Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২

সু ম না মি

কবীর সুমনএমন একটা বয়সে এসে গিয়েছি, যেখানে ছেলেবেলার চেনাজানা বয়স্ক মানুষরা একে একে বিদায় নেবেনই। গানবাজনা চেটে-চুষে-কামড়ে-শুঁকে, সুরতালছন্দলয় নিয়ে খেলে বেড়ানোর দিনগুলো যখন সুখেই কাটত, কোন গানের কে সুরকার, কে-ই বা গীতিকার, তা নিয়ে ভাবার, এমনকী সেই খবরটুকু রাখারও কোনও প্রয়োজন অনুভব করতাম না।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

এমন একটা বয়সে এসে গিয়েছি, যেখানে ছেলেবেলার চেনাজানা বয়স্ক মানুষরা একে একে বিদায় নেবেনই। গানবাজনা চেটে-চুষে-কামড়ে-শুঁকে, সুরতালছন্দলয় নিয়ে খেলে বেড়ানোর দিনগুলো যখন সুখেই কাটত, কোন গানের কে সুরকার, কে-ই বা গীতিকার, তা নিয়ে ভাবার, এমনকী সেই খবরটুকু রাখারও কোনও প্রয়োজন অনুভব করতাম না। কোন গান কে গেয়েছেন জানলেই হল। আকাশবাণী কলকাতার অনুরোধের আসরে জানানো হত শুধু কণ্ঠশিল্পীর নাম। ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠানে জানানো হত ছায়াছবির নামটাও। গানটি কে লিখেছেন, কে সুর করেছেন, তা ঘোষণা করা হত আকাশবাণীর রম্যগীতি আর আধুনিক গানের ‘লাইভ’ অনুষ্ঠানে।

সাধারণ শ্রোতারা প্রিয় আধুনিক গানগুলি মনে রাখতেন গায়ক-গায়িকাদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে। সত্যি বলতে, আমি নিজেও তাই। ‘তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ’ হেমন্ত (ভাবা ও বলার সময়ে পদবি বাদ)। ‘কে তুমি আমারে ডাকো’ সন্ধ্যা। ‘প্রদীপ কহিল দখিনা সমীরে ফিরে যাও’ প্রতিমা। ‘শুকতারা আকাশের কোণেতে’ আর ‘কোন দূর বনের পাখি’ গায়ত্রী। ‘নদী ছলোছল হাওয়া ঝিরিঝির’ তরুণ। ‘ঝিরঝিরঝির ঝিরঝিরি বরষা’ ধনঞ্জয়। ‘চাঁদের আশায় নিভায়েছিলাম যে দীপ আপন হাতে’ মান্না। ‘মৃণাল বাহুলতা ঘেরিয়া’ মৃণাল। তেমনি, আরও কিছু পরে, ‘কৃষ্ণনগর থেকে আমি কৃষ্ণ খুঁজে এনেছি’ গীতা দত্ত। অনুরোধের আসরেই তখন গান শুনতাম, গ্রামোফোন রেকর্ডের মালিক না হলে সহজে জানার উপায় ছিল না সুরকার কে।

গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানিগুলো এক কালে দুর্গাপুজো উপলক্ষে রেকর্ড করা গানগুলি প্রকাশ করার সময় লিরিকগুলোও চটি-বই আকারে প্রকাশ করতেন। তাতে গীতিকার ও সুরকারদের নাম দেওয়া থাকত। কিন্তু ওই সংকলনগুলি আর কিনতেন ক’জন! সাধারণ শ্রোতারা ও-সবের ধার ধারতেন না। তাঁরা রেডিয়োয় নতুন নতুন বা প্রিয় পুরনো গানগুলি শুনতে পেলেই খুশি।

‘সুখী গৃহকোণ শোভে গ্রামোফোন’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখতাম এইচ এম ভি-র। দম ঘোরানো গ্রামোফোন আর কেউ তৈরি করে বিক্রি করতেন বলে জানা নেই। আমি অন্তত দেখিনি ছেলেবেলায়। আমাদের পরিবার অসুখী ছিল বলে মনে হয়নি কখনও, কিন্তু গ্রামোফোন ছিল না আমাদের। আমার কোনও আত্মীয়ের বাড়িতেই গ্রামোফোন দেখিনি। যে পাড়ায় বড় হয়েছিলাম, সেখানে একটি মাত্র বাড়িতে একখানা পুরনো গ্রামোফোন ছিল। আমাদেরই এক বন্ধুর বাড়ি। কিন্তু গ্রামোফোন থাকা সত্ত্বেও সেই বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকত, কারণ কর্তাটি ছিলেন বদমেজাজি। আমাদের সেই বন্ধুটিকেও খুব সুখী বলে মনে হত না। বরং মনে হত একটু দুঃখী-দুঃখী। তা হলে, যা দেখা যাচ্ছে, গৃহকোণে গ্রামোফোন থাকলেও সুখ বিরাজ করবেই, এমন গ্যারান্টি ছিল না।

কয়েক জন বন্ধু মিলে শুনতে যেতাম সেই বন্ধুর বাড়ির গ্রামোফোন। কিছু পুরনো রেকর্ড ছিল ওই বাড়িতে। তার মধ্যে একটি ছিল ‘এসো খেলি প্রেম প্রেম খেলা’। প্রেমের মর্ম ওই বয়সে মোটেও বুঝতাম না, প্রেম-প্রেম খেলা তো নয়ই। কিন্তু গানের সুর তাল ছন্দ এত চমত্‌কার ছিল, গায়িকাও এত প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে গেয়েছিলেন যে, গানটি আমাদের পছন্দ হয়েছিল খুব। সাত-আট বছর বয়সে বার তিনেক গ্রামোফোনে শোনা গানের দুটি লাইন আজও মনে আছে: ‘এসো খেলি প্রেম প্রেম খেলা/ হোক শ্রাবণের দিন তবু মনে করো এ তো ফাগুনের বেলা’। সুর তো গোটাগুটিই মনে গাঁথা হয়ে আছে। এ রকম কথা আর সুর সৃষ্টি করতে পারলে বর্তে যেতাম। কার সুর? শুনে মনে হয় আধুনিক বাংলা গানের এক দেবতা নচিকেতা ঘোষের। লেখা কার? আন্দাজও করতে পারছি না।

তেমনই ‘কৃষ্ণনগর থেকে আমি কৃষ্ণ খুঁজে এনেছি’। গীতা দত্তের গাওয়া। ‘মাটির পুতুল মনের পুতুল প্রাণের পুতুল’ হায় হায়। কার লেখা? জীবন-সায়াহ্নে অনেক কিছু থেকে সচেতন ভাবে সরে এসে চেনা ঘর, তানপুরা, রেওয়াজ আর স্মৃতিতে আশ্রয় খোঁজা এই আমিটাকে তোলপাড় করে দেয় ব্যর্থতার বোধ: কী সহজ, কী সাবলীল, কী চেনা, কী সজীব, কী সার্থক! আমি তো পারিনি। গত চল্লিশ বছরে আর কে পেরেছে? আর সুর, ছন্দ। প্রথম শোনাতেই মনে হয়েছিল গায়িকা যেন নাচতে নাচতে গাইছেন। এজরা পাউন্ড লিখেছিলেন, ‘সংগীত থেকে বেশি সরে এলে কবিতা মরে যায়; নাচ থেকে বেশি সরে এলে সংগীত যায় কুঁকড়ে, শুকিয়ে।’ প্রধানত মধ্যসপ্তকে বাঁধা এই সুরটিতে এক স্বর থেকে অন্য স্বরে লাফিয়ে যাওয়ার কেরামতি নেই। কথায় কথায় সুরের মোচড় দেওয়ার স্পোর্টস আইটেম নেই। সহজ ভঙ্গিতে কথা-সুরের ছোট ছোট টুকরো স্বাভাবিক যুক্তিতে জুড়ে জুড়ে তৈরি এই সুর। দশকের পর দশক মাথার ভেতরে কোথাও বেজে চলেছে অন্তত প্রথম দুটি লাইন। সলিল চৌধুরী এক বার আমায় বলেছিলেন, ‘বুঝলি, তুই আমায় গানের প্রথম লাইনের একটা জুতসই ধরতাই দে, তার পর তোকে আর ভাবতে হবে না। বাকিটা হাসতে হাসতে মেরে দেব। শুধু প্রথম লাইনটা দে।’

আমি তো কোন ছার। কথাটা বলেছিলেন তিনি আমায় তাঁর আটান্ন বছর বয়সে, আমার বয়স তখন তিরিশের কোঠায়। তাঁর যৌবনে এই ধরনের কথা তিনি নিশ্চয়ই ঢের বেশি বলতেন তাঁর তিন দুর্ধর্ষ অনুগামী, ভাবশিষ্যকে: প্রবীর মজুমদার, অনল চট্টোপাধ্যায়, অভিজিত্‌ বন্দ্যোপাধ্যায়। গীতা দত্তর গাওয়া ওই গানটির সুরকার কে আমি জানতাম না। এই সে দিন সংগীতশিল্পী অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় আমায় জানালেন অনল চট্টোপাধ্যায়, তিনি সম্প্রতি চলে গেলেন। সলিল চৌধুরীর আদর্শে অনুপ্রাণিত তিন জনই সুরকার ও গীতিকার হিসেবেও শক্তপোক্ত জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন আধুনিক বাংলা গানে।

অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুর করা কিছু গান আমার কাছে আজও এক-একটি সার্থক সুর-রচনার পাঠ। ‘চলকে পড়ে কলকে ফুলে, মধু যে আর রয় না’র (প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়) ছন্দ ও সুরের ছোট ছোট টুকরোর চলন, আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘জানি এ ভুল’-এর অনুচ্চ রাগাশ্রয় এবং ছোট ছোট তানের উপযুক্ত ব্যবহার এক জন বড় সুরকারকে চিনিয়ে দেয়।

জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে তাঁরা চলে যাচ্ছেন একে একে। ‘লালন বলে আর তো এমন বাতি জ্বলবে না।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kabir suman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE