‘এসইউ-৫৭’ লড়াকু জেটের ‘মেগা অফার’-এর ব্যাপারে মুখ খোলেন এ দেশে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত ডেনিস অলিপভ। তিনি বলেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটি নিয়ে প্রতিরক্ষা চুক্তি হলে ভারতকে প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে মস্কো।’’ শুধু তা-ই নয়, এ দেশের মাটিতে যৌথ উদ্যোগে লড়াকু জেট তৈরির ব্যাপারে ক্রেমলিনের কোনও আপত্তি নেই বলেও স্পষ্ট করেন তিনি।
০৭২০
যুদ্ধবিমান ব্যবহারের ক্ষেত্রে সোর্স কোড একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি জানা থাকলে সংশ্লিষ্ট জেটে ইচ্ছামতো হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারে বায়ুসেনা। সূত্রের খবর, ‘এসইউ-৫৭’র সোর্স কোড ‘বন্ধু’ ভারতকে দিতে রাজি আছে রাশিয়া। সে ক্ষেত্রে ঘরের মাটিতে তৈরি অস্ত্র ‘এয়ার টু এয়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র ওই যুদ্ধবিমান থেকে ছুড়তে পারবে ভারতীয় বিমানবাহিনী।
০৮২০
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির দাবি, ‘এসইউ-৫৭’ নিয়ে রাশিয়ার ‘মেগা অফার’-এর তৃতীয় লোভনীয় বিষয় হল, বিক্রির স্বাধীনতা। মস্কোর সঙ্গে যৌথ ভাবে লড়াকু জেটটি তৈরি করে ‘বন্ধু’ দেশগুলিকে বিক্রি করতে পারবে নয়াদিল্লি। এ ব্যাপারে কোনও আপত্তি করবে না ক্রেমলিন। এ দেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে এই সুযোগের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে, মানছেন সাবেক সেনাকর্তারাও।
০৯২০
‘এসইউ-৫৭’-এর পাশাপাশি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তেজস এবং অ্যামকা (অ্যাডভান্স মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট) নামের দু’টি যুদ্ধবিমান তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। কারণ ভবিষ্যতের যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি আত্মনির্ভর করে তুলতে চাইছে কেন্দ্র। কিন্তু, সমস্যার জায়গা হল লড়াকু জেটের ইঞ্জিন এখনও তৈরি করতে পারেননি এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
১০২০
বিশেষজ্ঞদের দাবি, রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘এসইউ-৫৭’ যুদ্ধবিমান তৈরি করলে সেই ব্যারিকেড টপকাতে পারবে নয়াদিল্লি। অর্থাৎ, মস্কোর লড়াকু জেটের প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ রয়েছে কেন্দ্রের সামনে। ক্রেমলিনের রাষ্ট্রদূত অলিপভ জানিয়েছেন, ভারতের মাটিতে সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটি তৈরির যথেষ্ট ভাল পরিকাঠামো রয়েছে।
১১২০
‘এসইউ-৫৭’ যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি ‘এস-৫০০’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ভারতের সঙ্গে যৌথ ভাবে তৈরিতে রাশিয়া আগ্রহী বলে জানিয়েছে একাধিক পশ্চিমি গণমাধ্যম। এ ছাড়া ‘টিইউ-১৬০’ বোমারু বিমান মস্কোর বিমানবাহিনীর থেকে লিজ়ে নিতে পারে ভারতীয় বায়ুসেনা। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কোনও খবর প্রকাশ্যে আসেনি।
১২২০
২০১৮ সালে রাশিয়ার থেকে ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) পাঁটটি ব্যাটারি কেনে ভারত। সেগুলির তিনটি ইতিমধ্যেই এ দেশের বায়ুসেনাকে সরবরাহ করেছে মস্কো। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময়ে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির পারফরম্যান্স ছিল নজরকাড়া। নয়াদিল্লির বায়ুসেনা প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল অমরপ্রীত সিংহ জানিয়েছেন, প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরের পাক জেটকে ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’-এর ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ধ্বংস করা গিয়েছে।
১৩২০
বাহিনীর বহরে শামিল হওয়ার পর ‘এস-৪০০’-এর নতুন নামকরণ করে ভারতীয় বায়ুসেনা। এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি বর্তমানে ‘সুদর্শন চক্র’ হিসাবে পরিচিত। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির অত্যাধুনিক সংস্করণ হল ‘এস-৫০০’। এটি প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকার সুরক্ষা প্রদান করতে পারে। শত্রুর ছোড়া হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে ‘এস-৫০০’ এয়ার ডিফেন্সের।
১৪২০
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, গত ৭ অগস্ট মস্কো সফরে গেলে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসর) অজিত ডোভালের সঙ্গে দেখা করেন স্বয়ং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেপ্টেম্বরে তাঁর ভারত সফরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সময়ে মস্কোর সঙ্গে ‘এসইউ-৫৭’ যুদ্ধবিমান নিয়ে প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলতে পারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যদিও এই নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেননি ডোভাল।
১৫২০
‘এসইউ-৫৭’র মূল নির্মাণকারী সংস্থা হল ‘ইউনাইটেড এয়ারক্র্যাফ্ট কর্পোরেশন’। তবে স্টেল্থ শ্রেণির দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই যুদ্ধবিমানের নকশা তৈরি করেছে বিখ্যাত রুশ লড়াকু বিমান কোম্পানি ‘সুখোই’। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে এই যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে আসছে রুশ বায়ুসেনা।
১৬২০
স্টেল্থ ক্যাটেগরির হওয়ায় ‘এসইউ-৫৭’কে রাডারে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। মাঝ-আকাশে অন্য লড়াকু বিমানের সঙ্গে ‘ডগফাইট’ হোক বা আকাশপথে আক্রমণ শানিয়ে মাটির উপরে থাকা শত্রুঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া, সবেতেই এই যুদ্ধবিমানের জুড়ি মেলা ভার। এ ছাড়া ‘ইলেকট্রনিক যুদ্ধ’-এর সুবিধাও পাবেন ‘এসইউ ৫৭’-এর যোদ্ধা পাইলট।
১৭২০
ভারতীয় বায়ুসেনা দীর্ঘ দিন ধরেই এই সংস্থার তৈরি ‘এসইউ-৩০এমকেআই’ নামের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে আসছে। এককথায়, সুখোইয়ের সঙ্গে এ দেশের ফাইটার পাইলটদের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। রাশিয়ার দাবি, ‘এসইউ-৫৭’ যুদ্ধবিমান থেকে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার সুবিধা রয়েছে। বর্তমানে এতে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) প্রযুক্তিও ব্যবহার করছে মস্কো।
১৮২০
শব্দের দ্বিগুণ গতিতে (দুই ম্যাক) ছুটতে পারে ‘এসইউ-৫৭ই’। ১০ টন পর্যন্ত সমরাস্ত্র বহন করার শক্তি রয়েছে মস্কোর ‘উড়ন্ত দৈত্য’র। গত ফেব্রুয়ারিতে বেঙ্গালুরুর ‘অ্যারো ইন্ডিয়া’ শো-তে রুশ লড়াকু জেটটিকে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ওই সময়ে মাঝ-আকাশে কসরত দেখিয়ে সকলের নজর কাড়ে ‘এসইউ-৫৭ই’। তখনই এই যুদ্ধবিমান নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করার ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করে রুশ সরকারি প্রতিরক্ষা রফতানি সংস্থা ‘রোসোবোরোনেক্সপোর্ট’।
১৯২০
মস্কোর প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা বলেন, ‘‘ভারত এসইউ-৫৭ই কিনলে এই যুদ্ধবিমানের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাবে নয়াদিল্লি। প্রযুক্তির ব্যাপারে সব কিছু সরবরাহ করতে রাজি আছি আমরা।’’ তবে সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটির বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির নিরিখে এটি মার্কিন যুদ্ধবিমান ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’-র মতো নয়। অর্থাৎ, কিছু ক্ষেত্রে রেডারে ধরা পড়তে পারে রুশ ‘এসইউ-৫৭ই’।
২০২০
গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে চলা ‘যুদ্ধে’ লড়াকু জেট হারায় ভারতীয় বায়ুসেনা। যদিও তার সংখ্যা এখনও প্রকাশ্যে আনেনি নয়াদিল্লি। অন্য দিকে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত রাখা নিয়ে নয়াদিল্লিকে পরমাণু হামলার হুমকি দিয়েছেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিমানের প্রতিরক্ষা চুক্তি মোদী সরকার করে কি না, সেটাই এখন দেখার।