Advertisement
E-Paper

ব্যাকরণ আর ব্যবসা

দুটোতেই দক্ষ ছিলেন তারানাথ তর্কবাচস্পতি। কালনার এই পণ্ডিতকে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার ভার নিতে অনুরোধ করেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। ছাত্রদের ভরণপোষণে নামেন ব্যবসাতেও। দুটোতেই দক্ষ ছিলেন তারানাথ তর্কবাচস্পতি। কালনার এই পণ্ডিতকে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার ভার নিতে অনুরোধ করেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। ছাত্রদের ভরণপোষণে নামেন ব্যবসাতেও।

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০৬
পণ্ডিত: কালনায় তারানাথ তর্কবাচস্পতির মূর্তি। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল

পণ্ডিত: কালনায় তারানাথ তর্কবাচস্পতির মূর্তি। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল

পাদুকা পায়ে এক বাঙালি হেঁটে চলেছেন কলকাতা থেকে কালনা। ১৬ ডিসেম্বর, ১৮৪৪। উদ্দেশ্য, কালনায় তাঁর এক অগ্রজ পণ্ডিতকে সংস্কৃত কলেজের প্রথম শ্রেণির অধ্যাপক হিসেবে চাকরিতে যোগ দিতে রাজি করানো। কলকাতা থেকে যিনি এসেছেন, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আর যাঁর কাছে আসা, তিনি তারানাথ তর্কবাচস্পতি। ঘটনাচক্রে, ওই পদে নিয়োগের জন্য বিদ্যাসাগরের নাম সুপারিশ করা হয়। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মতে, তারানাথ ‘‘আমার চেয়ে অনেক বড় পণ্ডিত, নিয়োগপত্র পাওয়ার যোগ্যতা তাঁরই আছে।’’

তারানাথের পাণ্ডিত্যের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পরিচিতি অনেক আগে থেকেই, সংস্কৃত কলেজের ছাত্রাবস্থায়। আর তাই ছাত্র বিদ্যাসাগরকে প্রায়ই দেখা যায় কলেজের সিনিয়র তারানাথের ঠনঠনিয়া বাসাবাড়িতে বিশ্বনাথ কবিরাজের ‘সাহিত্যদর্পণ’ পড়তে। আবার পরে বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে যখন সই সংগ্রহ চলছে, তার দ্বিতীয় সইটি করেছিলেন এই তারানাথই। বিদ্যাসাগরের প্রভাবেই হয়তো তারানাথ বেথুন সাহেবের গার্লস স্কুলে কন্যা জ্ঞানদাদেবীকে পাঠিয়েছিলেন।

দুজনের সম্পর্ক যে কেবলই মধুর ছিল, এমনটাও নয়। বহুবিবাহের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর পুস্তিকা লিখলেন। প্রতিবাদপুস্তিকা প্রকাশও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। পাঁচ জন প্রতিবাদীর অগ্রগণ্য এই তারানাথই। বিদ্যাসাগরও নাছোড়। তিনিও দিলেন খোঁচা, ‘অতি দর্পে লঙ্কাপতি সবংশে নিপাত।/ অতি দর্পে বাচস্পতি তব অধঃপাত।।’ আসলে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রীয় যুক্তি নাপসন্দ তারানাথের। এর পরেও বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রীয় ‘বুদ্ধির প্রশংসা’ করলেন তারানাথ।

কিন্তু কে এই তারানাথ? কেন তিনি বার বার নাড়া দেন বিদ্যাসাগরকে? এক কথায় উত্তর, এর কারণ, তারানাথের প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য। যার প্রস্তুতিপর্বের শুরু সেই পাঁচ-ছ’বছর বয়সে। ওই বয়সেই তারানাথকে দেখা যায়, বাবা কালিদাস সার্বভৌম ও জেঠামশাইয়ের ছেলে তারিণীপ্রসাদ ন্যায়রত্নের কাছে ব্যাকরণ, ‘অমরকোষ’, ‘ভট্টিকাব্য’, ‘শিশুপালবধকাব্য’ অধ্যয়ন করতে।

এক বার সংস্কৃত কলেজের রামকমল সেন এসেছেন কালনায়, কালিদাস সার্বভৌমের কাছে। রামকমল দেখলেন, কালিদাস ও বর্ধমানের ঘোষপাঁচকার মাহেশ্বরী ঘটকের ছেলে, বছর আঠারোর তারানাথ ও তারিণীপ্রসাদ শাস্ত্র আলোচনায় রত। তা দেখেই তারানাথকে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানোর প্রস্তাব দিলেন রামকমলবাবু। কালিদাসের যদিও মত, কলকাতা গেলে ছেলে নাস্তিক বা খ্রিস্টান হয়ে যাবে। শুনে রামকমলের বক্তব্য, ‘‘আমি তো ঘোর আস্তিক ও হিন্দু।’’ শেষে তারানাথ ভর্তি হলেন কলেজের অলঙ্কার শ্রেণিতে। কিন্তু তাঁর যাতায়াত বেদান্ত ও কাব্যের ক্লাসেও।

ছাত্রাবস্থাতেই মিলল পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি। এশিয়াটিক সোসাইটি ‘মহাভারত’ পুনর্মুদ্রণ ও তার প্রুফ দেখার দায়িত্ব দিয়েছিল শিক্ষক নিমচাঁদ শিরোমণিকে। নিমচাঁদবাবুর তখন বয়স হয়েছে। তাই সংশোধন ও প্রুফ দেখার কাজ করলেন নিমচাঁদের ছাত্র তারানাথই। ১৮৩৫-এ কলেজের পাঠ শেষ। কাশী ছুটলেন তারানাথ। ন্যায়শাস্ত্রের উচ্চতর পাঠ, শ্রীহর্ষের ‘খণ্ডনখণ্ডকাব্য’, পাণিনির ব্যাকরণ, বেদ-বেদান্ত, মীমাংসা-পাতঞ্জল প্রভৃতি দর্শন, গণিতশাস্ত্রেও অধিকার জন্মাল ওই সময়েই। তবে তারানাথের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি, ‘শব্দস্তোম মহানিধি’ নামে পাঁচ খণ্ডের অভিধান ও ‘বাচস্পত্যাভিধান’ সঙ্কলন। এ ছাড়াও সংস্কৃত কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ এডওয়ার্ড কোওয়েল সাহেবের অনুরোধে সংস্কৃত শাস্ত্রের বহুবিধ গ্রন্থের টীকা রচনা, পাণিনির ব্যাকরণের টীকা প্রস্তুতের মতো দুরূহ কাজ করেন তারানাথ। পাণিনির ব্যাকরণের টীকা পড়ে সে কালের ব্যাকরণচর্চার শ্রেষ্ঠ স্থান কাশীর পণ্ডিতেরাও বলেছিলেন, ‘বাচস্পতি মহাশয় পাণিনির এক জন অবতার।’ এ ছাড়া ওড়িশার ঢেঙ্কানলের রাজার অনুরোধে দশ দিনে মধুসূদন সরস্বতীর ‘সরস্বতীসিদ্ধান্তবিন্দু’-র সারাংশ রচনা করলেন তারানাথ।

শুধু তাই নয়, সারা ভারতবর্ষেই তারানাথের শাস্ত্রীয় নিদানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এক কালে বিলেতযাত্রা গুরুতর অপরাধ ছিল। তারানাথ নিদান দিলেন, নিয়মিত শাস্ত্র পালন করলে ও ‘ম্লেচ্ছদিগের’ অন্ন না খেলে বিদ্যা অর্জনের জন্য বিলেত যাত্রায় বাধা নেই। শোনা যায়, এই নিদান দেখিয়েই বিলেত যান নেপালের মহারাজা।

বিদ্যাসাগর আর তারানাথের একটি মিলও রয়েছে। দু’জনেই ‘বিদ্যাবণিক’। তবে বিদ্যাসাগরের বণিকসত্তা মূলত বই লেখা ও প্রকাশনার কাজে ব্যবহৃত। তারানাথ কিন্তু রীতিমতো শিল্পপতি। অধ্যাপনার পাশাপাশি ব্যবসার কারণ, তারানাথের বিশ্বাস ছিল, কালনা-সহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা তাঁর বিপুল ছাত্রসমাজের ভরণপোষণের দায় আসলে আচার্যেরই।

আর সেই কারণেই কাপড়, কাঠ ও ধান-চালের বিরাট ব্যবসা শুরু করলেন তারানাথ। কালনায় তাঁতিদের নিয়ে আসা, বিলিতি সুতো কেনা, মেদিনীপুরের রাধানগরে কাপড় তৈরির কারখানা তৈরি, সেই কাপড় মথুরা, গাল্বিয়র-সহ দেশের নানা জায়গায় পাঠানো, সব ভূমিকাতেই সক্রিয় ছিলেন তিনি। নেপাল থেকে আনালেন শাল কাঠ। দোকান দিলেন কলকাতার বড়বাজারে। প্রতি বছর কাশ্মীরি শালের বিপণন, তা-ও হল। বীরভূমের সিউড়িতে গয়নার দোকান তৈরি, ওই জেলাতেই চাষের জন্য পাঁচশো গরু কিনে তা থেকে দুগ্ধজাত জিনিসপত্র বিক্রি, এই সব কিছুই এই বিদ্যাবণিকের ব্যবসার অঙ্গ। কালনার জমিতে আনাজ ফলিয়ে তা বিক্রি করার জন্য বেছে নিলেন কলকাতার পোস্তা বাজারকে।

এই ব্যবসা থেকে রোজগারের কারণেই তারানাথ কলকাতায় তৈরি করতে পারলেন ‘ফ্রি সংস্কৃত কলেজ’। সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশের নানান জায়গা থেকে পড়ুয়ারা এলেন সংস্কৃত শিখতে। ছাত্রদরদিও ছিলেন তিনি। ‘কিরাতার্জ্জুনীয়’ ও ‘শিশুপালবধ’ কাব্য দু’টি ছাপা ছিল না বাজারে। ছাত্রদের জন্য সেই কাব্য দু’টি ছাপানোর ব্যবস্থার পাশাপাশি তারানাথ কাশী থেকে আনালেন মল্লিনাথের টীকা। আর এই গোটা প্রকল্পে যা আর্থিক লাভ হল, তা তারানাথ নিবেদন করলেন অধ্যাপক যোগধ্যান মিশ্রকে।

গুণী মানুষের সাহায্যে সব সময় উদারহস্ত ছিলেন বিদ্বান মানুষটি। সেই কারণেই কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘মহাভারত’ অনুবাদ করতে গিয়ে যখন সমস্যায় পড়েছিলেন, এগিয়ে এসেছিলেন এই তারানাথই। কালীপ্রসন্ন এর বিনিময়ে অর্থ দিতে গেলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন পণ্ডিতপ্রবর। এটাই তো স্বাভাবিক!

শুধু পাণ্ডিত্য বা ব্যবসায় সাফল্য, তাই নয়। তারানাথের দক্ষতা দেখা যায় কবিগান, আখড়াই সঙ্গীত রচনা, পাখোয়াজ বাদন, এমনকী রন্ধনশিল্পেও।

কাজপাগল তারানাথ ব্যক্তিগত জীবনে শোক পেয়েছেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হয় বিয়ের ছ’মাসের মধ্যে। দ্বিতীয়া স্ত্রীও গত হন বিয়ের কয়েক বছরের মাথায়। শেষে তৃতীয় বিয়ে হয় প্রসন্নময়ী দেবীর সঙ্গে। তবে তারানাথের ব্যক্তিজীবনের সব থেকে বড় গর্ব খুব সম্ভবত ছেলে জীবানন্দ বিদ্যাসাগরকে নিয়ে। জীবানন্দ একশোরও বেশি সংস্কৃত গ্রন্থ টীকা-সহ প্রকাশ করেছিলেন। প্রসন্নচিত্ত পিতা তখন ভাবলেন, ইহজগতে এ বার তাঁর কাজ শেষ হয়েছে। কাশীনিবাসী হলেন তারানাথ। সেখানেই মৃত্যু— ১৮৮৫ সালে।

Taranath Tarkabachaspati তারানাথ তর্কবাচস্পতি Ishwar Chandra Vidyasagar ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy