সাবেক সোভিয়েত নেতারা চেয়েছিলেন উত্তর রাশিয়ার পেচোরা নদীর অববাহিকাকে ভল্গার উপনদী কামার অববাহিকার সঙ্গে যুক্ত করতে। এর মাধ্যমে পেচোরা ও ভলগার জলপথকে একীভূত করা যেত। পরে জল পরিবহণকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন তাঁরা। মস্কোর নির্দেশ পেয়ে সেই মতো কোমর বেঁধে লেগে পড়েন সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা।
পেচোরা এবং ভল্গার উপনদী কামার মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিল না, তা ভাবলে ভুল হবে। ১৯৩৩ সালের নভেম্বরে ‘ভল্গা এবং তার অববাহিকা পুনর্গঠন’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেন সোভিয়েত নেতারা। এর মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন এবং জলবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা ছিল রুশ বৈজ্ঞানিকদের। প্রকল্পটির নেতৃত্বে ছিলেন সের্গেই ইয়াকোলেভিচ ঝুক নামের এক ইঞ্জিনিয়ার।
কিন্তু, ওই সময়ে ইউরোপের রাজনীতি দ্রুত বদলাচ্ছিল। জার্মানিতে তখন ক্ষমতা দখল করেছেন অ্যাডল্ফ হিটলার। আর ইতালির কুর্সিতে বেনিতো মুসোলিনি। দুই সাম্রাজ্যবাদী নেতার উত্থানে প্রমাদ গোনে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফলে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করতে থাকে মস্কো। অন্য দিকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা ঘরে চলে যায় ‘ভল্গা অববাহিকা পুনর্গঠন’ প্রকল্পের কাজ।
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪১ সালের ২২ জুন হিটলার অনাক্রমণ চুক্তি ভেঙে রাশিয়া আক্রমণ করলে সম্পূর্ণ ঘুরে যায় লড়াইয়ের অভিমুখ। এর জেরে একরকম বাধ্য হয়েই লড়াইয়ে জড়াতে হয় মস্কোকে। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি নিয়ে ফের আলোচনায় বসেন রুশ বৈজ্ঞানিকেরা। তখনই কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত খাল খননের নীল নকশা ছকে ফেলেন তাঁরা।
১৯৬১ সালে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের ছাড়পত্র দেন সোভিয়েত নেতারা। এর পোশাকি নাম ছিল ‘নর্থ রিভার রিভার্সাল’। এর মাধ্যমে উত্তরের নদীর জল বিপরীত মুখে বইয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন রুশ গবেষকেরা। মস্কোর গদিতে তখন নিকিতা সর্গেইভিচ ক্রুশ্চেভ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার বিরুদ্ধে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ (পড়ুন কোল্ড ওয়ার) নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি।
‘নর্থ রিভার রিভার্সাল’-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ চেরডিনস্কি জেলার ভাসিউকোভো গ্রামের কাছে তিনটি ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণ ঘটান রুশ গবেষকেরা। এগুলির প্রতিটি ছিল ১৫ কিলোটন ক্ষমতা সম্পন্ন। বিস্ফোরণের জেরে ৭০০ মিটার লম্বা এবং ৩৮০ মিটার চাওড়া খালের মতো জায়গা তৈরি হয়। এই মিশনের নাম ‘টাইগা’ রেখেছিলেন তাঁরা।
পরমাণু বিস্ফোরণে তৈরি খালের আকার দেখে প্রাথমিক ভাবে খুশিই হন সোভিয়েত গবেষক এবং ইঞ্জিনিয়ারেরা। তাঁরা পরবর্তী পর্যায়ের বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কিন্তু, তত দিনে ওই খালের মতো অংশ থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শুরু হয়ে গিয়েছে। সেটা শুধু রাশিয়ার মধ্যেই থেমে ছিল না। বিকিরণের প্রভাব আশপাশের দেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মস্কোর বিরুদ্ধে তৈরি হয় প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ।
তবে এই ঘটনার অন্য যুক্তিও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, সব জেনে বুঝেই একসঙ্গে তিনটি পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন মস্কোর বৈজ্ঞানিক ও ইঞ্জিনিয়ারেরা। কারণ, ৬০ ও ৭০-এর দশকে ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ তীব্র হয়েছিল। আর তাই এই প্রকল্পের মাধ্যমে ক্রুশ্চেভ সোভিয়েতের ক্ষমতা জাহির করতে চেয়েছিলেন।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি বন্ধ হওয়ার বছরেই (পড়ুন ১৯৮৬) ইউক্রেনের চেরনোবিল পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে হওয়া বিপর্যয়ে আক্রান্ত হন ৩ লক্ষ ৪০ হাজার জন। ঘটনার সময়ে মৃত্যু হয় ৩১ জনের। ইউক্রেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ওই প্রকল্প বন্ধ করা হয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy