Russia loses 617 lives in an unfortunate tragedy that struck the Soviet battleship Novorossiysk dgtl
Russia’s Worst-Ever Naval Disaster
‘অভিশপ্ত’ রণপোতের দখল নিয়ে প্রাণ গিয়েছিল ৬১৭ জন সোভিয়েত সেনার! নাশকতা না কি প্রতিশোধ, রহস্য আজও অধরা
দুর্ঘটনার ৩৩ বছর পর উঠে আসে একের পর এক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব। এর মধ্যে একটি এক ভয়ঙ্কর অন্তর্ঘাতের ইঙ্গিত দেয়। উঠে আসে জার্মান মাইন, এমনকি ‘দ্য ব্ল্যাক প্রিন্স’-এর কথাও।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৫ ১৬:২১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
১৯০০ সালের গোড়ার দিকে ইটালির রাজকীয় নৌবাহিনীর (রেজ়িয়া মেরিনা) জন্য নির্মিত তিনটি বিখ্যাত ড্রেডনট যুদ্ধজাহাজের মধ্যে একটি ছিল গিউলিয়ো সিজ়ার। ১৯১১ সালে যুদ্ধজাহাজটির নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১৯১৪ সালে নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল রণপোতটি।
০২২১
প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাহাজটিকে কাজে লাগানো হলেও আঘাত বা ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল গিউলিয়ো সিজ়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তিতে যোগদানকারী দেশ ইটালির ভরাডুবির পর ১৯৪৩ সালের যুদ্ধবিরতি এবং পরবর্তী শান্তিচুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুসারে ইটালিকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে যুদ্ধজাহাজ হস্তান্তর করতে হয়েছিল।
০৩২১
১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বরে মাল্টায় মিত্রশক্তির কাছে সে দেশের নৌবাহিনীর বেশির ভাগ অংশ অক্ষত অবস্থায় আত্মসমর্পণ করে। সেই নৌবহরের মধ্যে ছিল গিউলিয়ো সিজ়ার। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৭ সালের ব্যবধানে এটিকে আরও শক্তিশালী যুদ্ধাস্ত্র ও অতিরিক্ত সুরক্ষা বর্মে সজ্জিত করা হয়েছিল। জাহাজটিকে আরও দ্রুতগামী করে তুলতে এর ই়ঞ্জিনের পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।
০৪২১
১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাহাজটি আলবেনিয়ার ভ্লোর বন্দরে পৌঁছোয়। তখন থেকেই এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধজাহাজ রূপে নতুন করে কর্মজীবন শুরু করে। সেই বছরের ৫ মার্চ ইটালীয় জাহাজের ভোল পাল্টে এর রুশ নামকরণ করা হয়। নাম রাখা হয় নভোরোসিয়েস্ক।
০৫২১
আনুষ্ঠানিক ভাবে কৃষ্ণ সাগরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেভাস্তোপল নৌবহরে ঠাঁই হয় নভোরোসিয়েস্কের। এক দশকের বেশি সময় আগে জাহাজটিকে মেরামত ও পুনর্নির্মাণ করা হলেও আদতে এর নকশা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার। তত দিনে জাহাজটির বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ভেঙে গিয়েছিল। অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশে মরচে ধরা শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনেক যন্ত্রাংশ ত্রুটিপূর্ণ ছিল। চুল্লি এবং যন্ত্রপাতিতে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাও ছিল।
০৬২১
তা সত্ত্বেও গতি ও গুলি ছোড়ার শক্তিতে নৌবহরে নভোরোসিয়েস্কের সমকক্ষ তেমন কোনও যুদ্ধজাহাজ ছিল না। যুদ্ধের সমাপ্তি এবং সোভিয়েত নৌবাহিনীতে স্থানান্তরের মধ্যবর্তী সময় ইটালীয় নৌবাহিনীর অবহেলার কারণে যুদ্ধজাহাজটির এই অবস্থা হয়েছিল। সেই সময় জাহাজের যন্ত্রাংশ সংগ্রহের কোনও উপায় ছিল না। তাই সোভিয়েতদের কাছে এটি মেরামত করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না।
০৭২১
একাধিক বার মেরামতির পরও মূল ব্যাটারি প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা কখনওই বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৫৫ সালে ভয়াবহ এক বিপর্যয়ের মুখে পড়ার আগেও জাহাজটি কৃষ্ণ সাগর নৌবহরের প্রধান হিসাবে কাজ করছিল। নৌসেনার প্রশিক্ষণ জাহাজ হিসাবে ব্যবহার করা হত নভোরোসিয়েস্ককে। বন্দুকযুদ্ধের মহড়া পরিচালনা করা হত এখান থেকে।
০৮২১
১৯৫৫ সালের ২৮ অক্টোবর। বিকেলের দিকে জাহাজটি সেভাস্তোপলে ফিরে আসে। প্রায় ৬০ ফুট গভীর জলে নোঙর করা হয়েছিল রণতরীটিকে। তীর থেকে প্রায় ১,০০০ ফুট দূরে ছিল সেটি। জাহাজে প্রায় ১৫০০-১৭০০ জন কর্মী ছিলেন। কৃষ্ণ সাগরের পরিবেশ শান্তই ছিল। হালকা বাতাস বইছিল। জাহাজে থাকা কেউই ঘুণাক্ষরে টের পাননি কোন বিপদ ওত পেতে আছে তাদের জন্য।
০৯২১
রাত তখন গভীর। জাহাজের প্রায় সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। দেড়টা নাগাদ নোভোরোসিয়েস্কের সামনের অংশের ডান দিকে একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের ফলে জাহাজে প্রায় ৬৮ ফুট লম্বা এবং ১২ ফুট প্রশস্ত একটি গর্ত তৈরি হয়। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে এর ফলে জাহাজের হালের পাতগুলি ভিতরের দিকে বেঁকে যায়।
১০২১
বিস্ফোরণের অভিঘাত এতটাই ছিল যে এটি নিকটবর্তী সেভাস্তোপল নৌঘাঁটির কর্মীদেরও ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। বিস্ফোরণের তীব্রতা অভ্যন্তরীণ ডেক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সামনের ৬৬ ফুট অংশের সমস্ত কাঠামো ছিন্ন হয়ে যায়। জাহাজের সামনের অংশ (যাকে ধনু অংশ বলা হয়) বাকি অংশ থেকে ৫ ডিগ্রি উপরে বেঁকে যায়।
১১২১
রণতরীর নিজস্ব কর্মী এবং প্রতিবেশী জাহাজের উদ্ধারকারী দলগুলি জাহাজটিকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। জাহাজটি উল্টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজে থাকা হাজার জন ডেক এবং উপরের কাঠামো থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১২২১
বিস্ফোরণটি ২ হাজার ৬৪৮ পাউন্ড টিএনটির (বিস্ফোরণ শক্তি) সমতুল্য বলে অনুমান করা হয়েছিল। বিস্ফোরণের আড়াই ঘণ্টা পরে কৃষ্ণ সাগর নৌবহরের ২৯,০০০ টনের জাহাজটি উল্টে যায় এবং ডুবে যায়। যখন জাহাজটি ৫০ ফুট গভীরে ডুবে যায়। তখনও এর ভিতর ৬০০ জনের বেশি সেনা ও কর্মী আটকা পড়েছিলেন।
১৩২১
এই বিস্ফোরণে মোট ৬১৭ জন সোভিয়েত নাবিক নিহত হন। এর মধ্যে ৬১ জন অন্যান্য জাহাজ থেকে সাহায্যের জন্য এসেছিলেন। উদ্ধার অভিযান কয়েক দিন ধরে চলে। পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে ধ্বংসাবশেষ এবং সমুদ্র থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
১৪২১
এই বিপর্যয় সোভিয়েত নৌবাহিনীর ইতিহাসে সবচেয়ে বিধ্বংসী হিসাবে পরিচিত হয়ে রয়েছে। তবে অদ্ভুত বিষয়টি হল সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের নিজস্ব উপকূলে এত বড় ধরনের দুর্ঘটনার খবরটি পৃথিবীর কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিল দীর্ঘ ৩৩ বছর।
১৫২১
যাঁরা পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছিলেন তাঁরাই কেবল এই দুর্ঘটনার কথা শুনেছিলেন। লাল ফৌজের কঠোর তথ্য নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষাবর্ম ভেদ করে এই দুর্ঘটনার সংবাদ সে ভাবে কেউ টের পাননি। গোয়েন্দা সংস্থাগুলিও এই ঘটনার সুলুকসন্ধান করতে পারেনি।
১৬২১
১৯৮৮ সালের মে মাসে নৌবহরের অ্যাডমিরাল সের্গেই গোর্শকভের মৃত্যুর পর জাহাজডুবির খবর বিশ্বকে প্রথম জানানো হয়। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পরই এর নেপথ্যে থাকা কারণ জানতে উৎসুক হয়ে ওঠেন ষড়যন্ত্রতত্ত্ববাদীরা। নৌ ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় এবং বিধ্বংসী বলে চিহ্নিত হয়েছে ঘটনাটি।
১৭২১
নভোরোসিয়স্ক বিপর্যয়ের তদন্তে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল ভায়াচেস্লাভ মালিশেভ। তিনি ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের এক প্রখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৫৫ সালে তদন্তের শুরু থেকেই মালিশেভ বিশ্বাস করেছিলেন যে বিস্ফোরণটি বাইরের থেকে কোনও আঘাতের ফলে হয়েছিল।
১৮২১
তদন্তের ফলে সিদ্ধান্ত হয় যে বিস্ফোরণটি সমুদ্রতলের উপর বা তার কাছাকাছি হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত একটি জার্মান মাইন টাইপ আরএমএইচ-কে বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করা হয়েছিল। এই বিস্ফোরকটির ওয়ারহেড ছিল ১,৬৯৮ পাউন্ড, যা আনুমানিক ২,৬৪৮ পাউন্ড বিস্ফোরণ শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন তদন্তকারীরা।
১৯২১
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই মাইনগুলি কৃষ্ণ সাগরে যথেচ্ছ ভাবে স্থাপন করা হয়েছিল। যুদ্ধ সমাপ্তির পরও সেগুলিকে পুরোপুরি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি বলে দাবি তোলে সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুর্ঘটনার প্রায় তিন দশক পরে, একটি নতুন ষড়যন্ত্রতত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে। সেই তত্ত্ব আরও ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়।
২০২১
১৯৮৮ সালের ১৪ মে একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে সেই দাবি। বলা হয় যে সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌবহরের অ্যাডমিরাল নিকোলাই গেরাসিমোভিচ কুজনেটসভকে অসম্মান করার জন্য দেশেরই গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি নাশকতা চালায়। জাহাজের ভিতরে নাশকতা চালিয়ে জাহাজকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তবে এই দাবির সপক্ষে কোনও প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
২১২১
আরও একটি তত্ত্ব উঠে এসেছিল। সেই তত্ত্ব অনুযায়ী, মানব-টর্পেডো ব্যবহার করে ইটালীয় সাঁতারুরা যুদ্ধজাহাজটিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করেছিলেন। অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন কুখ্যাত ইটালীয় নব্যফ্যাসিস্ট এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কম্যান্ডো জুনিও ভ্যালেরিও বোর্গিস, যাঁকে ‘দ্য ব্ল্যাক প্রিন্স’ নামেও অভিহিত করা হয়। তিনি স্পষ্টতই মৃত্যুর আগে এই যুদ্ধজাহাজটি ডুবিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কারণ এটিকে সোভিয়েতদের হাতে তুলে দেওয়ায় যারপরনাই বিরক্ত ছিলেন তিনি।