Advertisement
০২ মে ২০২৪
ইনি on উনি

ওয়াল্ট ডিজনি

ওয়াল্ট ডিজনিকে মানুষ চেনেন দুর্দান্ত এক জন অ্যানিমেটর হিসেবে, মিকি মাউস-এর স্রষ্টা হিসেবে, প্রায় দু’ডজন অস্কার জিতে নেওয়া পরিচালক-প্রযোজক হিসেবে। আরও এক ধাপ এগোলে, ডিজনিল্যান্ড-এর মতো অসাধারণ ‘থিম পার্ক’-এর মাস্টারমাইন্ড হিসেবে, বা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির প্রাণপুরুষ হিসেবে।

হর্ষ নেওটিয়া
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৪ ০৮:৩০
Share: Save:

ওয়াল্ট ডিজনিকে মানুষ চেনেন দুর্দান্ত এক জন অ্যানিমেটর হিসেবে, মিকি মাউস-এর স্রষ্টা হিসেবে, প্রায় দু’ডজন অস্কার জিতে নেওয়া পরিচালক-প্রযোজক হিসেবে। আরও এক ধাপ এগোলে, ডিজনিল্যান্ড-এর মতো অসাধারণ ‘থিম পার্ক’-এর মাস্টারমাইন্ড হিসেবে, বা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির প্রাণপুরুষ হিসেবে। নিজে এক জন উদ্যোগপতি বলেই হয়তো, আমার কাছে ওঁর এই দ্বিতীয় পরিচয়টা অনেক বড়। উনি অত বড় মস্ত ব্যবসায়ী ছিলেন বলে বলছি না। বলতে চাইছি, সম্পূর্ণ অন্য একটা পরিবেশ থেকে, শেকড় থেকে ওঁর উঠে আসাটা, এবং ওই রকম তাক-লাগানো উঠে আসাটা আমার কাছে দারুণ শিক্ষাপ্রদ। সৃষ্টিশীল মন তো কত জনেরই থাকে। ঠিক ঠিক ভাবে, ঠিক উপকরণ দিয়ে, ঠিক লোককে ঠিক সময়ে কাছে টেনে একটা পরিকল্পনাকে, একটা ‘ভিশন’কে রূপ দিতে পারেন ক’জন? ওই জায়গাটাতেই ডিজনি আশা দেন, প্রেরণা জোগান।

বলছিলাম শেকড়ের কথা। বিশ শতকের একেবারে শুরুর বছরটিতে ছাপোষা, মোটামুটি-দিন-চলা এক গেরস্ত-ঘরে ডিজনির জন্ম। একটা থিতু শৈশবও ছিল না, এ পাড়া, ও শহরে বার বার বাড়ি বদলের জেরে। কিন্তু তার মধ্যেই আঁকায় হাত পাকানো, ছোট্ট রেল স্টেশনে গিয়ে ট্রেন দেখা, কমেডি-শো আর সেলুলয়েডের ছবির প্রেমে পড়া। ছোটবেলায় আমরাও তো গান, নাচ, ছবি, অভিনয় কত শিল্পের কোল ঘেঁষে থাকি। কিন্তু বড় হয়ে কাজ বাছি অন্য, জীবনটাও কেমন বাঁধা গতে পড়ে খাবি খায়। ডিজনি তা করেননি। ছোট থেকে যে যে জিনিসগুলো ভালবেসেছেন, তাদের গেঁথে নিয়েছেন নিজের স্বপ্নে, নিজের পেশায়। ভালবাসার সঙ্গে ভিশন যুক্ত হলে তবে না মাস্টারপিস হবে! ডিজনিল্যান্ড, বা এই গেল-বছরে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বিলিয়ন ডলার রোজগার-করা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি তো তা-ই, মাস্টারপিস!

চলার পথে বাধাবিঘ্নও কম ছিল না। বাবা-মা’র উদ্বেগ, কাজ খোঁজার, রোজগারের চাপ মাথায়। এই খবরকাগজে ক্যারিকেচার বা কমিক্স আঁকছেন, এই অমুক স্টুডিয়োয় অ্যাড ম্যান হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু ওই যে, স্বপ্ন আর দূরদৃষ্টিটা ছিল! আরও ছিল আনন্দ। আসলে জীবন খুঁড়ে খুঁজে নেওয়া এই আনন্দটাই ওঁকে পরে ওঁর লক্ষ্য গড়ে দিয়েছিল। অন্যকে আনন্দ দেওয়া, অন্যের জীবনে আনন্দের উৎস তৈরি করে দেওয়াও যে একটা ভরপুর কাজ হতে পারে, ডিজনিই দেখালেন। এ জিনিস ভাবতে সোজা, করা কিন্তু খুব কঠিন। আনন্দ তো একটা অনুভূতি। তার মতো সূক্ষ্ম, চূড়ান্ত অ্যাবস্ট্রাক্ট একটা ইমোশনকেও যে কী ক্রিয়েটিভ ভাবে পণ্যায়িত করা যায়, বিনোদনকে কেন্দ্রে রেখে আক্ষরিক অর্থে ‘ক্রিয়েট’ করা যায় একটা বাণিজ্য, উনিই ভাবলেন। করলেনও। আজ তো এই নিয়ে কত পড়াশোনা, ম্যানেজমেন্ট-এর কত কোর্স আছে এই নিয়ে। কিন্তু ইন্টারনেট-ছাড়া, তথ্যপ্রযুক্তিহীন সেই সময়ে ডিজনি একা হাতে একটা প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করিয়েছেন।

সবাই ভাবেন, বড় ব্যবসায়ী বা উদ্যোগপতিরা সব সময় জমা-খরচ আর আয়-ব্যয়েরই আঁক কষেন। সে তো করেনই, করতেই হয়। কিন্তু তার বাইরে, ভাবতেও হয় আরও অনেক কিছু। এক জন উদ্যোগপতির প্রয়াস শুধু ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির গণ্ডিতে আটকে থাকে না। সেই প্রয়াসটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাস্তাও তাঁকে তৈরি করতে হয়, ‘উদ্যোগ’টাকে করে তুলতে হয় ‘প্রতিষ্ঠান’। ডিজনি এখানেই প্রেরণা, কেননা তাঁর প্রতিষ্ঠান তিনি চলে যাওয়ার পরও রমরম করে তো চলছেই, কলেবরেও বাড়ছে। ওঁর মতো জিনিয়াস তো আর সবাই নন। তাতে কী, মধ্য-মেধার কেউও একটা ‘আইডিয়া’ ভেবে নিয়ে ওঁর দেখানো পথে আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে এগোতেই পারেন। একটা যুগান্তকারী আইডিয়াকে নিয়ে একমুখী একরোখা এগিয়ে যাওয়াটা সব প্রতিষ্ঠান পারে না। ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি পেরেছে। তাই না সারা বিশ্বে সবাই ওয়াল্ট ডিজনিকে এক নামে চেনেন!

ডিজনির আর একটা প্রেরণাদায়ী দিক, পারিবারিক ও সামাজিক শাশ্বত মূল্যবোধগুলোকে বাণিজ্য-ভাবনার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া। বিশ শতকের সেই সময়টায় কিন্তু সংস্কার, ঐতিহ্য, এই সব ভাঙার চেষ্টা চলছে মার্কিন সমাজে-সংস্কৃতিতে। সেখানে আমি নিজে দেখেছি, ডিজনির গড়া অনেক থিম পার্কেই সেই সময় বার ছিল না, মদ বিক্রি হত না, স্মোকিংও বারণ। কেন? এখানে বাবা-মা’র হাত ধরে শিশুরা আসে, দৌড়োয়, লাফায়-ঝাঁপায়, খেলে বেড়ায়। ওদের আনন্দের জন্যই তো এত সব। তাই ওখানে এমন কিছু থাকবে না যা ওদের নরম মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া শানাবে। প্রগতিবাদীরা হয়তো বলবেন, সব মিড্ল ক্লাস সেন্টিমেন্ট! তা নয়। পৃথিবীর সব শিশুর কাছে আনন্দ, হাসি, খুশি পৌঁছে দেওয়াটাই ছিল ডিজনির লক্ষ্য। সেটাকে পাখির চোখ করেই তৈরি মিকি মাউস থেকে ডিজনিল্যান্ড। ওই লক্ষ্যে পৌঁছতে বড়দের আনন্দ-খোরাক থেকে টুকটাক না হয় বাদ গেলই!

ডিজনি নিজে তাঁর বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে বেড়াতে যেতেন। তখনই নাকি মাথায় আসে ডিজনিল্যান্ডের ভাবনা। এমন একটা ‘স্পেস’ বানাতে হবে, যেখানে যে কোনও বয়সের, ধর্মের, জাতির, সংস্কৃতির সব্বাই আসবেন। সেই প্ল্যান যে কী দারুণ সফল, বিশ্ববাসী জানেন। ডিজনিল্যান্ড আজ ‘মোস্ট ভিজিটেড প্লেস অন প্ল্যানেট আর্থ’। ভাবা যায়! কোনও পাহাড়-সমুদ্র-জঙ্গলে নয়, ইতিহাসখ্যাত কোনও স্থানে নয়, এক জন মানুষের গড়া একটা জায়গায় সারা বিশ্বের মানুষ উপচে দেখতে আসেন! স্থানীয় এয়ারপোর্টে ৯০% লোকই নামে ডিজনিল্যান্ড যাওয়ার জন্য। একে বলি ভাবনার জোর, করে দেখানোর হিম্মত।

আরও একটা শেখার জিনিস: কোন কাজটা কোন সময়ে কাকে দিয়ে করালে সবচেয়ে ভাল হবে, সেটা বোঝার দক্ষতা ওঁর মারাত্মক ছিল। সুযোগ্য কর্মীর খোঁজ পেলে দূরদূরান্ত থেকে নিয়ে আসতেন নিজের সংস্থায়। যে সহকর্মী ইঞ্জিনিয়াররা ওঁর ভাবনাকে রূপ দেওয়ার কাজে লেগেছিলেন, তাঁদের উনি বলতেন ‘ইম্যাজিনিয়ার’ (Imaginner)। মানে, যাঁরা স্রেফ কেজো ইঞ্জিনিয়ার নন, যাঁরা কল্পনা করতে জানেন, যাঁরা দ্রষ্টা। ওঁর দাদা রয় ডিজনিও অসামান্য দক্ষ ম্যানেজার ছিলেন। সব কর্মীই ছিলেন ওঁর স্বপ্নের শরিক। এই যে সবাই মিলে একটা দারুণ সুন্দর স্বপ্ন দেখা আর পরে সে স্বপ্নটাকে সত্যি করতে কাজে নামা, এটাও ডিজনিরই শেখানো।

সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE