রাস্তাতেই খসখস করে একটা আওয়াজ হল। গুগলি অবশ্য শুনতে পায়নি। গান শুনছিল। বাবার কান কিন্তু এড়ায়নি। তাপসমামুকে গাড়ি সাইড করতে বলল। পিছনের দরজা দিয়ে নেমেই চাকার নীচে প্রায় ঢুকে গেল বাবা। গান থেমে যেতে গুগলিও ‘কী কী’ বলে শোরগোল তুলল। বাবা আপশোস করলেন, কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না বলে। তাপসমামু বলল, জামাইবাবু, প্লাস্টিকের প্যাকেট-ট্যাকেট হয়তো ফেটেছে। বাবার কাছ থেকে কোনও উত্তর এল না দেখে গুগলি বুঝল, তাপসমামুকে অন্য কারণ দেখাতেই হবে।
শনি-রবি ছুটির পর সোমবার সকালে গাড়ি বার করতে না করতেই শোরগোল। গুগলি একছুটে পিছনের সিটে বাবার পাশে এসে বসতেই, তাপসমামুর উসখুস: জামাইবাবু, কেমন পচা পচা গন্ধ ছড়াচ্ছে! আপনি পাচ্ছেন না? বাবা বলল, ভাল করে ঝেড়েছ? পচা ফুল-মালা কিছু পড়ে নেই তো? গুগলিও তার বসার জায়গাটা দেখে নিল। অনেক সময় আচার, হজমির মোড়ক এ দিক ও দিক গুঁজে রেখে দেয় সে। রুমালে জড়ানো কলাটা তো মা এখান থেকেই আবিষ্কার করেছিল। ইস্কুলে ফেলতে সাহস পায়নি, তাই স্কার্টের পকেটে করে নিয়ে এসেছিল। আজ গুগলির মা পিছনের সিটে গুগলির পাশে, আর বাবা সামনে। গন্ধের কথা শুনেই মা বলে উঠল, নিশ্চই তোমরা কেউ পটি মাড়িয়ে ঢুকেছ। জুতো থেকেই তো গন্ধ আসে। তাপসমামু ‘হাঁ হাঁ’ করে উঠে বলল, দিদিভাই খেয়াল করুন, একেবারে সামনে থেকে আসছে। মা তাপসমামুকে তাড়া দিয়ে বলল, নে নে অনেক হয়েছে, গাড়ির বনেটে ছুঁচোতে ‘হিসু’ করে পালিয়েছে। হো হো করে হেসে উঠল গুগলি। তাপসমামু কিন্তু সেই থেকে কীসের যেন গন্ধ পেতেই থাকল। গাড়ির খসখস আওয়াজ, বোটকা গন্ধ এই সব নিয়ে সে যেন মুখে কুলুপ এঁটেছে। গুগলিও ভুলে গেল, কী নিয়ে গাড়ির ভেতর যেন নানা অসুবিধে হচ্ছিল।
প্রায় মাসখানেক সব চুপচাপ। আজ হঠাৎ মায়ের কাছে গাড়ির চাবি নিতে এসে তাপসমামু বলল, ইঁদুর মারার জন্যে ওষুধ কিনতে হবে। বইয়ের পাতার মতো। ওটা খুলে রেখে দিলেই তাতে টপাটপ আটকে যাবে। মা বলল, নীচের গ্যারাজে ক’টা ইঁদুর মারবি? পাশেই তো খোলা ড্রেন, বস্তির স্নানকল। তা ছাড়া পাঁচিলের পাশের দিকে যে দরজাটা খোলা হয় না, সে দিকে বস্তির লোকেরা রাজ্যের ঝুড়ি-টিন-হাবিজাবি জড়ো করেছে। নীচের প্লাস্টিকের গারবেজবিনটাতেও একটা খাবলা গর্ত। কবে পালটানো হবে কে জানে! তাপসমামু বলল, বাইরে নয়, গাড়ির বনেটের ভিতর ওষুধের পাতাটা আজ রেখে দেব। মা তো বুঝতেই পারল না যে, পাতার মধ্যে সে আবার কী ওষুধ! টাকা দেওয়ার সময় তাপসমামু বলল, পঞ্চাশ টাকা দিন, এটার দাম আছে।
গুগলি তো উত্তেজনায় ছটফট করছে। আজ আর গাড়িতে গান শোনার আবদারও করেনি। বাবা খবরের কাগজ পড়ছে। গুগলি রাস্তা দেখতে দেখতে ইসকুল পৌঁছল। ছুটির পর মা-র সঙ্গে এ দিক ও দিক একটু ঘুরে বাড়ি ফিরল গুগলি। লিফটে উঠে যাওয়ার আগে গাড়ির চার পাশে ঘুরঘুর শুরু করতেই মা তার হাত ধরে টেনে নিয়ে লিফটের বোতাম টিপে দিল। তাপসমামু চাবি দিতে এসে জানাল, বনেট খুলে সে তাজ্জব! কারণ, ওয়াইপারের পুরো তারটাই কাটা। এর মধ্যে বৃষ্টি আসেনি বলে, ওয়াইপার চালাতে হয়নি। তাই ধরা পড়েনি ব্যাপারটা। মা বলল, কাল জামাইবাবুকে বলে দিস। অফিস যাওয়ার পথে সার্ভিস সেন্টারটা ঘুরে যেতে।
সন্ধেবেলা থেকে গুগলির মাথায় ঘুরছে মিকি মাউসের কার্টুন। কিন্তু তাদের মারবার ব্যবস্থা কেন হচ্ছে সেটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। গুগলি সত্যিকারের বেড়াল, গরু, কুকুর, মুরগি, হাঁস, হনুমান এ সব দেখেছে। কাঠবিড়ালী, পাখি, প্রজাপতিও। কিন্তু ইঁদুর তো সে কার্টুন ছাড়া দেখেনি। আর তারা তো সব ভাল ইঁদুর। তাদের বাড়িতে বাবা-মা-ভাই-বোন সক্কলে আছে। ঠাম্মাকে ফোন করে মা কী সব বলছে। মাঝে মাঝে হাসছেও। কে জানে, ঠাম্মা ওপার থেকে ইঁদুর নিয়ে কোনও হাসির গল্প বলছে কি না! কিছু ক্ষণ পরে বাবা ফিরল। সব শুনে বলল, স্টিয়ারিং-এর সামনে তোমার ওই গণেশ বসানোই কাল হল। নাও, ঠ্যালা সামলাও। বাহনরা এ বার তাদের প্রভুর চার পাশে থাকতে চাইছে। মা বলল, ও বাড়িতে ফোন করেছিলাম, তোমার মা বলেছেন, পড়ে থাকা ইঁদুর কলটা এনে এ বাড়ির অ্যাসোসিয়েশনকে গিফট করে দিতে। ও সব পাতাটাতা দিয়ে ধরার কম্ম নয়।
আজ ঘণ্টাখানেক আগেই তাপসমামু চলে এল। গুগলির তখনও ইসকুলের ড্রেস পরা চলছে। মায়ের কাছ থেকে চাবি নিয়ে চলে যেতেই বাবা বলল, তাপস একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে। কাল রাতে ফোন করে অনেক সম্ভাবনার কথাই সে বলেছে, মানে ওয়াইপার ছাড়া আরও কী কী ক্ষতি ইঁদুরের দল করে রাখতে পারে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তাপসমামু উঠে এল। মুখে বীরের হাসি। বলল, ধরা পড়েছে। একটা নয় চারটে বাচ্চা। মা বলল সত্যি? বলিস কী! পট করে মোবাইল বার করে তাপসমামু দেখিয়ে দিল। বলল, এই দেখুন টাটকা ছবি। গুগলি হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বাবা বলল, ফেলে দিয়েছিস? তাপসমামু বলল, চলুন এক বার, দেখবেন না? তার পর গতি করব।
বাবা-মায়ের সঙ্গে গুগলিও নেমে এল। বাবা আর সে একেবারে তৈরি হয়েই নেমেছে। ব্যাগগুলো সামনের সিটে রেখে তাপসমামু বনেট খুলল। মা তো ভয়ে গুগলির হাতই ছাড়ল না। ওড়না দিয়ে নাকটা চেপে দাঁড়াল। বাবারও নাকে রুমাল। তাপসমামু বীরদর্পে একটা ভাঁজ করা কার্ডবোর্ড বার করল। তাতে আটকে আছে চারটে মরা ইঁদুর। দেখেই মা বলল, আরে আরে এগুলো তো ছুঁচো, ইঁদুর নয়। বাবা বলল, যাক গণেশকে আর দোষ দেওয়া যাবে না! কিন্তু গাড়ির ভেতর এরা সংসারটা পাতল কী ভাবে? তাপসমামু হাত পা নেড়ে বোঝাতে লাগল যে, এই ধরনের গাড়ির নীচের দিকটা যেহেতু ঢাকা নয়, তাই সহজেই ঢুকে পড়েছে! সে বলতে লাগল, বুঝলেন তো জামাইবাবু সে দিন সেই খসখস আওয়াজটা এদের মায়ের। ছানাগুলো তখন পেটের মধ্যে ছিল আর ও কোনও ভাবে এ দিক থেকে গড়িয়ে, ও দিকে পড়েছিল। বাবা বলল, তার মানে এই ছুঁচুন্দরী আমাদের সঙ্গে বারুইপুর টু ব্যারাকপুর চষে বেড়িয়েছে।
গুগলি কোনও কথা বলছে না। সকলের কথা শুনে বুঝতে পারছে যে ছুঁচো বলে এমন এক জন্তু আছে, যাকে সে চেনে না এবং যে গাড়ির যন্ত্রপাতি সব কেটেকুটে গাড়িটাকেও অচল করে দিকে পারে। তাপসমামু বলল, ধাড়িটা ধরা পড়েনি, আরও কয়েক দিন পাতাটা রাখব, যদি ধরা পড়ে। ওপরে উঠে যাওয়ার আগে মা তাপসমামুকে বলে গেল, ছুঁচোদের ছবিগুলো ডিলিট না করে দিতে। বিকেলে ফিরে যেন ওপরে নিয়ে আসে মা সেভ করে নেবে। গুগলির উত্তেজনা চরমে পৌঁছল মা চলে যাওয়ার পর। বাবা বলল, এগুলোকে কোথায় ফেলবি? গন্ধে তো পাড়া ছাড়া করবে! তাপসমামু বলল, না না, ফেলাফেলির কোনও সিন-ই নেই। এক্ষুনি সাবাড় হয়ে যাবে। বলেই মরা ছুঁচোগুলোকে পাঁচিলের ওপর ঝেড়ে ফেলল পাতাটা থেকে। সঙ্গে সঙ্গে গোটা পাঁচ-ছয় কাক উড়ে এসে টপাটপ খেয়ে ফেলল তাদের। বাবা বলল, তাপস তুই তো কাকেদের আশীর্বাদ কুড়োলি রে! তাপসমামু বলল, ধাড়িটাকে ধরবই। ক’দিন ধরে এই গা গুলোনো গন্ধ নাকে-মাথায় নিয়ে গাড়ি চালিয়েছি, পার্কিংয়ে বসে থেকেছি, টিফিন করেছি। সমানেই ভেবেছি কী করে এমন হচ্ছে! শেষ কিনা ছুঁচো! ছ্যা ছ্যা!
সন্ধেবেলা জালে পড়া ছুঁচোর বাচ্চাদের ছবিটা মা ফেসবুকে আপলোড করে দিল। মুখে দুষ্টু দুষ্টু হাসি। বাড়ি ফিরেই বাবার বকাবকি: কী ছেলেমানুষি করো বলো তো। ফেসবুকে লাগিয়ে দিলে! সারা অফিস সন্ধে থেকে তোলপাড়! বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাচ্ছে উত্তর দিতে দিতে। গুগলি ফোড়ন কেটে বলল, ফোনও আসছে। সারা সন্ধে মা শুধু সবাইকে ওষুধের নাম বলে যাচ্ছে, আর বলছে তাপসমামুর সাহসের কথা। মাকে ডেকে বাবা বলল, তুমি একা নও, তাপসও তার পেজ-এ ওই একই ছবি আপলোড করেছে। বাবার ড্রাইভার রায়কাকুকে ট্যাগ করে দিতে সেও বাবাকে প্রশ্ন করছে। মা বলল, তুমি কি শুধু দেখেই ছেড়ে দিয়েছ? আমার পোস্টটা লাইক করোনি এখনও?
সকালে স্কুল যাওয়ার সময় লিফট খুলে ঢুকতেই গুগলি দেখল, গত কালের সেই ছবিটার একটা বড় প্রিন্ট আউট লিফটের দেওয়ালে সাঁটা। নীচে নামতে না নামতেই গ্যারাজের দেওয়ালে দেওয়ালে আরও কয়েকটা। বাবার মুখে হাসি দেখে গুগলি ভরসা পেল। যাক, দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি সাঁটিয়ে, মা তা হলে খুব একটা কিছু গোলমাল করেনি। ভরসা পেয়ে গুগলি বাবাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা এ বারে কি বন্ধুদের গল্পটা করতে পারি? তখনই গুগলি ঠিক করে নিল বাড়ি এসেই মাকে বলবে যে এই ছবিটা দিয়ে বেশ কয়েকটা গ্রিটিংস কার্ডও বানিয়ে দিতে।
তাপসমামুই শুধু খুশি নয়। কারণ, এক সপ্তাহ হয়ে গেল তবু ধাড়ি ছুঁচুন্দরী তার ফাঁদে পা দিল না বলে। কিন্তু গুগলির স্বপ্নে প্রায়ই আসা যাওয়া করতে লাগল এক রহস্যময় মোটামোটা জন্তু যে দেখতে খানিকটা ইঁদুরের মতো হলেও আসলে কিন্তু ছুঁচো আর তাদের সকলের থেকে বুদ্ধিমতী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy